গুরু মহারাজ একবার বললেন -“আমি পৃথিবীর মানুষের উক্ত বা কথিত যে কোন ভাষায় তাদের সাথে Communication করে দিতে পারি। কারণ মুখের ভাষার চাইতেও উন্নত হ’ল মনের ভাষা , আর শ্রেষ্ঠ ভাষা হ’ল প্রাণের ভাষা। যিনি মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পারেন এবং তার উত্তর দিতে পারেন, তিনি যে কোন মানুষের মন জয় করে নিতে পারেন ৷ আর যিনি মানুষের প্রাণের ভাষা পাঠ করতে পারেন এবং প্রাণের বেদনা দূর করতে পারেন, তিনিই হয়ে উঠেন মানুষের কাছে প্রাণের দেবতা!”
সুতরাং এইজন্যই গুরু মহারাজ পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে গেছেন – সেখানেই তিনি গুরুদেব , গুরুজী , ইষ্ট,আরাধ্য হিসাবেই পরিগণিত হয়েছেন ৷৷

গুরু মহারাজ মানুষের ভাষা ছাড়াও পশু-পাখীর ভাষা , বৃক্ষ-লতার ভাষাও বুঝতেন, তাদের সাথে Comunication করতেন। এমনকি তিনি জড় জগতের বিভিন্ন element দের সাথেও যোগাযোগ করতেন। উনি নিজে একদিন বলেছিলেন – ” আশ্রমের পুকুরধারে ঘুরছি, তখন পুকুরটা আমাকে বলল – ‘আশ্রমকে তো সাজাচ্ছ, এবার আমাকে একটু সাজাও’। এবার পুকুরটাকে রেলিং দিয়ে চারদিক বাঁধিয়ে কয়েকটা ঘাট করে দিতে হবে ৷” এরপরই আশ্রমের পুকুর বাঁধানো হয়েছিল।
আশ্রমের কাছাকাছি থাকা পশু-পাখী ও আশ্রমের গাছ-পালাগুলোর সঙ্গে ওনার নিয়মিত কথা হোত ৷

আশ্রমের ময়ুরদুটি (১৯৯০/৯১) মুরলী ও পুলিন (ওদের নামকরণ গুরু মহারাজই করেছিলেন) ওনার কথা খুবই শুনতো বা বুঝতে পারতো ৷ যতদূরেই ওরা থাক না কেন – গুরু মহারাজ যখনই ডাকতেন “মুরলী – ই – ই -” “পুলি – ই – ই – ন্‌” – সঙ্গে সঙ্গে ময়ূর দুটি এসে হাজির হোতো ৷ সাধারণত আমরা সিটিং-য়েই দেখতাম – উনি ময়ূর দুটিকে ডাকতেন ৷ ওরা এলে উনি ওনার পাশে রাখা বড় বেলের খোলা থেকে মিষ্টি প্রসাদ ওদেরকে দিতেন ৷
লক্ষ্য করেছি গুরু মহারাজ ঐ বেলখোলায় রাখা সবচাইতে উৎকৃষ্ট মিষ্টি যেটি – সেটিই উনি ময়ূরদুটিকে খাওয়াতেন অর্থাৎ যদি সন্দেশ বা মাখাসন্দেশ থাকত তাহলে উনি সেগুলি ভেঙে গুঁড়ো করে করে দিতেন – ওরা ঠুকরে ঠুকরে খেতো ৷ অন্য ভালো মিষ্টি প্রসাদ না থাকলে পরমানন্দ স্পেশাল ‘দানাদার’ -ই দিতেন ৷ এক একদিন একটা দুটো খাওয়ার পর আরও খাবার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো, তখন গুরুমহারাজ আবার দিতেন।
শুকনো মিষ্টি এবং সব জায়গাতে বা সব দোকানে Available বলে বেশীরভাগ ভক্তরাই বনগ্রাম আশ্রমে আসার সময় প্যাকেট প্যাকেট ‘দানাদার’ নিয়ে আসত – তাই তখন ‘দানাদার’ মিষ্টিকে আমরা মজা করে বলতাম “পরমানন্দ স্পেশাল” ৷

