ভগবান বুদ্ধ বেশীরভাগ সময় তাঁর প্রিয় শিষ্যদের নিয়ে বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করে বেড়াতেন ৷ “যেখানে রাত সেখানেই কাত”– অর্থাৎ যেখানে দিন শেষ হ`ত সেই স্থানে কোন না কোন বৃক্ষতলে বিশ্রাম নিতেন ।আর বর্ষাকালের ২/৩ মাস, বুদ্ধদেব কোন রাজা বা ধনী শ্রেষ্ঠীর বাগান-বাড়িতে কাটিয়ে দিতেন! এই সময় শিষ্য ভক্তরা ওনার সাথে সেখানেই দেখা করতে আসত। এটাকে বলা হত বর্ষাবাস ।
যাইহোক, এমনি কোন সময় যখন ভগবান কোন স্থানে কয়েকদিন অবস্থানরত, সেই সময় তাঁর অন্যতম প্রিয় ভক্ত বা শিষ্য ‘পূর্ণ’ – ভগবান বুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলেন – “প্রভু জগতে প্রায় সকল মানুষেরই দুঃখ রয়েছে, অশান্তি রয়েছে, নানান জ্বালা-যন্ত্রণায় সদাসর্বদা ভুগে মরছে মানুষ । এর হাত থেকে যেন প্রায় কারোর নিস্তার নাই ! হে প্রভু ! জগৎময় এই যে দুঃখ – এর কারণ কি ?” ভগবান বুদ্ধ তাঁর প্রিয় শিষ্য পূর্ণের মুখ থেকে এই জিজ্ঞাসা শুনে খুবই আনন্দিত হলেন — তারপর স্মিত হেসে উত্তর দিলেন – “পূর্ণ ! এর উত্তর তোমাকেই খুঁজে বের করতে হবে ৷ যাও নগরের প্রান্তে প্রান্তে ঘুরে, ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে যোগাযোগ করো — তারপর সকলের সাথে কথা বলে নির্ণয় করো যে দুঃখের প্রকৃত কারণ কি ? আর উত্তর পেলে অবশ্যই আমাকে জানাবে – আমি আকুল হয়ে তোমার প্রত্যাবর্ত্তনের দিকে চেয়ে থাকবো ৷”
পরদিন অতি প্রত্যুষে ‘পূর্ণ’-ভগবানের আদেশে ‘দুঃখের কারণ’ নির্ণয়ে বেড়িয়ে পড়ল ৷ নগরের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে কত মানুষের সাথে তার দেখা হোল – তার ইয়ত্তা নেই ৷ সকলেই বড্ড বেশী ব্যস্ত, যেন কাজ তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে – দু-দন্ড দাঁড়াবার, কথা বলার সময় পর্যন্ত নেই! পূর্ণ তাদের বিরক্ত না করে এগিয়ে চলল সামনের দিকে ৷ কিছুটা আগাতেই রাস্তার উপরেই একটা মন্দির পড়ল । সেখানে চোখ যেতেই পূর্ণ দেখল — এক দম্পতি হাপুস নয়নে দেবতার সামনে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আর কি যেন প্রার্থনা করছে ৷ পূর্ণ সেখানে দাঁড়াল, অপেক্ষা করতে লাগল কতক্ষণে ঐ দম্পতির পূজা বা প্রার্থনা শেষ হয় ৷
সেই দম্পতি যখন মন্দির থেকে বেড়িয়ে এল, দেখল সামনেই মুন্ডিতমস্তক এক বৌদ্ধ শ্রমণ(পূর্ণ) দাঁড়িয়ে রয়েছে ৷ তারা ওনাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করল । আশীর্বাদান্তে পূর্ণ তাদের জিজ্ঞাসা করল – তারা দেবতার কাছে কাঁদছিল কেন, কি তাদের দুঃখের কারণ ? তারা উত্তর দিল যে, _তাদের বিষয়-সম্পত্তি বা টাকা-কড়ি, বাড়ি -ঘর এসব কোন কিছুরই অভাব নেই কিন্তু তাদের একটাই দুঃখ যে __ তাদের কোন সন্তানাদি নাই । বিষয়-আশয়, বাড়ীঘর এসব কেই বা দেখবে — কেই বা ভোগ করবে ? তাছাড়া লোকে তাদের “আঁটকুড়ো”, “বাঁঝা” ইত্যাদি বলে , সকালে উঠে ওদের মুখ দেখা খারাপ বলে — এগুলি তাদেরকে এতটাই আঘাত দেয় যে,তাদের আর বেঁচে থাকতেই ইচ্ছা করে না – এই ধরনের নানা কথা বলতে লাগলো!
