(গল্পের প্রথমাংশে ছিল __এক সাধুবাবার কাছে একজন চোর এসে শিষ্যত্ব গ্রহন করতে চেয়েছিল, সাধুবাবা তার জেদাজেদিতে চলার পথে তাকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। ওরা জঙ্গলের মধ্যে একটা প্রাসাদের মতো বড় বাড়িতে এসে পৌঁছেছে এবং ক্লান্ত সাধুবেশী চোরটি ওখানে থাকা ভালো খাবার খেয়ে দামী বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।)
এখন ঘটনাটা কি ঘটেছে – ঐ প্রাসাদটি সেই দেশের রাজার! তিনি যখন যখন মৃগয়া করতে আসেন , তখন এই প্রাসাদে রাত কাটান! সেইজন্য সারাবছরই এটি সংরক্ষণ করা হয় ৷ তারজন্য Security guard , Maintaince -এর লোকজন সবই নিযুক্ত থাকে ৷ ঘটনাক্রমে সেইদিনই রাজার আসার কথা! তাই রাজার জন্য এবং তার অনুচরদের জন্য খাবার-দাবার বা বিশ্রামকক্ষ Ready করে সবাই Main-gate -এর সামনে রাজার আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল ৷
সাধুবাবা আর চেলাটি পিছনের দিক থেকে ঢুকে পড়েছিল _ যেটা সেই মূহূর্ত্তে যে কোন কারণে কারো নজর পড়েনি ।সব ঘরের দরজা বন্ধই ছিল — চেলাটি প্রতিটি ঘরের দরজা খুলে খুলে সব দেখেছে আর খাওয়া দাওয়া, শোওয়া_এইসব কান্ড করেছে!
এদিকে সন্ধ্যার সময় যথারীতি রাজা এসে হাজির ! Care-Taker -রা সসম্মানে রাজাকে নিয়ে রাজার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে প্রবেশ করে দ্যাখে কি – একজন শুয়ে আছে । রাজা অবাক – রক্ষীরা আরো অবাক ! তারা খোঁচা মেরে তাকে তুলে দিতেই – কাঁচা ঘুম ভাঙা , বিরক্ত চেলাটি চোখ কচলে উঠে পড়ে বিরক্ত কন্ঠে বলল – “কি ব্যাপার! কে তোমরা? আমার ঘুম ভাঙালে কেন?”
এটা শুনে রেগে অগ্নিশর্মা রক্ষীরা তরোয়াল বের করে জিজ্ঞাসা করল – “কে তুই ! তোর এত আস্পর্ধা তুই রাজার ঘরে ঢুকে রাজার পালঙ্কে শুয়ে আছিস ! বল্ কে তুই !” চেলা এসব দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলে উঠল – “আমি সাধু – মহাত্মা !” রাজা লোকটির বুকে এক লাথি মেরে বলল – “তুই সাধু ! ব্যাটা ভন্ড ! সাধু কখনও বিলাসী হয় না !” তারপর রক্ষীদের আদেশ দিলেন – “মারতে মারতে এটাকে গেটের বাইরে ফেলে আয় !”