ওনার ঘরের চালে বাস করা চড়ুই পাখী বা অন্যান্য পাখীরা কিছু বিপদ-আপদে ওনার কাছে সাহায্য চাইতে আসত,(এটা আমরা অনেকবার দেখেছি), সাপেরা কোন সমস্যায় পড়লেও ওনাকে অভিযোগ জানাতো ৷ সন্ধ্যের সময় যখন আশ্রমে প্রার্থনা হোত তখন একটা শঙ্খচূড় সাপ (আশ্রমেই গুরু মহারাজের ঘরের কাছাকাছি কোথাও থাকতো ৷ শঙ্খচূড় সাপ এই অঞ্চলে খুবই কম দেখা যায়।) গুরু মহারাজকে প্রনাম করে আসত , আর ঠিক ওই সময়ে প্রায়ই রান্নাঘরের দায়িত্বে থাকা পঞ্চানন ঘোষও গুরু মহারাজকে প্রণাম করত (তখন গুরু মহারাজ ওনার ঘরের সামনেটায় রাস্তা বরাবর সন্ধ্যার সময় পায়চারী করতেন)। সাপটি এই ঘটনায় খুবই বিরক্ত বোধ করত । একদিন গুরু মহারাজ ঘর থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় উঠে আসছেন আর পঞ্চাননও গুরু মহারাজের দিকে এগিয়ে আসছে ! হঠাৎ গুরু মহারাজ চিৎকার করে বলে উঠলেন – “পঞ্চানন এদিকে এগিয়ে এসো না !” কিন্তু পঞ্চানন্দ (পঞ্চাননকে সবাই পঞ্চানন্দ-ই বলত) শুনবে কেন ? সে গুরু মহারাজকে প্রণাম করবেই ! পুরোনো মাটির রান্নাঘরটা থেকে কোণাকুনি উঠোন পেড়িয়ে পঞ্চানন্দ রাস্তায় (গুরু মহারাজের ঘরের সামনের রাস্তা যেটি সমাধি মন্দিরের দিকে চলে গেছে) যেমনি উঠেছে – ওখানে একটা জলনিকাশী ব্যাবস্থার জন্য পাইপ দেওয়া ছিল , ঐ পাইপের ভিতর থেকে সাপটা বেড়িয়ে এসে পঞ্চানন্দ-কে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল ৷ অকস্মাৎ এই ঘটনায় পঞ্চানন্দের তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া অবস্থা ! গুরু মহারাজ ছুটে গিয়ে সাপটার মাথাটা একহাতে ধরে অন্য হাত দিয়ে পাকগুলো ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে পঞ্চানন্দকে সাপমুক্ত করেছিলেন ৷
পঞ্চানন্দ ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিল – এই ঘটনার পরেই বোধহয় পঞ্চানন্দ আশ্রমের রান্নাঘরের দায়িত্ব ছেড়ে টেরে দিয়ে ওর বাড়ী বিজাড়া (গুরু মহারাজের মামার বাড়ীর গ্রাম) -য় ফিরে যায় ৷

আশ্রমে সেই সময় — অনেক কুকুর থাকতো ৷ তাদের এক-একজনের আবার character আলাদা-আলাদা রকম ! ‘ফেলি’_গুরু মহারাজের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বসে থাকতো ! ফেলির একটা ছবিও রয়েছে গুরু মহারাজের সাথে ৷ সে যাই হোক, প্রতিটি কুকুরই গুরু মহারাজের কথা শুধু নয় ইঙ্গিতও বুঝতো! উনি অনেক সময়ই ওদের সাথে ইশারায় কথা বলতেন। অনেকবার সিটিং এ শুনেছি উনি উপস্থিত একটা বা দুটো কুকুরকে বলেছেন -“এই তোরা এখন ধ্যান কর্!” ব্যস! কুকুরগুলো বসে বসে ঝিমোবার মতো করে ঢুলতে শুরু করে দিতো। শেষের দিকে একটা ডোবারম্যানকে কেউ আশ্রমে দিয়ে গিয়েছিল । ওর নাম দেওয়া হয়েছিল “খ্যাপা”। সাধারণতঃ ডোবারম্যান খুব হিংস্র হয়- তাই প্রথম দিকে ওকে বেঁধেই রাখা হোতো,কিন্তু কিছুদিন আশ্রমের নিরামিষ ভাত-ডাল-তরকারি -দই খেয়ে “খ্যাপা” শান্ত হয়ে গেলো। তখন গুরুমহারাজ খ্যাপাকে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। খ্যাপা সারা আশ্রম ঘুরে ঘুরে বেড়াতো। ও এমনি শান্ত হয়ে গেলো যে ওকে ছোট ছেলে মেয়েরা বা ছোট কুকুরও ওকে মারতো, আর ও বিরাট চেহারা নিয়েও মার খেত।