পূর্ণ সব শুনে সিদ্ধান্ত করল — “ওঃ_আচ্ছা !! তাহলে সন্তানহীনতাই দুঃখের কারণ ৷”
আনন্দিত মনে পূর্ণ ভগবান বুদ্ধকে খবর দেবার জন্য দ্রুত পদে এগিয়ে চলেছে — হঠাৎ তার কানে গেল তীব্র চিৎকার – “বাবারে — এই গন্ডাখানেক ছেলেপিলেদের জন্য জ্বলে-পুড়ে মরে গেলুম ! আর আমার বাঁচার সাধ নেই !” কৌতুহলী পূর্ণ সেদিকে ঘুরে দেখল যে নিম্নবিত্ত পরিবারের একটি লোক মাটির ঘরের দাওয়ায় খেতে বসেছে, আর অনেকগুলি ছোট বড় ছেলে-মেয়ে কেউ তার কোলে, কেউ কাঁধে চেপে বসে আছে আর কেউ পাশে বসে তার খাবার তুলে তুলে খাচ্ছে! এই অত্যাচার সইতে না পেরে লোকটা পরিত্রাহি চিৎকার করছে – কিন্তু ছেলেরা ভয় না পেয়ে বেশ মজা পাচ্ছে এবং বেশী করে ঐ একইরকম ভাবে লোকটির বিরক্তি উৎপাদন করে যাচ্ছে!
পূর্ণ লোকটির খাবার ছেড়ে উঠে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকল, কারণ সে দেখল যে এই লোকটিরও দুঃখ রয়েছে ৷ অতএব তাকে জানতে হবে যে_ এর দুঃখের কারণ কি ? লোকটি বাইরে আসতেই পূর্ণ শান্ত কন্ঠে তাকে জিজ্ঞাসা করল – “ভদ্র ! আপনি এতক্ষণ খুবই অশান্ত কন্ঠে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করছিলেন – তাও খাদ্য গ্রহণের সময় – যে সময় কথা বলা বা চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করাটাই অনুচিত! কি এমন দুঃখ আপনার_ যে আপনি এইরূপ আচরণ করতে বাধ্য হচ্ছিলেন ??”
একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর মুখে এই ধরণের কথা শুনে লোকটি আবার চিৎকার করেই উত্তর দিল – “মশাই অাপনি সাধু-সন্নাসী মানুষ, আপনি কি বুঝবেন সংসারের জ্বালা ! আমার সমস্ত দুঃখ অশান্তির মূলে ঐ একগাদা ছেলে-মেয়ে ! শুয়োরের পালের মতো পিল্-পিল্ করছে দেখলেন ? ছেলে-পিলে আবার মানুষের হয় মশাই ? সারাদিন খেটে-খুটে এসে বাড়ীতে দু-দন্ড বিশ্রাম নেব _কি সুস্থ হয়ে দুটো খাবার খাবো – তার জো টি নেই! কোথা থেকে সব শুয়োরের পাল ছুটে এসে কোলে-কাঁধে চড়ে বসবে, খাবার কেড়ে কেড়ে খেয়ে নেবে – রোজদিন এই কি ভালো লাগে মশাই ? ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি যেন ছেলে-পিলে কারও না হয় ৷ এর থেকে আঁটকুড়ো-বাঁঝা হওয়া ঢের ভালো — ঢের সুখের !”
