গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ মহারাজের করিমপুর অঞ্চলের একজন ভক্ত পঙ্কজ বক্সির জীবনের সাধনা ও ‘সাধনলব্ধ প্রাপ্তি’র কথা হচ্ছিল (ইনি করিমপুরের-ই আর একজন পঙ্কজ বাবু অর্থাৎ পঙ্কজ মন্ডল নন ! পঙ্কজ মণ্ডল প্রথম জীবনে বিয়ে করেছিলেন , পরবর্তীতে স্বামী পরমাত্মানন্দ নাম নিয়ে উনি বানপ্রস্থ সন্ন্যাস নেন মধ্যমগ্রামের পুতুল মা-র নিকট ৷ অপরপক্ষে পঙ্কজ বক্সী বিবাহ করেন নি ! মধ্য বয়স থেকেই উনি দূরারোগ্য এক ব্যাধিতে আক্রান্ত হ’ন ! এটি একটি বিশেষ ধরনের Rheumatism -যার কোন চিকিৎসাই বের হয়নি । ওষুধ খেলে যন্ত্রণা কমে – ওষুধ বন্ধ করলেই অহরহ যন্ত্রনা !) ৷ মানুষের জীবনে সবচাইতে খারাপটাও যে সবচাইতে ভালো হয়ে উঠতে পারে – এইটা আমরা সাধারণ মানুষেরা কল্পনাতেও আনতে পারি না ! ধর্ম শাস্ত্রের শিক্ষায় আমরা পেয়েছি যে , ” শরীরে যেগুলি রিপু বা শত্রু সেগুলির মোড় ঘুরিয়ে দাও – তাহলেই তারা (রিপুগুলি) , যারা একদিন তোমাকে বিপথগামী করেছিল – তারাই তোমাকে ঈশ্বরমুখী হতে সাহায্য করবে ৷” কিন্তু এই শিক্ষা তো ব্যবহারিক জীবনে আমাদের হয় না – তাই এগুলির সত্যতা বুঝতেই পারিনা ! সাক্ষাৎ প্রমাণ পেলাম পঙ্কজ দার (বক্সী) জীবন দেখে! তার জীবনের ওই মারাত্মক ব্যাধি , যার জন্য উনি সদা সর্বদা যন্ত্রণা ভোগ করেছেন , মনুষ্য জীবনে যৌবনকালের সুখ-ভোগ থেকে বঞ্চিত হতে বাধ্য হয়েছেন , জন্মসূত্রে সুস্থ শরীর লাভ করেও ধীরে ধীরে বিকলাঙ্গ হয়ে শেষটায় একদম শয্যাশায়ী থেকেছেন – সেই ভয়ানক ব্যাধি-ই পঙ্কজদার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিল ৷ এই একটা জীবনেই পঙ্কজদা পেরিয়ে গেলেন কত জন্ম জন্মান্তর ! কিভাবে তাই বলছি!!
গুরু মহারাজের কাছে ধ্যান করার পদ্ধতি শিখে নেওয়ার পর থেকে পঙ্কজ দা সময় পেলেই ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন । কারণটা ছিল – উনি আবিষ্কার করেছিলেন যে , যতক্ষণ উনি ধ্যানমগ্ন থাকেন – ততক্ষণ তার শরীরের এতদিনকার যে অহরহ যন্ত্রণা ভোগ – সেটা থাকত না ! সুতরাং পঙ্কজ বক্সী আধ্যাত্মিকতা লাভের জন্য যতটা না করেছেন , তার চেয়ে বেশি আগ্রহ নিয়ে ধ্যান করতেন যন্ত্রণা মুক্ত হবার জন্য ! এইভাবে শুরু হলেও, যত দিন আগালো, তাঁর জীবনের চরম অভিশাপ পরিণত হল চরম আশীর্বাদে ! প্রথম প্রথম উনি বসে বসে ধ্যান করতে পারতেন – তখনো ওনার হাঁটু মুড়ে বসার অসুবিধা হতো না , যখন হাঁটু মোড়ার অসুবিধা হলো তখন উনি পা ছড়িয়ে বসে ধ্যান করতেন , যখন (বেশ কয়েক বছর পরে) বসতেও পারতেন না – তখন উনি শুয়ে শুয়েই ধ্যান করতেন ! গুরু মহারাজ শরীরে থাকাকালীন উনি ধ্যানের আসনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ( কারণ ধ্যানের প্রকৃষ্ট আসন পদ্মাসন , সুখাসন , গোমুখাসন ইত্যাদি আসনগুলি – যাতে শরীরের মেরুদন্ড একদম সোজা থাকে ৷) – যেহেতু উনি আর সোজা হয়ে বসতে পারেন না – তাহলে ধ্যান কিভাবে করবেন ? গুরু মহারাজ ওনাকে বলেছিলেন – ” আপনার যেভাবে ধ্যান করলে সুবিধা হয় আপনি সে ভাবেই ধ্যান করবেন । দেখবেন আপনার কোন অসুবিধা হবে না (গুরুমহারাজ__ সমাজের সন্মানীয় ব্যক্তি, বা যারা বয়স্ক অথচ সবে সবে আশ্রমে আসা যাওয়া করছে, এমন ব্যক্তিদেরকে, সাধারণত ‘আপনি’ – বলে সম্বোধন করতেন!) ।”
ফলে পঙ্কজ বাবুর মনে আর কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রইল না ৷ উনি বসে পা ছড়িয়ে এবং পরের দিকে শুয়ে শুয়েই ধ্যানাভ্যাস করতেন । উনি আমাকে বলেছিলেন যে , উনি দেখেছিলেন – যেকোন অবস্থাতেই (সোজা হয়ে বসে , পা ছড়িয়ে বসে অথবা চিৎ হয়ে শুয়ে) ওনার ধ্যান তাড়াতাড়িই জমে যেত । কিছুক্ষণের মধ্যেই ওনার চেতনা একটা বিন্দুতে স্থির হয়ে গিয়ে একটা powerfull আলোর Flash হোত এবং সবকিছুই জ্যোতির্ময় হয়ে উঠত ! উনি দেখতেন সেই জ্যোতিঃসাগর থেকে তরঙ্গ উঠে আসছে – একটার পর একটা – কোনটা ছোট , কোনটা বড় , কোনটা আবার আরও বড় ৷৷ উনি সেই জ্যোতিঃসমুদ্রের মধ্যে রয়েছেন – আর এক অপার্থিব আনন্দে ওনার শরীর-মন আপ্লুত হয়ে থাকতো ! ওনার সময়ের হুঁশ থাকত না , স্থান-কাল-পাত্রের হুঁশ থাকত না – শুধুই আনন্দ-আনন্দ আর আনন্দ !
