[এর আগে আমরা দেখেছিলাম যে একটি সামান্য গাধার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কিভাবে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নেতা-মন্ত্রীরাও নিজেরা সত্যতা যাচাই না করে, গুজবে কান দিয়ে সবাই আলাদা আলাদা খুড়ে মাথা কামিয়ে ফেলল! এবার রাজার পালা___সেখানে কি হয়! দ্যাখা যাক!]
…… রাজামশাই (সকলের মাথা ন্যাড়া দেখে) আর অগ্রসর না হয়ে, চট্ করে আবার পর্দার অন্তরালে চলে গেলেন _আর তাড়াতাড়ি মহামন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন ৷ “কি ব্যাপার মহামন্ত্রী ?”– রাজার জিজ্ঞাসা । মহামন্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলল – “রাজন! আজ আমাদের রাজ্যের বড় দুর্দিন ! এই রাজ্যের মহান , মান্যবর , গুণীবর , মহাজ্ঞানী , মহামানী ……….’গদর সিং গুজর গয়া”৷ রাজা তো কখনো গদর সিং -এর নামও শোনেনি – শোনার কথাও নয়! কিন্তু মহামন্ত্রী যেভাবে মহা – মহা বিশ্লেষণ দিল , তাতে গদর সিং -এর নাম না শোনাটা আহাম্মকি বলে মনে হোল! তাই রাজামশাই আর কথা না বাড়িয়ে আফশোষের সুরে বলে উঠলেন – “এ – হে – হে ! তাই নাকি ! তাহলে তো আজ বড় দুঃখের দিন – রাষ্ট্রীয় শোক মানাতে হবে! দাঁড়াও_আমি রাজসভায় গিয়েই এই ঘোষনাটা করে দিচ্ছি! তবে তার আগে রাজ-নাপিতের কাছে গিয়ে আমার মাথাটা মুড়িয়ে নিই ! তুমি রাজদরবারে সকলকে অপেক্ষা করতে বল — আমি এক্ষুনি আসছি।”
এই কথাগুলি বলে দিয়ে, মন্ত্রীকে ছেড়ে রাজামশাই রাজ-নাপিতকে ডেকে পাঠালেন ৷ তারপর মুকুট এবং রাজপোষাক খুলে , খালি গায়ে মাথা ন্যাড়া করার জন্য রাজামশাই প্রস্তুত হচ্ছেন – এমন সময় এই ব্যাপারটা মহারাণীর চোখে পড়ে গেল! তিনি উঠোনে নেমে এসে রাজার কুঞ্চিত ঘন চুল মুরিয়ে ফেলার জন্য নাপিতের উদ্যত ক্ষুর-কাঁচি দেখে চিৎকার করে বললেন__ “থামো !”
রাণীর চিৎকার শুনে ভয়ে-ভয়ে নাপিত ক্ষুরসহ হাত গুটিয়ে নিল ! রাজাও বিরক্তি মিশ্রিত বিস্ময়ে রাণীর দিকে তাকালেন ! রাণী বলে উঠলেন – ” রাজন ! কি ব্যাপার ? আপনার সাধের এবং সখের এতো সুন্দর চুল কেটে হঠাৎ ন্যাড়া হবার ইচ্ছা হ’ল কেন ?” রাজা তো আর সবার মত গুজবে মেতে Hypnotised অবস্থায় রয়েছে! তাই বলল – “জানো না ! গদর সিং গুজর গয়া !!” রাণী বিস্ময় প্রকাশ করে রাজাকে জিজ্ঞাসা করলেন – “কে গদর সিং ? সে কি আপনার পিতা, পিতামহ বা পিতৃব্য অথবা আপনার গুরুদেব বা গুরুস্থানীয় কেউ ? কারণ একমাত্র এই ধরণের কোন নিকট আত্মীয় মারা গেলেই মাথা ন্যাড়া করতে হয় – এটাই আমি জানি । সুতরাং গদর সিং নিশ্চয়ই এই ধরণের কেউ ?” রাজা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন – ” না – না গদর সিং আমার বাবা, কাকা বা নিকটাত্নীয় হতে যাবে কেন! ঐ নামে তো আমি কাউকে চিনি-ই না! তবে জানো রানী! মহামন্ত্রী যখন তার কথা এত করে বলছিল তখন নিশ্চয়ই সে এই রাজ্যের কোন Great Man হবে !”