আর একজন কেউ_ ছোট,সাদা,বড় লোম বিশিষ্ট (স্প্যানিয়েল) একটা কুকুর আশ্রম কে দান করেছিল-ওটা কিন্তু হিংস্র ছিল। গুরুমহারাজ ওর নাম দিয়েছিলেন “আব্দুল”। আব্দুল আশ্রমের ছেলেদের বা ভক্তদের মধ্যেও অনেককে কামড়েছিল, এই জন্য আব্দুল কে সবসময় বেঁধে রাখতে হতো। তবে যতদূর মনে পড়ছে শেষের দিকটায় বোধ হয় আব্দুল কে খ্যাপা-র সাথে ছাড়া অবস্থায় খেলতে দেখেছি! একটা talking dog এসেছিলো একবার বনগ্রামে -তার কথা আগে বলেছিলাম কিনা মনে নাই-তবু আবার বলছি! একদিন গুরুমহারাজ সিটিং এ বসে রয়েছেন – অনেক লোকজন ও বসে বসে ওনার শ্রীমুখের কথা শুনছে। এমন সময় গোটা গায়ে ঘা/আঘাত নিয়ে কুকুরটি গুরুমহারাজের পায়ের কাছে পড়ে_ওনার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে মুখ নাড়িয়ে নাড়িয়ে কত কথা উঁ -উঁ করে বলে যাচ্ছিল আর গুরুমহারাজ সব শুনছিলেন। কুকুর টির লেজ এতো জোরে জোরে বাঁইবাঁই করে ঘুরছিলো যে কাছে যারা বসেছিল তাদের গায়ে হয়তো ফ্যানের হাওয়ার মতো হাওয়া লাগছিলো! অনেকেক্ষণ ধরে গুরুমহারাজ কুকুরটির সব কথা শুনলেন-তারপর বিভিন্ন ভাষায়(বাংলা,হিন্দি,উড়িয়া) ওকে কিছু নির্দেশ দিতে শুরু করলেন। অবশেষে যেই গুরুজী পাঞ্জাবি ভাষায় ওকে সম্বোধন করলেন -সাথে সাথে কুকুরটির সে কি Reaction! একেবারে ওনার পা-য়ে পরে গড়া গড়ি খেতে লাগলো! তখন গুরুমহারাজ একজন কে দিয়ে ডাক্তার মহারাজ (দীপ্তি মহারাজ) -কে ডেকে পাঠিয়ে কুকুরটির গায়ে ঘা -ফোড়া গুলির চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বলে দিলেন এবং কুকুরটাকে কিছু খাবার দেয়ার জন্য-ও বলে দিলেন।।পরে উনি বললেন – “দেখলি তো! কুকুরটার মুখটা যদি ছুঁচোলো না হয়ে একটু গোল মতো হতো তাহলে ও মানুষের মতো কথা বলতো! এটা যেন একটা talking dog ! আসলে কি হয়েছে জানিস! কুকুরটি খুবই বিপন্ন অবস্থায় আমার কাছে এসেছে একটু স্থান পাওয়ার জন্য। বেশ কয়েকদিন ওর পথে পথে কেটেছে -ও একটুও খাবার বা কোনো আশ্রয় পায়নি! হয়েছে কি জানিস -কুকুর টি পাঞ্জাবের ,ওখান থেকে গুড় ভর্তি লরী আসে বর্ধমানে! এই কুকুরটি যেকোনো ভাবে গুড়ের লোভে ফাঁক ফোকর দিয়ে লরীতে গুড়ের টিনের ফাঁকে ঢুকে পড়েছিল – আর বেরোতে পারেনি। এবার বর্ধমানে যখন লরী টি unload হয়েছে -তখন বেচারা বেরোতে বাধ্য হয়েছে। আর বাইরে বেরিয়েই পড়েছে মহা মুস্কিলে! স্থানীয় কুকুর রা কেউ এই বিদেশী(ওদের কাছে বিদেশী) কুকুরটা কে স্থান দিতে রাজি নয়-ফলে সবাই ওর পিছনে পড়ে_ওকে এলাকা ছাড়া করে দিতে শুরু করলো। যেখানে যায় সেখানেই একই অবস্থা! বেচারা কি আর করে? ওদের নিজস্ব surrender – এর মুদ্রা আছে -জানো? মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে চার পা উপরে তুলে দেয়! সেই অবস্থায় এক বিজ্ঞ কুকুর ওকে বলে ” তুই বনগ্রামে যা। ওখানে আমাদের রাজা রয়েছে -সে যদি তোকে আশ্রয় দেয় তাহলে থাকতে পারবি, না হলে তোর আর ‘চারা’ নাই! সেই বিজ্ঞ কুকুরটির নির্দেশ মতো বর্ধমান থেকে কুকুর টি বর্ধমান-কালনা রোড ধরে ধরে বহু কুকুরের মার খেতে খেতে এবং অভুক্ত অবস্থায় আজ এখানে এসে পৌছেছে! তোমরা তো নিজের চোখেই দেখলে কুকুরটা এসে প্রাণরক্ষার তাগিদে কেমন আকুল হয়ে আর্তি জানালো!!