পূর্ণ মুষড়ে পড়ল ৷ সে যেতে যেতে ভাবতে থাকল – তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল __ সন্তানহীনতা দুঃখের কারণ_ আবার সন্তান থাকাটাও দুঃখের কারণ!!! তাহলে! সিদ্ধান্ত তো হোল না – তাই তার আবার যাত্রা হোল শুরু ।
রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে তরুণ শ্রমণ পূর্ণ নগরের এক প্রান্তে এসে পৌঁছাল ৷ সেখানে সার-সার কুঁড়েঘর – গরীব মানুষের বাস ! সেগুলির পাশ দিয়ে যাবার সময় পূর্ণর কানে এল এক দম্পতির কান্নার শব্দ এবং ঈশ্বরকে গালাগালি দেবার আওয়াজ! পূর্ণ সেখানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল – “এই যে ভাই ! আপনারা কান্নাকাটি করছেন, সেটা ঠিক আছে কিন্তু ঈশ্বরের প্রতি দোষারোপ করেছেন — কেন ? কি এমন দুঃখ আপনাদের ?”
ওরা কাঁদতে কাঁদতে বলল – “মহাশয় ! দেখুন___দেখুন _আমার ঘরের অবস্থা ! কোন রকমে বেড়া দিয়ে তার উপর কাদা লেপে দেওয়াল দিয়েছিলাম, আর মাথায় ঘাস-পাতার ছাউনি । এখন বর্ষাকাল – মাঝে মাঝেই প্রবল বর্ষণ হচ্ছে, তাতে আমার কুঁড়েঘরের দেওয়াল গলে গেছে আর ছাউনির ঘাসপাতা পচে গেছে! ঘরের সব জায়গায় বৃষ্টির জল পড়ে বাক্স-বিছানা সব ভিজে গেছে ৷ ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রাত্রে একটু বিশ্রাম নেব — তারও উপায় নেই! আমরা দুঃস্থ গরীব মানুষ – তাই ভালো ঘর বা একটা ভালো আশ্রয় বানাতে পারি নাই । ঘরের অভাবে আমাদের বড় দুঃখ – সাধুবাবা ! স্বামী – স্ত্রী, দু-জনা খেটেখুটে খাবার ঠিক জুটে যায় ৷ কিন্তু যদি একটা ভালো ঘর বানাতে পারতাম — তাহলে আমাদের আর কোন দুঃখ থাকত না ।”
আনন্দ সব শুনলেন আর ভাবলেন যে, যাইহোক তাহলে দুঃখের জুতসই একটা কারণ পাওয়া গেল _’ঘর না থাকাই দুঃখের কারণ’! খুশী মনে আনন্দ ফিরে যেতে থাকল বুদ্ধের কাছে! যেতে যেতে সে একটা বড় প্রাসাদোপম অট্টালিকার কাছে এসে দাঁড়াল – কত বড় বাড়ী ! আর কত বিচিত্র তার বাহার ! চারিদিকে রেলিং দিয়ে ঘেরা বাগান –তাতে কত ফুল বা ফলের গাছ, ভিতরে ছোট্ট জলাশয়, তাতে ঝরণা বসানো আবার তাতে দু-চারটি পদ্ম ফুটে রয়েছে!