রাজামশাই-এর মুখে এই ধরনের হাল্কা কথাবার্তা শুনে, রাণী রাজাকে ভৎর্সনা করে বললেন – ” ছিঃ – ছিঃ – রাজন ! আপনি এই দেশের রাজা , আর পাঁচজনের চিন্তাধারার সঙ্গে আপনার চিন্তার পার্থক্য থাকা উচিৎ ! অাপনি মহামন্ত্রীকে ডেকে পাঠিয়ে খোঁজ নিন – কে এই গদর সিং ??” রানীর কথায় রাজার সম্বিত ফিরল_
নাপিতকে ঠেলে ফেলে দিয়ে রাজা ঘন কুঞ্চিত চুলে হাত বোলাতে বোলাতে উঠে দাঁড়াল আর হুকুম দিল – “মহামন্ত্রী কো বুলাও !”
রাজার হুকুম পেয়েই মহামন্ত্রী তৎক্ষণাৎ এসে রাজা হাজির হোল! এবার রাজা রাজকীয় ভঙ্গিতে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন – “মন্ত্রী ! কে এই গদর সিং ?” মহামন্ত্রী কাঁচুমাচু মুখে উত্তর দিলেন – “মহারাজ ! সে তো আমি জানি না – ওটা সেনাপতি জানে ।”
” বুলাও সেনাপতি কো !” – রাজার আদেশ ৷ সেনাপতি এল, সেও বলল – “আমি তো জানিনা মহারাজ ! নগর কোটাল জানে ৷” ডাকা হোল নগর কোটালকে! নগর কোটাল ডেকে পাঠাল গঙ্গাতীরবর্ত্তী সেই স্থানের ব্যক্তিদের, যারা সকাল সকাল সেই দিন মাথা ন্যাড়া করে ফেলেছিল ৷ তারা আবার আরও কয়েকজনকে ডাকল, তারা আরও কয়েকজন……….এই করতে করতে পৌঁছে যাওয়া গেল আসল ব্যক্তির কাছে, যার নাম গব্বর সিং!
সমস্ত রাজ্যবাসীর চোখে এখন জব্বর ব্যক্তি এই গব্বর সিং! মহারাজের কাছে তাকে কেন ধরে নিয়ে আসা হচ্ছে সে কিছুই জানে না ৷ রাজার সামনে দাঁড়িয়ে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে মাথান্যাড়া গব্বর ! কারণ সে দেখল, সেখানে শুধু রাজামশাই ছাড়া বাকিরা অর্থাৎ মন্ত্রী, সেনাপতি, সান্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদ, সভাসদ, অমাত্যবর্গ সবারই মাথা ন্যাড়া –এই কান্ড দেখে তো গব্বরের চক্ষু ছানাবড়া ! রাজা জিজ্ঞাসা করলেন – “তুমি জানো গদর সিং কে ? যে মারা যাবার জন্য এরা সবাই মাথা ন্যাড়া করেছে ৷” গব্বর কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল – “হুজুর ! তিনি যদি রাজপরিবারের কেউ লোক হ’ন – তাহলে আমি জানি না – কিন্তু কাল রাত্রে যে মারা যাওয়ায় আমি আজ ভোরে গঙ্গার ধারে মাথা ন্যাড়া করেছিলাম – সে হোল আমার বাড়ির পোষা গাধা ! দীর্ঘকাল সে আমার সেবা করে আমার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করেছিল, সে আমার পুত্রবৎ ছিল – তাই তার শেষকৃত্য করে মস্তকমুন্ডন করেছিলাম৷”
সব কথা শুনে রাজা তো গব্বরের মুন্ডচ্ছেদের আদেশ দেয় আর কি ! রাণী এগিয়ে এসে রাজাকে বললেন – ” ছি – ছি – মহারাজ ! এই আপনার রাজধর্ম ! ছেড়ে দিন বেচারাকে, আর শাস্তি দিন আপনার এই অযোগ্য রাজকর্মী বা কর্মচারীদের ! আর অাপনি নিজেও সমান অপরাধী – তাই সবার আগে আপনি নিজেই নিজেকে শাস্তি দিন ৷”
গল্পটা এখানেই শেষ ৷ গুরু মহারাজ বললেন – বর্তমান পৃথিবীর তথাকথিত সভ্য শিক্ষিত মানুষদের বেশীর ভাগ যেন ঐ ন্যাড়ামাথা লোকের দলে! এর – ওর মুখে শুনে বা খবরের কাগজ পড়ে decision নেয়_ যাচাই করে না , বিচার করে না , সত্য অনুসন্ধানের কোন চেষ্টাই করে না!