এই অবস্থা ওনার অনেকদিন চলেছিল। উনি বলেছিলেন _এরপর উনি যে কোন অবস্থায় মনঃসংযোগ করলেই সাথে সাথে ঐ মগ্ন অবস্থায় এবং জ্যোতিঃসমুদ্রের দর্শন অবস্থায়, চলে যেতে পারতেন_এরজন্য আলাদা করে কোন চেষ্টা ওনাকে করতে হোত না! ধীরে ধীরে উনি সেই জ্যোতিঃসমুদ্রের মধ্যে নিজের identity খুঁজে পেতেন_আর সেই জ্যোতিঃতরঙ্গগুলিকেও উনি দেখতেন _জমাট বেঁধে এক একটা রূপ পরিগ্রহ করতে!! ঐ জ্যোতিঃতরঙ্গের জমাট রূপ গুলির অর্থাৎ মহাপুরুষদের দর্শন মাত্রই ওনার শরীরেও তাদের কিছু কিছু গুনাবলী প্রবেশ করত! এগুলো শুধু তিনিই যে বুঝতে পারতেন _তাই নয়, পরের দিন উনি স্কুলে (যে স্কুলে উনি শিক্ষকতা করতেন) গেলে ওনার সহযোগী শিক্ষকেরাও ওনার পরিবর্তিত মানুষ হয়ে ওঠার ব্যাপারটা বুঝতে পারতেন। এর ফলে ধীরে ধীরে উনি ওনার পরিচিতদের কাছে একটা সন্মানীয় ব্যক্তি, শ্রদ্ধার মানুষ হয়ে উঠেছিলেন!!
এই অবস্থাটা আরো প্রকট হোল _যখন ওনার মধ্যে বিভিন্ন সিদ্ধি আসতে শুরু করল! যন্ত্রণা ভোলার জন্য ধ্যান শুরু করলেও এখন কিন্তু উনি সেই কারণে ধ্যান করতেন না, এখন ওনার ‘ধ্যান’ করাটাই সহজতা হয়ে গেছিল! উনি দিন-রাতের প্রায় সবসময় ধ্যানেই থাকতেন! এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমরা ন’কাকার সাথে প্রথম প্রথম আদিত্যপুর আশ্রমে যাওয়া শুরু করলাম (2006/07) তার আগেই পঙ্কজদা(বক্সী) করিমপুর আশ্রম থেকে পাকাপাকিভাবে আদিত্যপুর আশ্রমে চলে এসেছিলেন। আমরা তখন দেখতাম _প্রায় সবসময়ই উনি শুয়েই থাকতেন, মাঝে মাঝে বিছানায় উঠে বসতেন! শুধুমাত্র ন’কাকা ওনার সাথে দেখা করতে গেলে উনি প্রচন্ড কষ্ট সহ্য করেও বিছানা থেকে নেমে এসে ঝুঁকে পড়ে ওনাকে প্রনাম করতেন। ওনার কষ্ট দেখে _ন’কাকা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন!!
যাইহোক, আমার মনে আছে _ন’কাকা আমাকে পঙ্কজদার উজ্জ্বল মুখমন্ডল দেখিয়ে বলেছিলেন _”বক্সীর মুখের ঔজ্জ্বল্য দেখেছ! পূর্ণ আধ্যাত্মিকতার লক্ষন! সদা-সর্বদা এত যন্ত্রণাভোগের মধ্যেও মুখের ঐ উজ্জ্বলতা স্বাভাবিক লোকের কখনই হোতে পারে না _একমাত্র হয় আধ্যাত্মিক ব্যক্তির! ”
যাইহোক, আমরা আলোচনা করছিলাম __ওনার জীবনে সাধনার তীব্রতা আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সিদ্ধি এসে যাওয়ার কথা! কিন্তু আজকের লেখার ‘কোটা’ এতদূর-ই, তাই পরের দিনের অপেক্ষায় থাকতেই হবে…..!!! (ক্রমশঃ)