গুরু মহারাজ চাকরীরত অবস্থায় তাঁর সাথীদের খোঁজে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলাগুলিতে ঘুরে ঘুরে কাজ করতেন অথবা এমনিই বিভিন্ন স্থানে যেতেন ৷ পরবর্ত্তীতে আমরা দেখেছি যে, যেসব স্থানে উনি Camp করেছেন, হয় সেইখানেই মূল আশ্রমের শাখাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে অথবা সেই এলাকা থেকেই আশ্রমের প্রথমদিকের ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসীরা আশ্রমে যোগ দিয়েছিলেন। রায়না অঞ্চলে যখন ওনার Camp ছিল তখন প্রথম থেকেই ওনার সাথে হারুদা (হারাধন ঘোষ , বর্তমান রায়না আশ্রমের সেক্রেটারী) , জগাদা (জগন্নাথ দত্ত , যার বাড়ীতেই তখন প্রায়শই গুরু মহারাজ থাকতেন , উনি একটা কামারশালা চালাতেন আর যার মাকে মা যশোদা বলা হয়) , সন্ধ্যামা (যিনি হাইস্কুলের টিচার ছিলেন , সুন্দর গান গাইতে পারতেন , গুরু মহারাজ প্রায় সন্ধ্যায় ওনার ঘরে যেতেন – সেখানে গান-বাজনা হোত , ধর্মালোচনা হোত ৷ উনি খুবই যত্ন করে গুরু মহারাজকে রান্না করে খাওয়াতেন ৷ আবার এক-একদিন গুরু মহারাজও ওনাকে রান্না করে খাইয়ে দিতেন ৷) , বরুয়া পরিবার (অচ্যুৎ বরুয়া গুরু মহারাজের বন্ধুর মতো ছিল ৷ বিদ্যুৎ বরুয়া এখনো ডাক্তার ! ওনার মা বা বোনেরা গুরু মহারাজকে খুবই সেবা যত্ন করতেন ৷) , দিলীপদা (এনার সোনার দোকান ছিল , ইনিও গুরু মহারাজের সাথে বন্ধুর মতো মিশত ৷), মিহিরদা (স্বামী প্রজ্ঞানন্দ , যিনি গুরু মহারাজের খুবই স্নেহের পাত্র ছিলেন ৷ উনি – গুরু মহারাজ বনগ্রাম আশ্রম প্রতিষ্ঠা করলে এখানে চলে আসেন । উনি খুবই চঞ্চল ও দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন ৷ ব্রহ্মচারীদেরকে সবসময় ব্যতিব্যস্ত করে রাখতেন ৷ গুরুমহারাজ ছাড়া ওনাকে control করা কারো পক্ষে সম্ভব হোত না ৷), প্রভাত ব্যানার্জ্জী (ডাক্তার , এখন যিনি চরৈবেতি পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন ) – ইত্যাদি অনেকেই যুক্ত ছিলেন ৷৷
সেই সময় (রায়নায় থাকাকালীন) উনি সবচাইতে বেশী সুযোগ দিয়েছিলেন জগাদা বা জগন্নাথ দত্ত কে ৷ জগাদাকে নিয়ে উনি অনেক স্থানে বেড়াতেও যেতেন ৷ প্রতি রাত্রে গুরুমহারাজ শ্মশানে যেতেন – জগাদার অনুরোধে দু-একবার উনি জগাদাকে সেখানেও নিয়ে গেছেন, সঙ্গে এক একদিন হারুদাও থাকতো ৷ এমন ঘটনাও ঘটেছে যে ভাবস্থ অবস্থায় গুরুজী ওদের দুজনকে ধরে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন ৷ মাটি থেকে ২০/৩০ ফুট উচুঁতে ওঠার পর ওরা প্রাণপনে চিৎকার করতে খাকলে গুরু মহারাজ ওদেরকে নামিয়ে দেন ৷ পরে বলেছিলেন হিমালয়ে (বা পেরেন্টাপল্লী) নিয়ে যাচ্ছিলেন ৷
রায়নায় বিভিন্ন শ্মশানে কত যে ভূত-প্রেতের কান্ড ওনারা দেখেছিলেন তার ইয়ত্তা করা যাবে না ৷ হারুদা, জগাদা, সন্ধ্যামার সাথে কিছুক্ষণ ফাঁকায় বসলেই সেইসব দিনের স্মৃতিচারণা শুনতে পাওয়া যায়! জগাদা তো একবার শয়ে শয়ে কুকুরের মতো পাল পাল প্রেতযোনীর স্রোত দেখেছিল , যারা গুরু মহারাজের দুপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল!