সুতরাং সাধনা না থাকলে মানবজীবনের সকল achivement -ই ব্যর্থ হয়। যতক্ষণ না মানবের বিবেকের জাগরণ বা চেতনার উত্তরণ হচ্ছে ততক্ষণ মানুষের জীবনে সাম্যতা আসবে না_পূর্ণতাপ্রাপ্তি তো দূর-অস্ত ! পার্থিব জ্ঞান-বিদ্যা দিয়ে অর্থ-সম্পদ , বল-সামর্থ্য এমন কি বুদ্ধিবৃত্তিরও উন্নতি করা সম্ভব । কিন্তু ‘পার্থিব সম্পদ’ _পার্থিব চাহিদা মেটানোর কাজে বা পার্থিব ঘটনা পরম্পরার স্রোতে গা ভাসানোর কাজেই সব ব্যয় হয়ে যাবে! মৌলিক বা নতুন কিছু করা অথবা নতুন ভাবনা চিন্তা করা তার পক্ষে অার হয়ে উঠবে না!
আলোচ্য গল্পে অতিসাধারণ এক ধোবা থেকে শুরু করে গ্রামের অল্পশিক্ষিত, নগরের শিক্ষিত , ছোটখাটো রাজকর্মচারী , বড়সর রাজকর্মচারী থেকে রাজ্যের প্রধান সেনাপতি বা মহামন্ত্রী পর্যন্ত গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর লোক — শেষমেষ রাজ্যের রাজাও ঐ দলেই পড়ে গেল!
প্রথম বাধাটা কোথা থেকে এল ? – না রাণীর কাছ থেকে ৷ তিনিই প্রথম জিজ্ঞাসার অবতারনা করলেন ৷ এখান থেকেই শুরু । উপনিষদে রয়েছে -“অথাথ ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা ” ৷ ভারতীয় আধ্যাত্মজ্ঞানের মূলধারাটি-ই এসেছে জিজ্ঞাসা উত্তরের মাধ্যমে ৷ উপনিষদসমূহে , গীতায়, বিভিন্ন মহাপুরুষের বাণী সংকলনে – তোমরা এর প্রমাণ বা উদাহরণ পাবে । জিজ্ঞাসা কথাটির অর্থই হচ্ছে – জানার আকাঙ্খা বা ইচ্ছা । যেখানে জিজ্ঞাসা নাই বা জানার ইচ্ছা নাই – সেখানে ‘অকারণ জ্ঞানদান করা’ _শাস্ত্রে কঠোরভাবে নিষেধ রয়েছে ।
যাইহোক, এখানে রাণী যেন সদ্-গুরু! মোহগ্রস্থ, গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানো মানুষদের মনে প্রথম জিজ্ঞাসার সূচনা করে দেন সদ্-গুরু । “কোহহম্ _কিম্ ইতি”! “আমি কে, আমি কি, আমি কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি, কোথায় যাব ?” — ইত্যাদি ইত্যাদি!
এগুলিই প্রকৃত আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা! এর বাইরে যে জিজ্ঞাসা, তার উত্তরে গুরু তো জগৎজ্ঞান দান করেন — আর তাই দিয়ে লোকাকর্ষণ করেন ৷ কিন্তু প্রকৃত জিজ্ঞাসা – ব্রহ্মজিজ্ঞাসা বা আত্মজিজ্ঞাসা ৷ “কোহহম্ – কিম্ ইতি” _এই জিজ্ঞাসার উত্তর থেকেই উপনিষদের চারটি মহাবাক্য নিস্পন্ন হয়েছে ৷ “অয়মাত্মা ব্রহ্ম , প্রজ্ঞানম্ ব্রহ্ম , তত্ত্বমসি , অহম্ ব্রহ্মাস্মি ” ।
এই গল্পে রাণীই প্রথম গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়া মানুষ -জনকে আটকালো । প্রথম একজন কেউ বলল – “থামো”!!