এসব দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল পূর্ণর ৷ হঠাৎ তার চোখে পড়ল দূরে বাগানের প্রান্তে একটা পাথরের বেঞ্চে মাথায় হাত দিয়ে ম্লান মুখে বসে আছে এক বৃদ্ধ! থেকে থেকে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে এবং মাঝে মাঝে উপরের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরকে দোষারোপ করছে ৷ তাকে দেখে মনে হ’ল ভদ্রলোক ঐ বিশাল বাড়ীটির মালিক হতে পারে — কিন্তু কি এর দুঃখ ? পূর্ণ এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধকে সম্বোধন করে বলল – “মহাশয় ! আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুবই চিন্তিত বা দুঃখিত ৷ কিন্তু কি আপনার দুঃখ ?” [ক্রমশঃ]
যাইহোক, এমনি কোন সময় যখন ভগবান কোন স্থানে কয়েকদিন অবস্থানরত, সেই সময় তাঁর অন্যতম প্রিয় ভক্ত বা শিষ্য ‘পূর্ণ’ – ভগবান বুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলেন – “প্রভু জগতে প্রায় সকল মানুষেরই দুঃখ রয়েছে, অশান্তি রয়েছে, নানান জ্বালা-যন্ত্রণায় সদাসর্বদা ভুগে মরছে মানুষ । এর হাত থেকে যেন প্রায় কারোর নিস্তার নাই ! হে প্রভু ! জগৎময় এই যে দুঃখ – এর কারণ কি ?” ভগবান বুদ্ধ তাঁর প্রিয় শিষ্য পূর্ণের মুখ থেকে এই জিজ্ঞাসা শুনে খুবই আনন্দিত হলেন — তারপর স্মিত হেসে উত্তর দিলেন – “পূর্ণ ! এর উত্তর তোমাকেই খুঁজে বের করতে হবে ৷ যাও নগরের প্রান্তে প্রান্তে ঘুরে, ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে যোগাযোগ করো — তারপর সকলের সাথে কথা বলে নির্ণয় করো যে দুঃখের প্রকৃত কারণ কি ? আর উত্তর পেলে অবশ্যই আমাকে জানাবে – আমি আকুল হয়ে তোমার প্রত্যাবর্ত্তনের দিকে চেয়ে থাকবো ৷”
পরদিন অতি প্রত্যুষে ‘পূর্ণ’-ভগবানের আদেশে ‘দুঃখের কারণ’ নির্ণয়ে বেড়িয়ে পড়ল ৷ নগরের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে কত মানুষের সাথে তার দেখা হোল – তার ইয়ত্তা নেই ৷ সকলেই বড্ড বেশী ব্যস্ত, যেন কাজ তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে – দু-দন্ড দাঁড়াবার, কথা বলার সময় পর্যন্ত নেই! পূর্ণ তাদের বিরক্ত না করে এগিয়ে চলল সামনের দিকে ৷ কিছুটা আগাতেই রাস্তার উপরেই একটা মন্দির পড়ল । সেখানে চোখ যেতেই পূর্ণ দেখল — এক দম্পতি হাপুস নয়নে দেবতার সামনে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আর কি যেন প্রার্থনা করছে ৷ পূর্ণ সেখানে দাঁড়াল, অপেক্ষা করতে লাগল কতক্ষণে ঐ দম্পতির পূজা বা প্রার্থনা শেষ হয় ৷
সেই দম্পতি যখন মন্দির থেকে বেড়িয়ে এল, দেখল সামনেই মুন্ডিতমস্তক এক বৌদ্ধ শ্রমণ(পূর্ণ) দাঁড়িয়ে রয়েছে ৷ তারা ওনাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করল । আশীর্বাদান্তে পূর্ণ তাদের জিজ্ঞাসা করল – তারা দেবতার কাছে কাঁদছিল কেন, কি তাদের দুঃখের কারণ ? তারা উত্তর দিল যে, _তাদের বিষয়-সম্পত্তি বা টাকা-কড়ি, বাড়ি -ঘর এসব কোন কিছুরই অভাব নেই কিন্তু তাদের একটাই দুঃখ যে __ তাদের কোন সন্তানাদি নাই । বিষয়-আশয়, বাড়ীঘর এসব কেই বা দেখবে — কেই বা ভোগ করবে ? তাছাড়া লোকে তাদের “আঁটকুড়ো”, “বাঁঝা” ইত্যাদি বলে , সকালে উঠে ওদের মুখ দেখা খারাপ বলে — এগুলি তাদেরকে এতটাই আঘাত দেয় যে,তাদের আর বেঁচে থাকতেই ইচ্ছা করে না – এই ধরনের নানা কথা বলতে লাগলো!
