একজন সন্ন্যাসী সদ্-গুরু কোন একসময় পরিব্রাজনে বের হয়েছিলেন ৷ একবার তিনি হাঁটতে হাঁটতে একটি গ্রামের প্রান্তে এক বনের কাছাকাছি ডেরা বেঁধে রয়েছেন _এমন সময় দেখলেন যে, প্রাণভয়ে ভীত একটি লোক প্রাণপন দৌড়ে তার কাছে এল এবং প্রাণভিক্ষা চাইল । সন্ন্যাসী তৎক্ষণাৎ ব্যাপারটা বুঝে নিলেন এবং দেখলেন বেশ কিছুটা দূরে অনেক মানুষজন লাঠি-সোটা নিয়ে দৌড়ে আসছে ৷ তিনি লোকটিকে তার তাঁবুতে ঢুকে পোষাক ছেড়ে সাধুর পোষাক পড়ে নিতে বললেন ৷ লোকটি তা করতে না করতেই মানুষজন অস্ত্রশস্ত্র – নিয়ে হাজির । তারা সাধুকে দন্ডবৎ হয়ে বলল – “সাধুবাবা এদিকে একটা চোর আসছিল – দেখেছেন ? সাধুবাবা মৌন থাকলেন – নির্বিকারভাবে তাকিয়ে থাকায় তারা আর সাধুকে বিরক্ত না করে চলে গেল। রাত্রে যখন স্থানটি নির্জন হ’ল, তখন লোকটিকে সাধুবাবা চলে যেতে বললেন ।
লোকটি কিন্তু গেল না ! সে সাধুবাবার পা-দুটি ধরে প্রার্থনা করতে লাগল সাধুবাবার সঙ্গে থাকার জন্য ৷ সে জানাল যে, সে বড়ই দুঃখী । সংসারে আপনজন বলতে কেউ নাই। ছোটবেলা থেকেই সে অনাথ এবং অনিকেত। শিশুবয়স থেকে চৌর্য্যবৃত্তির ন্যায় কুঅভ্যাসে ফেঁসে গিয়েছে সে ৷ এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনায় তার বোধ হয়েছে যে অন্তত একটা নিরাপদ আশ্রয় তার রয়েছে – সেখানে গেলে সে ভয়মুক্ত – বিপদমুক্ত এবং সেটা ঐ সাধুবাবার চরনতল! তাছাড়া যেহেতু সে চোর তাই সর্বদাই ‘ভয়’ তাকে তাড়া করে করে বেড়ায় । সে এই জীবন থেকে মুক্তি চায়!
চোরটির কাতর প্রার্থনায় সাধুবাবার মনে তার প্রতি দয়া বা অনুকম্পা হল ৷ ফলে যা হবার তাই হল_চোরটি সাধুর চেলা হবার সুযোগ পেল! ছোটবেলা থেকেই চোরটির কোন সৎশিক্ষা ছিল না, তাই সবসময় সাধু তাকে নানান সদ্-উপদেশ দিতেন, জীবনে চলার পথে ‘কি কি করতে হয় আর কি করতে নেই’ — তা বোঝাতেন। এর মধ্যে একটি শিক্ষা সাধু সেই চেলাটিকে প্রায় শেখাতেন , সেটা হচ্ছে – “বনো মৎ , বন্‌ নে সে পিটাই হোগা” ৷ বলতেন _”দ্যাখো বাছা! তুমি তো আকুমার ব্রহ্মচারী নও , তুমি দীর্ঘকাল অসংযত জীবন-যাপন করেছ। এখন– যখন তুমি এই ত্যাগের ব্রত গ্রহণ করতে চাইছ , তাহলে প্রথমেই তোমাকে সহজ সরল হতে হবে! তুমি যা – তুমি তাই , সেটাই তোমার পরিচয় ৷ তুমি যা নও – সেটা মিছিমিছি লোককে বলতে যেও না – ‘বনো মৎ’ – অর্থাৎ “বোনো”না বা নকলভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করতে যেও না , যা নও — তা বলতে যেও না বা হতে যেও না।”
এইভাবেই চলছিল সেই দুজনের জীবন! সময় ঠিকই কেটে যাচ্ছিল। সাধুবাবার তো ছিল পরিব্রাজন জীবন – দু-চার দিন পর পর এক এক স্থানে এক বা দুইদিনের বিশ্রাম_তারপর আবার চলা শুরু! এইরকম ভাবে ঘুরতে ঘুরতে তারা একবার এক গভীর জঙ্গলে এসে উপস্থিত হ’ল । জঙ্গল ভেঙে ভেঙে সাধুবাবা আগে আগে যায় আর পিছনে বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে চলে চেলা! চেলা(চোর) মাঝে মাঝে ভাবে — এর চাইতে গৃহস্থের বাড়ীতে এটা-সেটা চুরি করাটাই অনেক কম কষ্টের ছিল! কিন্তু যেই Public-এর গণ পিটুনির কথা মনে পড়ে আর অমনি ভাবে , না না এই জীবনটাই ভালো!