‘থামা’ বা ‘স্থির হওয়া’ আগে প্রয়োজন! কেন্দ্র স্থির না হলে যেমন বৃত্ত আঁকা সম্ভব নয় _তেমনি প্রান স্থির, চিত্ত স্থির না হলে সাধন হয় না। স্থির হবার পর শুরু হয় বিচার! সদাসদ্ বিচার , নিত্যা-নিত্য বিচার , পরা-অপরা বিচার ইত্যাদি! জ্ঞানমার্গীরা নেতি নেতি করতে করতে প্রকৃত সত্যে বা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান! যোগমার্গীরা সঠিক লক্ষ্য স্থির করে যোগের গভীরতায় আত্মমগ্ন হয়ে যান! ভক্তিমার্গীরা সব ছেড়ে ইষ্টে তন-মন-প্রাণ সঁপে দেন , আর কর্মযোগীরা কোনোদিকে দৃকপাত না করে ভগবৎপ্রীতার্থে কর্মে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করে দেন!
কিন্তু এ তো গেল অসাধারণদের কথা, সাধারণ মানুষ ঐ ন্যাড়ামাথাদের দলে! ধনী-নির্ধন, উচ্চ-নীচ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলতে ভালোবাসে! নিজে থেকে এরা কেউ জিজ্ঞাসা তোলে না বা তুলতে চায় না — প্রতিবাদ করা অথবা প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েই ওঠে না !
আর এদের জন্য-ই মহাত্মা-মহাপুরুষরা শরীর গ্রহণ করেন! মানুষের সমাজে জন্ম গ্রহণ করে – আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের ন্যায় শৈশব-কৈশোর অতিক্রম করেন! পিতা-মাতা বা অগ্রগণ্যদের শাসন-বারন সহ্য করেন! তারপর উপযুক্ত সময়ে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন!
তখন তিনি তাঁর চারপাশের মানুষদের গড্ডালিকা প্রবাহ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন ৷ অনেকে মুক্ত হতে পারে — অনেকে হয়তো পারেও না! তাতে কি ? ভগবানের বিরক্তি নাই – বিরাম নাই! আবার নব নব রূপে, নব নব সাজে, নব নব স্থানে শরীর নেন তিনি – আবার ঐ একই কাজ করতে থাকেন!”
এসব কথা বলার পর গুরু মহারাজ শেষে বললেন – “সে হিসাবে তোমরা আমাকেও ‘ঝাড়ুদার’ বলতে পারো — শুধু ময়লাই সাফ করে চলেছি, তোমাদের মনের ময়লা ৷” (ক্রমশঃ)
…… রাজামশাই (সকলের মাথা ন্যাড়া দেখে) আর অগ্রসর না হয়ে, চট্ করে আবার পর্দার অন্তরালে চলে গেলেন _আর তাড়াতাড়ি মহামন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন ৷ “কি ব্যাপার মহামন্ত্রী ?”– রাজার জিজ্ঞাসা । মহামন্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলল – “রাজন! আজ আমাদের রাজ্যের বড় দুর্দিন ! এই রাজ্যের মহান , মান্যবর , গুণীবর , মহাজ্ঞানী , মহামানী ……….’গদর সিং গুজর গয়া”৷ রাজা তো কখনো গদর সিং -এর নামও শোনেনি – শোনার কথাও নয়! কিন্তু মহামন্ত্রী যেভাবে মহা – মহা বিশ্লেষণ দিল , তাতে গদর সিং -এর নাম না শোনাটা আহাম্মকি বলে মনে হোল! তাই রাজামশাই আর কথা না বাড়িয়ে আফশোষের সুরে বলে উঠলেন – “এ – হে – হে ! তাই নাকি ! তাহলে তো আজ বড় দুঃখের দিন – রাষ্ট্রীয় শোক মানাতে হবে! দাঁড়াও_আমি রাজসভায় গিয়েই এই ঘোষনাটা করে দিচ্ছি! তবে তার আগে রাজ-নাপিতের কাছে গিয়ে আমার মাথাটা মুড়িয়ে নিই ! তুমি রাজদরবারে সকলকে অপেক্ষা করতে বল — আমি এক্ষুনি আসছি।”
এই কথাগুলি বলে দিয়ে, মন্ত্রীকে ছেড়ে রাজামশাই রাজ-নাপিতকে ডেকে পাঠালেন ৷ তারপর মুকুট এবং রাজপোষাক খুলে , খালি গায়ে মাথা ন্যাড়া করার জন্য রাজামশাই প্রস্তুত হচ্ছেন – এমন সময় এই ব্যাপারটা মহারাণীর চোখে পড়ে গেল! তিনি উঠোনে নেমে এসে রাজার কুঞ্চিত ঘন চুল মুরিয়ে ফেলার জন্য নাপিতের উদ্যত ক্ষুর-কাঁচি দেখে চিৎকার করে বললেন__ “থামো !”
