গুরু মহারাজের কাছে বিভিন্ন ধরনের মানুষ যেমন আসতো, তেমনি বিভিন্ন ধরণের পশু-পাখীরাও আসতো ৷ আর আসতো সূক্ষ্মশরীরধারী প্রেতযোনীরা ! আর স্থূলশরীরেরও বিভিন্ন সাধু-সন্ন্যাসী, তান্ত্রিক, ফকির, দরবেশ -রা আসতো, এছাড়াও বিভিন্ন আধ্যাত্মিক পরম্পরার লোকজন বা বিডিন্ন মহাপুরুষের বংশের লোকজনরাও আসতো ৷ একদিন ‘প্রেতযোনীদের আগমন ওনার কাছে কেন হয়’ — এই কথার উত্তরে উনি বললেন , “যেমন তোরা আসছিস – তেমনি ওরাও আসে ৷ একই তো ব্যাপার ; স্থূলশরীর আর সূক্ষ্মশরীর — চেতনায় তো একই রকমই আছে । ধর, তুই যদি এখনই শরীর ছেড়ে দিস – তাহলেও তোর চেতনা এখন যেমন আছে সেইরকমই থাকবে, অর্থাৎ তুই আমার কাছে আসবি এবং আমাকে তুই এখন যেমন ভাবছিস – ঠিক ঐরকমই ভাববি ! বুঝলি ব্যাপারটা !” কি সহজ সরল ব্যাপার ! ওনার কাছে এইরকম সবকিছুই – সহজ সরল ছিল ! একবার বলেছিলেন (ন’কাকাও মাঝে মাঝে বলেন) “সরল হলে তো হয়েই গেল, দেখোনা অঙ্কে – গুণ, ভাগ, যোগ, বিয়োগ সবকিছু থাকলে তবে সরল হয় । মুখে বলা হয়’ সহজ সরল’ কিন্তু সহজ-সরল হওয়ার জন্য তীব্র সাধনার প্রয়োজন হয় ।
একবার স্বরূপানন্দ মহারাজের মা (গুরু মহারাজের মামীমা হন সম্পর্কে, উনি শেষ বয়সটা অর্থাৎ মৃত্যুকাল পর্যন্ত প্রায় ২/৩ বছর বনগ্রাম আশ্রমেই থাকতেন ৷) সকালের সিটিং-এ গুরু মহারাজের পায়ের কাছে গোটাকয়েক ফুল দিয়ে (উনি যতদিন হাঁটাহাঁটি করতে পারতেন , ততদিন খুব ভোরে উঠে আশ্রমের বাগান থেকে কিছু ফুল তুলে গুরু মহারাজের চরণে দিতেন) বলে উঠলেন – “বাবা ! কাল গভীর রাতে তোমার কাছে এত লোকজন কেন এসেছিল ? ওদেরকে বোলো দিনের বেলায় আসতে – রাতে অত লোকের সাথে কথা বলতে গেলে তোমার যে বিশ্রাম হবে না বাবা !” গুরু মহারাজ সস্নেহে ওনার দিকে তাকিয়ে বললেন – “আচ্ছা – আচ্ছা ! আমি বলে দেব ।” তারপর মামীমা চলে যেতেই উপস্থিত কেউ “ব্যাপারটা কি”– জানতে চাইলে উনি বললেন – “প্রতি রাত্রিতেই Spirit -রা আসে আমার সাথে দেখা করতে, নানারকম আলোচনা করতে ৷ স্বরূপানন্দের মা-য়ের চেতনার উন্নতি হচ্ছে – তাই সূক্ষ্মশরীরের Spirit -দেরও দেখতে পেয়েছে বা লোকজন মনে করেছে”। তারপর বললেন – “দ্যাখো, সেই অর্থে আমার বিশ্রামই বা কোথায় আর Privacy – ই বা কোথায়? সবসময়ই তো কারো না কারো সাথে Communication হচ্ছে – স্থূলে, সূক্ষ্মে না হয় কারণে ! হয়তো বাথরুমে আছি, পায়খানা ঘরে আছি — সেখানেও দেখি কেউ হয়তো হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ৷ তার অবশ্য স্থূলশরীরের চেতনা নাই — তাই আমার লজ্জা পাবার প্রয়োজন হয় না বা কোন অসুবিধা হয় না !”
কি আশ্চর্য্য কথাবার্ত্তা ! কি মজার মানুষ এই পরমানন্দ ! যত ওনার কথা শুনতাম — ততই অবাক থেকে অবাকতর বা অবাকতম হয়ে যেতাম ! এসব কথা তো কখনও শুনিওনি, আবার শুনব বলে মনেও করিনি ! সেইসব কথা শুনতাম — আর যিনি বলছেন তিনি চোখের সামনে বসে রয়েছেন — তা প্রত্যক্ষ করতাম ! তখন মনে হোত ‘আর কি চাই’ , এখন যদি মৃত্যুও হয় — তা হলেও আর কোন খেদ থাকবে না !! কিন্তু পরে দেখলাম – আমাদের ওই ‘মনে হওয়াটা’ ছিল সাময়িক ! ওটা বোধহয় ‘আবেগ’ বা ‘উচ্ছ্বাস’ ছিল — না হলে এখনও বেঁচে আছি কেন ? ওনার শরীর চলে যাবার পরই তো আমাদের মরে যাওয়া উচিৎ ছিল ! কিন্তু তা যখন হয়নি – তখন মুখে যাই বলা হোক না কেন – ওনাকে তেমন ভালোবাসতে পারিনি ! হয়তো উনি ভালবাসতেন — সেইটুকুই পাথেয় ! সেই ভালোবাসার জোরেই ভক্তজনের এই ভালবাসা পাওয়া !! তিনি সামান্য পাত্তা দিয়েছিলেন বলেই হয়তো ভক্তজনের হৃদয়ে সামান্য জায়গা পাওয়া !!