শ্রীখণ্ডে (কাটোয়ার কাছে , পূর্ব বর্ধমান) ক্যাম্প চলাকালীন, ওখানকার হাইস্কুলে গুরুজীরা থাকতেন। ওখানে দুটি নারী শরীরের প্রেতযোনী থাকতো। মিহির মহারাজ (স্বামী প্রজ্ঞানন্দ) ভূত-প্রেতে বিশ্বাস কোরতো না — একটু বিজ্ঞানমনস্ক ছিল ৷ সব ব্যাপারকেই Science দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা কোরতো। সেইটা ভাঙবার জন্য গুরু মহারাজ(তখন রবীনদা) মিহিরদাকে শ্রীখন্ডে ডেকে পাঠান।সন্ধ্যার পর উনি মিহিরদাকে নিয়ে স্কুলের দোতলায় একটা ফাঁকা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন ৷ ঘরে একটা হ্যারিকেন জ্বলছিল। গুরু মহারাজ সেই মেয়ে (প্রেতশরীর) দুটির Existance টের পেতেই মিহিরদাকে বলেন – “মিহির ! তুমি একটু বসো ! আমি সিগারেটের প্যাকেটটা নিচ থেকে নিয়ে আসি !” এই বলে যেই না গুরু মহারাজ ঘর থেকে বেড়িয়ে গেছেন – অমনি উৎপাত শুরু হয়ে গেল। টেবিল নড়ছে, চেয়ারটা হটপট করে শব্দ করছে, হ্যারিকেন টা নড়াচড়া করছে! তারপর যখন হ্যারিকেনটা বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল_তখন আর মিহির মহারাজ চুপ করে বসে থাকতে পারল না। প্রানভয়ে একদৌড়ে এমনভাবে সিঁড়ির কাছে পৌঁছেছিল যে গুরুমহারাজ না ধরলে মিহির দা নির্ঘাত দোতলা থেকে একতলায় পড়ে যেতো।
যাই হোক, সেই সময় গুরুমহারাজ জগাদাকে নিয়ে যে সব স্থানে গিয়েছিলেন তার মধ্যে মুরারী মহারাজের বাড়ি (বাঁকুড়া জেলা) এবং ওখানেই এক গভীর জঙ্গলে এক তান্ত্রিকের আশ্রমে (সেখানে এখন অবশ্য আর গভীর জঙ্গল নাই। আমাদের আশ্রমের কিছু ভক্ত গুরুমহারাজের কাছ থেকে শুনে পরবর্তীকালে ওখানে গিয়েছিল। দেখে এসেছে যে আশ্রম টি এখনো রয়েছে, কিন্তু এতটা দুর্গম এখন আর নাই। রাস্তাঘাট রয়েছে, জঙ্গল কাটা পড়েছে,লোকবসতি হয়েছে।)।
দ্বিতীয়টাই আগে বলি – গুরুমহারাজ ওই তান্ত্রিকের কথা শুনে জগাদা কে নিয়ে সেখানে যাবেন স্থির করলেন। একদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লেন -এবার গুরুমহারাজ আমাদের যা বলেছিলেন সেইটা বলছি – “হেঁটে হেঁটে প্রায় ৮/১০ কিমি রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আমাদের অনেকটা বেলা হয়ে গেছিল। আমরা যখন ওখানে (জঙ্গলের মধ্যে তান্ত্রিক সাধুবাবার কুঠিয়ায়) পৌছলাম, তখন দেখলাম -সাধুটি নেই, কর্মোপলক্ষে অন্যত্র গেছেন। কুঠিরে সাধুমা রয়েছেন -তিনি আমাদের আপ্যায়ন করে বসালেন। কিছু প্রাথমিক কথা বার্তার পর উনি চলে গেলেন গৃহকর্মে অর্থাৎ রান্না বান্নার ব্যাবস্থা করতে। জগাদা এদিক ওদিক ঘুরছিল। আমি কি আর করি? সাধুবাবার স্থায়ী ধুনীর পাশে বসে ধ্যান করতে শুরু করলাম! ব্যস! তারপর আর শরীরে হুঁশ নাই! মন কোথায় চলে গেছে! ইতিমধ্যে তান্ত্রিক সাধুটি এসে গেছে- জগাদার সাথে পরিচয় পর্বাদি সাড়া হয়ে গেছে! এইবার উনি আমাকেও ডেকেছেন – কিন্তু আমি তো সারা দিইনি! তান্ত্রিক,কাপালিক সাধুদের একটু তেজি ভাব থাকে! সাধুটি এই ধরনের ভাবস্থ অবস্থা দেখতে অভ্যস্ত নয় -ওর কাছে লোকে তাবিজ_কবজ করাতে আসে, অথবা কেউ অসুস্থ -পীড়িত তাকে সাড়াতে হবে- সেই জন্য আসে। সুতরাং আমার তন্ময় অবস্থাটাকে ও ভাবলো বোধয় ঢঙ করছে। তাই দু-একবার ডেকে যখন সাড়া পেলো না তখন হাতের চিমটা (তান্ত্রিকদের হাতে হয় ত্রিশূল অথবা চিমটা কিছু একটা থাকে)_টাকে ধুনীর আগুনে পুড়িয়ে নিয়ে, আমার ‘দাবনা'(থাই) -তে ধরল চেপে! সঙ্গে সঙ্গে চামড়া পুড়ে দগদগে ঘা হয়ে গেলো। মা-টি ছুটে এসে ওনাকে নিবৃত্ত করে আমার শুশ্রূষা করতে শুরু করলো। এইসব ঘটনায় আমার শরীরে হুঁশ আসতে শুরু করলো! ঐ অবস্থায় আমি শান্ত হয়ে বসেছিলাম দেখে তান্ত্রিকও তো ঘাবড়ে গেছে! সেও বুঝতে পেরেছে কাজটা ঠিক হয়নি! তারপর খানিকক্ষণ কথাবার্তা হলো। আমার থাই এর জায়গাটা কিন্তু অনেকখানি পুড়ে গিয়েছিলো। ফলে ফিরে আসার সময় একটু কষ্ট হলো – এতটা হাঁটা পথ! ঘা টা সেরে গেলেও পোড়া দাগটা কিন্তু এখনও সম্পূর্ণ সারেনি – এই দ্যাখো এখনো চিহ্ন রয়েছে! (এই বলে উনি কাপড় সরিয়ে আমাদের কে দাগটা দেখিয়ে ছিলেন।)।
মুরারী মহারাজদের বাড়ির ঘটনায় যাবার আগে রায়নার আর একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো, সেটা বলে নিই- নাহলে পরে আর লেখা হবে না! রায়নায় থাকাকালীন একদিন গুরুমহারাজ সন্ধ্যামায়ের বাড়িতে গান, ভগবৎ-কথা ইত্যাদি সেরে ক্যাম্পে ফিরেছেন -সঙ্গে রয়েছে জগাদা,হারুদা ,মিহিরদা,দিলীপ ইত্যাদিরা! গুরুমহারাজ আগে আগে -বাকিরা পিছন পিছন। গুরুমহারাজের হাতে টর্চ! হঠাৎ একজায়গায় উনি দাঁড়িয়ে গেলেন। ফলে বাকীরাও দাঁড়িয়ে গেলো! কিন্তু সকলের কৌতূহলী দৃষ্টি সামনের দিকে – ব্যাপারটা কি হচ্ছে! দেখা গেলো- গুরুমহারাজ যেখানটায় দাঁড়িয়েছিলেন ঠিক তার উপর থেকে ঝরঝর করে ফুল পড়ছে গুরুমহারাজের শ্রীচরণে। ফুল পড়া শেষ হতেই একটা প্যাকেটে সুন্দর করে বাঁধা এক প্যাকেট মিষ্টি! ওরা সকলে অবাক হয়ে গেলো -ব্যাপারটা চাক্ষুস করে! ঘটনাটা ঘটে যেতেই গুরুমহারাজ হাঁটা লাগালেন। মিহির দা চির কালের ফিচকে ছেলে। ও বললো “গুরুজী! মিষ্টির প্যাকেট টা ফেলে রেখে কি হবে -ওটা কি হাতে নিয়ে নেবো”?
গুরুমহারাজ খানিক চিন্তা করে নিয়ে বললেন_”নিয়ে নে! ওটা আমার এক ভক্ত দিয়েছে! ও মিষ্টির দোকান করেছিল। ওর খুব ইচ্ছে ছিল_ওর দোকানের মিষ্টি আমাকে খাওয়াবে। কিন্তু হটাৎ করে মারা যাওয়ায় আর খাওয়াতে পারে নি। আজকে আমাকে ওর দোকানের মিষ্টি নিবেদন করে আশাটা মেটালো”।_” কিন্তু ওর তো হাত পা নাই, ও তো মারা গেছে__তাহলে প্যাকিং করা মিষ্টি কিভাবে দিল”?__জিজ্ঞাসা এসেছিল। গুরুজী বললেন_” ইচ্ছাশক্তি, সংকল্পশক্তি_এইসব দিয়ে পৃথিবীতে কত অসাধ্যসাধন হয়েছে_এটা আর এমন কি”!!