রাণীর চিৎকার শুনে ভয়ে-ভয়ে নাপিত ক্ষুরসহ হাত গুটিয়ে নিল ! রাজাও বিরক্তি মিশ্রিত বিস্ময়ে রাণীর দিকে তাকালেন ! রাণী বলে উঠলেন – ” রাজন ! কি ব্যাপার ? আপনার সাধের এবং সখের এতো সুন্দর চুল কেটে হঠাৎ ন্যাড়া হবার ইচ্ছা হ’ল কেন ?” রাজা তো আর সবার মত গুজবে মেতে Hypnotised অবস্থায় রয়েছে! তাই বলল – “জানো না ! গদর সিং গুজর গয়া !!” রাণী বিস্ময় প্রকাশ করে রাজাকে জিজ্ঞাসা করলেন – “কে গদর সিং ? সে কি আপনার পিতা, পিতামহ বা পিতৃব্য অথবা আপনার গুরুদেব বা গুরুস্থানীয় কেউ ? কারণ একমাত্র এই ধরণের কোন নিকট আত্মীয় মারা গেলেই মাথা ন্যাড়া করতে হয় – এটাই আমি জানি । সুতরাং গদর সিং নিশ্চয়ই এই ধরণের কেউ ?” রাজা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন – ” না – না গদর সিং আমার বাবা, কাকা বা নিকটাত্নীয় হতে যাবে কেন! ঐ নামে তো আমি কাউকে চিনি-ই না! তবে জানো রানী! মহামন্ত্রী যখন তার কথা এত করে বলছিল তখন নিশ্চয়ই সে এই রাজ্যের কোন Great Man হবে !”
রাজামশাই-এর মুখে এই ধরনের হাল্কা কথাবার্তা শুনে, রাণী রাজাকে ভৎর্সনা করে বললেন – ” ছিঃ – ছিঃ – রাজন ! আপনি এই দেশের রাজা , আর পাঁচজনের চিন্তাধারার সঙ্গে আপনার চিন্তার পার্থক্য থাকা উচিৎ ! অাপনি মহামন্ত্রীকে ডেকে পাঠিয়ে খোঁজ নিন – কে এই গদর সিং ??” রানীর কথায় রাজার সম্বিত ফিরল_
নাপিতকে ঠেলে ফেলে দিয়ে রাজা ঘন কুঞ্চিত চুলে হাত বোলাতে বোলাতে উঠে দাঁড়াল আর হুকুম দিল – “মহামন্ত্রী কো বুলাও !”
রাজার হুকুম পেয়েই মহামন্ত্রী তৎক্ষণাৎ এসে রাজা হাজির হোল! এবার রাজা রাজকীয় ভঙ্গিতে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন – “মন্ত্রী ! কে এই গদর সিং ?” মহামন্ত্রী কাঁচুমাচু মুখে উত্তর দিলেন – “মহারাজ ! সে তো আমি জানি না – ওটা সেনাপতি জানে ।”
” বুলাও সেনাপতি কো !” – রাজার আদেশ ৷ সেনাপতি এল, সেও বলল – “আমি তো জানিনা মহারাজ ! নগর কোটাল জানে ৷” ডাকা হোল নগর কোটালকে! নগর কোটাল ডেকে পাঠাল গঙ্গাতীরবর্ত্তী সেই স্থানের ব্যক্তিদের, যারা সকাল সকাল সেই দিন মাথা ন্যাড়া করে ফেলেছিল ৷ তারা আবার আরও কয়েকজনকে ডাকল, তারা আরও কয়েকজন……….এই করতে করতে পৌঁছে যাওয়া গেল আসল ব্যক্তির কাছে, যার নাম গব্বর সিং!