“গুরো কৃপাহি কেবলম্ ! গুরো কৃপাহি কেবলম্ ! গুরো কৃপাহি কেবলম্ !!”
একবার গুরুমহারাজ বলছিলেন “বনগ্রামে আমার ঘরে যে T .V টা আছে (বোধ হয় একটা ছোট T .V ছিল -আগেকার কাঠি এন্টেনায় চলত, শুধু D.D বাংলা, D .D মেট্রো আর D .D national channel চলত।) সেটা কোনো একদিন চলছিল, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি হঠাৎ পেছন থেকে আওয়াজ ‘বাবা ঘুমিয়ে পড়লে? তাহলে T .V টা বন্ধ করে দাও’!”
গুরুমহারাজ দেখলেন ঘরের জানালার বাইরে কয়েকজন spirit তারাও ওখান থেকেই T .V দেখছিল। গুরুমহারাজ ওদেরকে বললেন -“তাহলে তোরাই বন্ধ করে দে”! তারপর ভাবলেন ওরা সুক্ষ শরীরে রয়েছে কি করেই বা করবে! ওরাও বলেছিলো “অনেকবার চেষ্টা করলাম কিন্তু বন্ধ করতে পারলাম না – তাই বাধ্য হয়েই আপনাকে জাগিয়ে দিলাম।”
এইরকম নানা ঘটনায় জানা যায় গুরুমহারাজের ঘরে বা আশেপাশে নানারকম শরীরের আনাগোনা লেগেই থাকতো। আবার পরে শুনেছিলাম যে ভোরের দিকে কিছু ব্রহ্মচারী/সন্ন্যাসী বা ব্রহ্মচারিনী গুরুমহারাজের ঘরে ঢুকে special কিছু কথা বলত, কেউ গুরুমহারাজ কে একটু ম্যাসেজ করে দিতো বা আকুপ্রেসার করতো! এটা শুনে আমাদের কিন্তু কষ্টই হতো- মনে মনে ভাবতাম “ভগবান হওয়ার কি জ্বালা”! এইজন্যই এখন যারা আমার খুবই প্রিয়জন, তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি হচ্ছে দেখলে সাবধান করে দিই ! বলি “আর যা কিছু হও ক্ষতি নেই, কিন্তু যেন ভগবান হয়োনা ! তাহলে মানুষের ভালোবাসার অত্যাচারে বেঘোরে তোমার প্রাণ টা চলে যাবে”!
বলতে চাইছিলাম গুরুমহারাজের কাছে নানান ধরনের লোকজনের আসার কথা! প্রথমে spirit দিয়ে শুরু হলো, অবশ্য আগে একদিন বিভিন্ন গ্রহ -গ্রহান্তরের মহাপুরুষ বা আলোর জ্যোতির ন্যায় মহাপুরুষদের গুরুমহারাজের ঘরে আগমনের কথা বলা হয়েছিল। এবার বলছি স্থূল শরীরে আসা কিছু বিশেষ মানুষ জনের কথা! একদিন সন্ধ্যার সময় মুখার্জী বাড়িতে গিয়ে গুরুমহারাজ চুপচাপ বসে আছেন। অন্ধকারে সিগারেট খাচ্ছেন -সেই আগুনের ওঠা নামা দেখা যাচ্ছে -আমরাও সবাই চুপ চাপ! হঠাৎ একসময় ন’কাকা বলে উঠলেন -“বাবা! তাহলে আজ গাড়ী করে(তখন চার চাকা গাড়িতে খুবই কম লোক বনগ্রাম আশ্রমে আসত। এখন তো প্রায় ৬০ ভাগ লোক গাড়িতে যায়। আমরাও ২/৩ টি family যোগাড় হলে একটা গাড়ী ভাড়া করেই আজকাল আশ্রমে যেতে পছন্দ করি।) তোমার সাথে দেখা করতে এক ভদ্রলোক এসেছিলো- উনি কে ছিলেন -কোথা থেকে এসেছিলেন?” গুরুমহারাজ একটু থেমে সময় নিয়ে জিজ্ঞাসা টা আর একবার শুনে নিলেন, তারপর বললেন_”নিজের পরিচয় দিয়ে ভদ্রলোক বললেন_উনি বীরভূমের একচক্রাগ্রামের নিত্যানন্দ প্রভুর বংশধর !দেখলাম কি জানো ন’কাকা__ ভদ্রলোক বেশ মজাদার মানুষ! নিত্যানন্দ মহাপ্রভু ও খুবই মজাদার মানুষ ছিলেন! সেই রক্ত তো শরীরে রয়েছে ফলে রসবোধ রয়েছে। তাছাড়া দেখলাম ভদ্রলোক সাধন ভজন করেন – চেতনায় উন্নত! বলল- খুব ব্যস্ত লোক,এমনিতে সময় পাওয়া যায় না -অনেকদিন ধরে ইচ্ছা ছিল, তবু আসা হচ্ছিল না! আজ হয়ে গেল!” আসলে ওরাও তো গুরুবংশ! বহু মানুষের দীক্ষার ভার রয়েছে , তবে উনি দীক্ষা কম দেন -এবং শিষ্যের ভার নেওয়ার ব্যাপার টা বোঝেন! যাই হোক ন’কাকা ওনার সাথে আলাপ করে আমিও বেশ মজা পেলাম। বেশ প্রাণ খোলা মানুষ!”