সাধুবাবা কিন্তু প্রাসাদের ভিতরে ঢোকেন নি। পিছনের গেটের পাশে বসে বসেই সাধুবাবা সান্ধ্যকালীন ধ্যান-জপে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন ৷ সেখানে তাঁর গায়ের উপর চেলাকে ফেলে দিতেই সাধুর ধ্যানভঙ্গ হ’ল । তিনি চোখ মেলে দেখলেন যে রাজার রক্ষীরা ঐ ব্যক্তিকে মেরে কি ‘হাড়ির হাল’ করেছে ! এদিকে রক্ষীরাও সেখানে ঐ সাধুবাবাকে দেখে অবাক ! তারা দৗেড়ে ভিতরে গিয়ে রাজাকে খবর দিল — কারণ তারা জানতো মহারাজ ঐ সাধুকে খুবই ভক্তি কোরতো ৷ রাজা বাইরে এসে ঐ সাধুবাবাকে দেখে খুবই আনন্দিত হলেন এবং ভিতরে যাবার জন্য খুবই অনুনয়-বিনয় কোরতে লাগলেন। আরও অনুরোধ করলেন যাতে তিনি একটু আহার্য্য গ্রহণ বা রাতে সেখানেই বিশ্রাম নেন। সাধুবাবা তাঁর সঙ্গে আসা লোকটির ঐরূপ অবস্থার কারণ কি তা জানতে চাইলেন। ঐ ব্যক্তি যে সাধুবাবার চেলা – তা জানতে পেরে রাজামশাই খুবই লজ্জা প্রকাশ করতে লাগলেন।
সাধুবাবা রাজা বা রক্ষীদের সামনেই ঐ ব্যক্তির পরিচয় প্রদান করে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন – “আমি তোমাকে শিক্ষা দিয়েছিলাম যে – বনো মৎ , বন্ নে সে পিটাই হোগা – তা তুমি নিশ্চয়ই সেই শিক্ষার অবমাননা করেছ ৷ তুমি এদের কাছে নিজের কি পরিচয় দিয়েছ ?” সেই ব্যক্তি কাঁদতে কাঁদতে বলল – “আমি বলেছিলাম — আমি সাধু !” সাধুবাবা বললেন – “কিন্তু তুমি তো তা নও ! এই মাত্র কয়েক দিন হ’ল তুমি আমার কাছে এসেছ এবং আমার শিক্ষা মতো তোমার জীবন গঠন করার চেষ্টা করছ ৷ তোমার এখনও ক্ষুধা – নিদ্রা আদি ইন্দ্রিয়াদির কার্য্যসকলেরই নিয়ন্ত্রণ তৈরী হয়নি ৷ তাহলে কি করে তুমি সাধু হলে ? প্রকৃত সাধুর শুধু শরীর নয় –তার মনও নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে! সুন্দর সুন্দর খাদ্য আর বিশ্রামের সরঞ্জাম দেখে তুমি তোমার কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেললে – একবার ভাবলে না এটা অন্য কারো_এমনকি কোন রাজপুরুষেরও হতে পারে ! তাছাড়া বর্তমানে আমি তোমার গুরুস্থানীয়! আমি খেলাম কি না , কোথায় থাকলাম — তুমি তো এসব ব্যাপারে কোন খোঁজ নিলে না ?”
ঐ ব্যক্তি নিজের ভুল বুঝতে পারল এবং সাধুবাবার পা-দুটো জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকল। বলল – “বাবা ! আমি মহা ভুল করেছি ৷ ক্ষুধায় – ক্লান্তিতে আমি সাময়িকভাবে আত্মবিস্মৃত হয়েছিলাম । এমন ভুল আর আমার হবে না ৷” রাজামশাইও সব দেখে-শুনে ব্যাপারটা বুঝে সকলকেই ভিতরে নিয়ে গিয়ে দু-চার দিন থাকার ব্যাবস্থা করলেন ও সাধুসঙ্গ লাভে ধন্য হলেন ৷
গল্পটা এখানেই শেষ করে গুরু মহারাজ উপস্থিত জনেদের বললেন – তোমাদেরও বলছি কখনও “সেজো না”, অর্থাৎ যা নও তা হোতে চেয়ো না বা হোতে যেও না ৷ তুমি যা – তুমি তাই । অকারণে নিজেকে অন্যভাবে জাহির করতে গেলেই নানা বিপত্তি হবে — বিভ্রাট ঘটবে । এটা সত্যের অপলাপ । অসত্য আশ্রিত ব্যক্তি অচিরেই ধরা পড়ে যাবে – আর তখন সে শাস্তি পাবেই । স্থূল অর্থেও বটে, আবার আধ্যাত্মিক জগতেও এই একই নিয়ম প্রযোজ্য । সাজতে যেয়ো না _’সাজলেই সাজা পাবে’ ৷ তুমি যেমন – তুমি তেমনভাবেই লোকের সামনে নিজেকে উপস্থাপিত করো! কাক ময়ূরপুচ্ছ পিছনে লাগালে কি ময়ূর হয়ে ওঠে – কখনই হয় না! তেমনি আধ্যাত্মিক জগতেও যারা পূর্ণত্ব না অর্জন করে মানুষকে ঠিকপথে চালনা না করে ভ্রান্তি ঘটায় , ভুল করে – তাদের এমনটাই হয় । [ক্রমশঃ]