সমস্ত রাজ্যবাসীর চোখে এখন জব্বর ব্যক্তি এই গব্বর সিং! মহারাজের কাছে তাকে কেন ধরে নিয়ে আসা হচ্ছে সে কিছুই জানে না ৷ রাজার সামনে দাঁড়িয়ে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে মাথান্যাড়া গব্বর ! কারণ সে দেখল, সেখানে শুধু রাজামশাই ছাড়া বাকিরা অর্থাৎ মন্ত্রী, সেনাপতি, সান্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদ, সভাসদ, অমাত্যবর্গ সবারই মাথা ন্যাড়া –এই কান্ড দেখে তো গব্বরের চক্ষু ছানাবড়া ! রাজা জিজ্ঞাসা করলেন – “তুমি জানো গদর সিং কে ? যে মারা যাবার জন্য এরা সবাই মাথা ন্যাড়া করেছে ৷” গব্বর কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল – “হুজুর ! তিনি যদি রাজপরিবারের কেউ লোক হ’ন – তাহলে আমি জানি না – কিন্তু কাল রাত্রে যে মারা যাওয়ায় আমি আজ ভোরে গঙ্গার ধারে মাথা ন্যাড়া করেছিলাম – সে হোল আমার বাড়ির পোষা গাধা ! দীর্ঘকাল সে আমার সেবা করে আমার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করেছিল, সে আমার পুত্রবৎ ছিল – তাই তার শেষকৃত্য করে মস্তকমুন্ডন করেছিলাম৷”
সব কথা শুনে রাজা তো গব্বরের মুন্ডচ্ছেদের আদেশ দেয় আর কি ! রাণী এগিয়ে এসে রাজাকে বললেন – ” ছি – ছি – মহারাজ ! এই আপনার রাজধর্ম ! ছেড়ে দিন বেচারাকে, আর শাস্তি দিন আপনার এই অযোগ্য রাজকর্মী বা কর্মচারীদের ! আর অাপনি নিজেও সমান অপরাধী – তাই সবার আগে আপনি নিজেই নিজেকে শাস্তি দিন ৷”
গল্পটা এখানেই শেষ ৷ গুরু মহারাজ বললেন – বর্তমান পৃথিবীর তথাকথিত সভ্য শিক্ষিত মানুষদের বেশীর ভাগ যেন ঐ ন্যাড়ামাথা লোকের দলে! এর – ওর মুখে শুনে বা খবরের কাগজ পড়ে decision নেয়_ যাচাই করে না , বিচার করে না , সত্য অনুসন্ধানের কোন চেষ্টাই করে না!
সুতরাং সাধনা না থাকলে মানবজীবনের সকল achivement -ই ব্যর্থ হয়। যতক্ষণ না মানবের বিবেকের জাগরণ বা চেতনার উত্তরণ হচ্ছে ততক্ষণ মানুষের জীবনে সাম্যতা আসবে না_পূর্ণতাপ্রাপ্তি তো দূর-অস্ত ! পার্থিব জ্ঞান-বিদ্যা দিয়ে অর্থ-সম্পদ , বল-সামর্থ্য এমন কি বুদ্ধিবৃত্তিরও উন্নতি করা সম্ভব । কিন্তু ‘পার্থিব সম্পদ’ _পার্থিব চাহিদা মেটানোর কাজে বা পার্থিব ঘটনা পরম্পরার স্রোতে গা ভাসানোর কাজেই সব ব্যয় হয়ে যাবে! মৌলিক বা নতুন কিছু করা অথবা নতুন ভাবনা চিন্তা করা তার পক্ষে অার হয়ে উঠবে না!
আলোচ্য গল্পে অতিসাধারণ এক ধোবা থেকে শুরু করে গ্রামের অল্পশিক্ষিত, নগরের শিক্ষিত , ছোটখাটো রাজকর্মচারী , বড়সর রাজকর্মচারী থেকে রাজ্যের প্রধান সেনাপতি বা মহামন্ত্রী পর্যন্ত গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর লোক — শেষমেষ রাজ্যের রাজাও ঐ দলেই পড়ে গেল!