পূর্ণ সব শুনে সিদ্ধান্ত করল — “ওঃ_আচ্ছা !! তাহলে সন্তানহীনতাই দুঃখের কারণ ৷”
আনন্দিত মনে পূর্ণ ভগবান বুদ্ধকে খবর দেবার জন্য দ্রুত পদে এগিয়ে চলেছে — হঠাৎ তার কানে গেল তীব্র চিৎকার – “বাবারে — এই গন্ডাখানেক ছেলেপিলেদের জন্য জ্বলে-পুড়ে মরে গেলুম ! আর আমার বাঁচার সাধ নেই !” কৌতুহলী পূর্ণ সেদিকে ঘুরে দেখল যে নিম্নবিত্ত পরিবারের একটি লোক মাটির ঘরের দাওয়ায় খেতে বসেছে, আর অনেকগুলি ছোট বড় ছেলে-মেয়ে কেউ তার কোলে, কেউ কাঁধে চেপে বসে আছে আর কেউ পাশে বসে তার খাবার তুলে তুলে খাচ্ছে! এই অত্যাচার সইতে না পেরে লোকটা পরিত্রাহি চিৎকার করছে – কিন্তু ছেলেরা ভয় না পেয়ে বেশ মজা পাচ্ছে এবং বেশী করে ঐ একইরকম ভাবে লোকটির বিরক্তি উৎপাদন করে যাচ্ছে!
পূর্ণ লোকটির খাবার ছেড়ে উঠে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকল, কারণ সে দেখল যে এই লোকটিরও দুঃখ রয়েছে ৷ অতএব তাকে জানতে হবে যে_ এর দুঃখের কারণ কি ? লোকটি বাইরে আসতেই পূর্ণ শান্ত কন্ঠে তাকে জিজ্ঞাসা করল – “ভদ্র ! আপনি এতক্ষণ খুবই অশান্ত কন্ঠে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করছিলেন – তাও খাদ্য গ্রহণের সময় – যে সময় কথা বলা বা চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করাটাই অনুচিত! কি এমন দুঃখ আপনার_ যে আপনি এইরূপ আচরণ করতে বাধ্য হচ্ছিলেন ??”
একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর মুখে এই ধরণের কথা শুনে লোকটি আবার চিৎকার করেই উত্তর দিল – “মশাই অাপনি সাধু-সন্নাসী মানুষ, আপনি কি বুঝবেন সংসারের জ্বালা ! আমার সমস্ত দুঃখ অশান্তির মূলে ঐ একগাদা ছেলে-মেয়ে ! শুয়োরের পালের মতো পিল্-পিল্ করছে দেখলেন ? ছেলে-পিলে আবার মানুষের হয় মশাই ? সারাদিন খেটে-খুটে এসে বাড়ীতে দু-দন্ড বিশ্রাম নেব _কি সুস্থ হয়ে দুটো খাবার খাবো – তার জো টি নেই! কোথা থেকে সব শুয়োরের পাল ছুটে এসে কোলে-কাঁধে চড়ে বসবে, খাবার কেড়ে কেড়ে খেয়ে নেবে – রোজদিন এই কি ভালো লাগে মশাই ? ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি যেন ছেলে-পিলে কারও না হয় ৷ এর থেকে আঁটকুড়ো-বাঁঝা হওয়া ঢের ভালো — ঢের সুখের !”