কিন্তু বনপথে হাঁটার দিন _সে আর যেন পারছিল না। দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত , পেটেও তেমন কিছু পড়েনি! সে গুরুকে বলেই ফেলল – “গুরুদেব , আমি বড়ই ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত , আর তো হাঁটতে পারছি না! অাপনি যা হোক কিছু একটা ব্যবস্থা করুন ৷” গুরুদেব হেসে বললেন “জীবন ধারণটাই তো কষ্টের বেটা ! এখানে একটুখানি সুখের জন্য অনেকখানি কষ্ট করতে হয়! যাইহোক, এই গভীর অরণ্যে যেখানে সেখানে তো বিশ্রাম নেওয়া যায় না , ঠিক মতো স্থান পেলে আমি নিশ্চই সেখানে তোমার আহার্য্য ও বিশ্রামের ব্যাবস্থা কোরবো । এখন চল।”
সে কি আর করে _আবার গুরুর সাথে চেলার চলা শুরু হোল।
পথ চলতে চলতে যখন শিষ্যের মনে হচ্ছে আর সে পারবেই না — মাথা ঘুরে পড়ে যাবে — ঠিক তখনই গুরুদেব বলে উঠলেন – “ওই দ্যাখো ! এই যে বাড়ীটা দেখছ এখানেই আজ রাত্রির জন্য আমাদের আশ্রয়!” চেলা চোখ তুলে দেখল পাশেই একটা কি সুন্দর বাড়ী! ছোটখাটো প্রাসাদ বললেই হয় ! এই দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্যে এমন সুন্দর বাড়ী ! চেলার মনে খুবই আনন্দ হ’ল ৷ সে ভাবল এ সবই গুরুর মহিমা ! ভারী স্ফূর্ত্তিতে সে গায়ে বল পেয়ে গেল — দৗেড়ে বাড়ীর মধ্যে ঢুকেই দেখে কত ঘর ! একটা ঘরে প্রচুর খাবার-দাবার থরে থরে সাজানো, সব ঘরেই শোয়ার ব্যবস্থা তবে একটি বড় ঘরে বেশ সুন্দর গদিওয়ালা বিছানা ! এইসব দেখে তাকে আর পায় কে ! সে গুরুর দ্রব্যাদি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে – খাবার ঘরে ঢুকেই সাজানো খাবার থেকে এটা-ওটা তুলে নিয়ে পেটপুরে খেল! তারপর পাশের ঘরে সুন্দর ধপধপে বিছানা — বড় পালঙ্কে মখমলের গদি পাতা রয়েছে দেখে সে আর বিলম্ব না করে শুয়ে পড়ল আর অচিরেই নাক ডেকে ঘুমিয়ে গেল । [ক্রমশঃ]