প্রথম বাধাটা কোথা থেকে এল ? – না রাণীর কাছ থেকে ৷ তিনিই প্রথম জিজ্ঞাসার অবতারনা করলেন ৷ এখান থেকেই শুরু । উপনিষদে রয়েছে -“অথাথ ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা ” ৷ ভারতীয় আধ্যাত্মজ্ঞানের মূলধারাটি-ই এসেছে জিজ্ঞাসা উত্তরের মাধ্যমে ৷ উপনিষদসমূহে , গীতায়, বিভিন্ন মহাপুরুষের বাণী সংকলনে – তোমরা এর প্রমাণ বা উদাহরণ পাবে । জিজ্ঞাসা কথাটির অর্থই হচ্ছে – জানার আকাঙ্খা বা ইচ্ছা । যেখানে জিজ্ঞাসা নাই বা জানার ইচ্ছা নাই – সেখানে ‘অকারণ জ্ঞানদান করা’ _শাস্ত্রে কঠোরভাবে নিষেধ রয়েছে ।
যাইহোক, এখানে রাণী যেন সদ্-গুরু! মোহগ্রস্থ, গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানো মানুষদের মনে প্রথম জিজ্ঞাসার সূচনা করে দেন সদ্-গুরু । “কোহহম্ _কিম্ ইতি”! “আমি কে, আমি কি, আমি কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি, কোথায় যাব ?” — ইত্যাদি ইত্যাদি!
এগুলিই প্রকৃত আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা! এর বাইরে যে জিজ্ঞাসা, তার উত্তরে গুরু তো জগৎজ্ঞান দান করেন — আর তাই দিয়ে লোকাকর্ষণ করেন ৷ কিন্তু প্রকৃত জিজ্ঞাসা – ব্রহ্মজিজ্ঞাসা বা আত্মজিজ্ঞাসা ৷ “কোহহম্ – কিম্ ইতি” _এই জিজ্ঞাসার উত্তর থেকেই উপনিষদের চারটি মহাবাক্য নিস্পন্ন হয়েছে ৷ “অয়মাত্মা ব্রহ্ম , প্রজ্ঞানম্ ব্রহ্ম , তত্ত্বমসি , অহম্ ব্রহ্মাস্মি ” ।
এই গল্পে রাণীই প্রথম গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়া মানুষ -জনকে আটকালো । প্রথম একজন কেউ বলল – “থামো”!!
‘থামা’ বা ‘স্থির হওয়া’ আগে প্রয়োজন! কেন্দ্র স্থির না হলে যেমন বৃত্ত আঁকা সম্ভব নয় _তেমনি প্রান স্থির, চিত্ত স্থির না হলে সাধন হয় না। স্থির হবার পর শুরু হয় বিচার! সদাসদ্ বিচার , নিত্যা-নিত্য বিচার , পরা-অপরা বিচার ইত্যাদি! জ্ঞানমার্গীরা নেতি নেতি করতে করতে প্রকৃত সত্যে বা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান! যোগমার্গীরা সঠিক লক্ষ্য স্থির করে যোগের গভীরতায় আত্মমগ্ন হয়ে যান! ভক্তিমার্গীরা সব ছেড়ে ইষ্টে তন-মন-প্রাণ সঁপে দেন , আর কর্মযোগীরা কোনোদিকে দৃকপাত না করে ভগবৎপ্রীতার্থে কর্মে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করে দেন!
কিন্তু এ তো গেল অসাধারণদের কথা, সাধারণ মানুষ ঐ ন্যাড়ামাথাদের দলে! ধনী-নির্ধন, উচ্চ-নীচ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলতে ভালোবাসে! নিজে থেকে এরা কেউ জিজ্ঞাসা তোলে না বা তুলতে চায় না — প্রতিবাদ করা অথবা প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েই ওঠে না !
আর এদের জন্য-ই মহাত্মা-মহাপুরুষরা শরীর গ্রহণ করেন! মানুষের সমাজে জন্ম গ্রহণ করে – আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের ন্যায় শৈশব-কৈশোর অতিক্রম করেন! পিতা-মাতা বা অগ্রগণ্যদের শাসন-বারন সহ্য করেন! তারপর উপযুক্ত সময়ে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন!
তখন তিনি তাঁর চারপাশের মানুষদের গড্ডালিকা প্রবাহ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন ৷ অনেকে মুক্ত হতে পারে — অনেকে হয়তো পারেও না! তাতে কি ? ভগবানের বিরক্তি নাই – বিরাম নাই! আবার নব নব রূপে, নব নব সাজে, নব নব স্থানে শরীর নেন তিনি – আবার ঐ একই কাজ করতে থাকেন!”
এসব কথা বলার পর গুরু মহারাজ শেষে বললেন – “সে হিসাবে তোমরা আমাকেও ‘ঝাড়ুদার’ বলতে পারো — শুধু ময়লাই সাফ করে চলেছি, তোমাদের মনের ময়লা ৷” (ক্রমশঃ)