পূর্ণ মুষড়ে পড়ল ৷ সে যেতে যেতে ভাবতে থাকল – তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল __ সন্তানহীনতা দুঃখের কারণ_ আবার সন্তান থাকাটাও দুঃখের কারণ!!! তাহলে! সিদ্ধান্ত তো হোল না – তাই তার আবার যাত্রা হোল শুরু ।
রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে তরুণ শ্রমণ পূর্ণ নগরের এক প্রান্তে এসে পৌঁছাল ৷ সেখানে সার-সার কুঁড়েঘর – গরীব মানুষের বাস ! সেগুলির পাশ দিয়ে যাবার সময় পূর্ণর কানে এল এক দম্পতির কান্নার শব্দ এবং ঈশ্বরকে গালাগালি দেবার আওয়াজ! পূর্ণ সেখানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল – “এই যে ভাই ! আপনারা কান্নাকাটি করছেন, সেটা ঠিক আছে কিন্তু ঈশ্বরের প্রতি দোষারোপ করেছেন — কেন ? কি এমন দুঃখ আপনাদের ?”
ওরা কাঁদতে কাঁদতে বলল – “মহাশয় ! দেখুন___দেখুন _আমার ঘরের অবস্থা ! কোন রকমে বেড়া দিয়ে তার উপর কাদা লেপে দেওয়াল দিয়েছিলাম, আর মাথায় ঘাস-পাতার ছাউনি । এখন বর্ষাকাল – মাঝে মাঝেই প্রবল বর্ষণ হচ্ছে, তাতে আমার কুঁড়েঘরের দেওয়াল গলে গেছে আর ছাউনির ঘাসপাতা পচে গেছে! ঘরের সব জায়গায় বৃষ্টির জল পড়ে বাক্স-বিছানা সব ভিজে গেছে ৷ ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রাত্রে একটু বিশ্রাম নেব — তারও উপায় নেই! আমরা দুঃস্থ গরীব মানুষ – তাই ভালো ঘর বা একটা ভালো আশ্রয় বানাতে পারি নাই । ঘরের অভাবে আমাদের বড় দুঃখ – সাধুবাবা ! স্বামী – স্ত্রী, দু-জনা খেটেখুটে খাবার ঠিক জুটে যায় ৷ কিন্তু যদি একটা ভালো ঘর বানাতে পারতাম — তাহলে আমাদের আর কোন দুঃখ থাকত না ।”
আনন্দ সব শুনলেন আর ভাবলেন যে, যাইহোক তাহলে দুঃখের জুতসই একটা কারণ পাওয়া গেল _’ঘর না থাকাই দুঃখের কারণ’! খুশী মনে আনন্দ ফিরে যেতে থাকল বুদ্ধের কাছে! যেতে যেতে সে একটা বড় প্রাসাদোপম অট্টালিকার কাছে এসে দাঁড়াল – কত বড় বাড়ী ! আর কত বিচিত্র তার বাহার ! চারিদিকে রেলিং দিয়ে ঘেরা বাগান –তাতে কত ফুল বা ফলের গাছ, ভিতরে ছোট্ট জলাশয়, তাতে ঝরণা বসানো আবার তাতে দু-চারটি পদ্ম ফুটে রয়েছে!
এসব দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল পূর্ণর ৷ হঠাৎ তার চোখে পড়ল দূরে বাগানের প্রান্তে একটা পাথরের বেঞ্চে মাথায় হাত দিয়ে ম্লান মুখে বসে আছে এক বৃদ্ধ! থেকে থেকে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে এবং মাঝে মাঝে উপরের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরকে দোষারোপ করছে ৷ তাকে দেখে মনে হ’ল ভদ্রলোক ঐ বিশাল বাড়ীটির মালিক হতে পারে — কিন্তু কি এর দুঃখ ? পূর্ণ এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধকে সম্বোধন করে বলল – “মহাশয় ! আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুবই চিন্তিত বা দুঃখিত ৷ কিন্তু কি আপনার দুঃখ ?” [ক্রমশঃ]