গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) ১৯৯১ সালে আমাদের বাড়ী রশুই গ্রামে এসেছেন ৷ বিকেল বেলায় ওনাকে নিয়ে অজয় নদের চড়ায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হোল । তখনও এখনকার মতো বালি মাফিয়ারা পুলিশ-প্রশাসনের সহায়তায় নদী-গর্ভ থেকে জোর-জবরদস্তি বালি লুঠ-পাট করার মতো – অত্যাচারে নামেনি – তাই নদীর চড়া একদম সমান , মসৃন এবং পরিষ্কার ছিল ৷ তবু গ্রামের জনগণ তখন নদীর চড়াতেই শৗেচকার্য্য সারতো – তাই গুরু মহারাজ সন্ধ্যার সময় যখন ফিরে আসছিলেন তখন গঙ্গাবাবুর মেয়ে রত্নাকে (ও তখন খুবই ছোট , হয়ত ইলেভেনে পড়ে) উনি বললেন – ” কালো কালো দেখলে সেখানে যেন পা দিবি না !” আমরা সবাই ওনার কথায় বেশ মজা পেয়ে হেসে উঠেছিলাম ।
তবে এখন ফেরার কথা থাক – বেড়াতে যাওয়ার কথায় আসি। আমরা বিকেলের দিকে গুরুমহারাজকে নিয়ে নদীর চড়ায় পৌঁছালাম ৷ কোন একটা জায়গায় তো বসতে হবে – তাই আমি একটা পরিস্কার জায়গা দেখে গুরুমহারাজকে উদ্দেশ্য করে বললাম – “গুরুজী! তাহলে এখানেই বসা যাক্ ৷” উনি হাঁটতে হাঁটতেই বললেন – “না ! এখানে নয় ৷” কি আর করা যায় , উনি আগে আগে — আমি , রত্না প্রায় ওনার কাছাকাছি , – গঙ্গাবাবু , মানিকবাবু , দীপ্তি বৌদি , রমেনবাবু , অরুণবাবু , তৃষাণ মহারাজ ও তপনদা (বর্ধমান) গল্প করতে করতে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ধীর পদক্ষেপে আসছেন ৷ সঙ্গে দীপ্তি বৗেদি থাকাতেই ওনারা ধীরে ধীরে আসছিলেন । আরও একটু চলার পর আমি মৃদুকন্ঠে বলে উঠলাম – “তাহলে এখানেই কোথাও বসলে হয় না ?” উনি বললেন – “আর একটু চল ৷”
তখন নদীতে জল ছিল না – মালভূমি থেকে আসা নদ বা নদীতে সারাবছর জল থাকেও না ! বর্ষাকালে ভয়ঙ্কর রূপ হয় আর শীতকালে হাঁটুজলও থাকে না , গ্রীষ্ম পড়লেই সেটুকুও শুকিয়ে যায় ! আমি ভাবলাম উনি বোধয় জলের একদম কাছে বসবেন – কিন্তু সেখানে বালিগুলি একটু ভিজে ভিজে ভাব থাকে , তাই মনে মনে একটু উদ্বিগ্ন হচ্ছিলাম, ওনার কাপড় ভিজে যেতে পারে _এই ভেবে !
আর আমাদের উদ্বিগ্নতা – !! উনি শুকনো বালিতেই একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লেন , তারপর বললেন – “এখানেই বসা যাক্ ।” সেখানে ওনার পাশাপাশি আমি এবং রত্না বসলাম, একটু পরে দীপ্তি বৌদিও আমাদের পাশে এসে বসল । বাকীরাও পাশাপাশিই বসল – তবে কেউ কেউ একটু দূরে ! একটা কথা বলে রাখা ভালো যে নদীর বালিতে বসলে কাপড়ে কোন ধূলো বা ময়লা লাগে না ! বালি লেগে থাকলেও ঝেড়ে দিলেই তা চলে যায় ! যাইহোক , গুরু মহারাজ সেই নির্দিষ্ট জায়গাটিতে বসার পরেই বললেন – ” অজয় এখানে কত সরে এসেছে রে ! আগে আরো উত্তরে ছিল ; অজয়ের তীরে তীরে তখন প্রচুর বৈষ্ণবদের আখড়া এবং আশ্রম ছিল ৷ মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দের প্রভাবে সেই সময় বাংলায় ভক্তিরসের প্লাবন বয়ে গিয়েছিল ! মহাপ্রভু এই অজয়ের তীর ধরে কতবার যাতায়াত করেছেন !” আমি বললাম – ” কিন্তু জনশ্রুতি রয়েছে যে , মহাপ্রভু একবারই মাত্র এদিকে গিয়েছিলেন এবং আমাদের গ্রামে রান্না করে খেয়েছিলেন বলেই আমাদের গ্রামের নাম রশুই !!” গুরু মহারাজ বললেন – ” না-না , উনি অনেকবার এদিকে যাতায়াত করেছেন । উনি এই পথ ধরেই পৌষ সংক্রান্তিতে জয়দেবের মেলায় যেতেন ৷ আমি এখন যেখানে বসে রয়েছি – এখানেও বহুপূর্বে একজন বৈষ্ণবের আখড়া ছিল !” ওনার কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম – উনি কেন আমার কথা শুনে আগে বসেন নি ! বহুকাল পূর্বের ওনার কোন ভক্তের আকাঙ্খা পূরণ করার জন্যই এতবড় চড়ার মধ্যে একেবারে নির্দিষ্ট স্থানে এসে বসলেন ! এবার আমি সাহস সঞ্চয় করে ওনাকে জিজ্ঞাসা করে বসলাম – ” আচ্ছা গুরুজী! এই যে আপনি বললেন – ‘নদীটি অনেক দূরে সরে এসেছে’ অথবা ‘এইখানে একটি বৈষ্ণবের আখড়া ছিল’ – এগুলি কিভাবে বললেন? পূর্বস্মৃতি থেকে না ‘ভূমিবিজ্ঞান’ জানেন বলে বলতে পারলেন?”
উনি একটু সুন্দর হাসি হেসে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন – কিন্তু কথার উত্তর দিলেন না ! ইতিমধ্যে রমেনবাবুরা ওনার পাশে এসে বসে পড়ায় অন্য প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু হয়ে গেল ।
খড়দহের অরুণবাবু (হাইস্কুলের টিচার ছিলেন এবং হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দিতেন । আজিমগঞ্জ আশ্রমে একবার গুরু মহারাজের গলা বসে গেছিল ৷ সেইসময় অনেকেই নানারকম ওষুধ দিয়েছিল কিন্তু গুরু মহারাজ সবার ভালোবাসার অত্যাচার থেকে বাঁচতে প্রচার করে দিয়েছিলেন যে “অরুণবাবুর ওষুধ খেয়েই আমি ভালো আছি!” এরপর গুরুমহারাজ ধীরে ধীরে সুস্থ ও হয়ে যান, ফলে প্রচার হয়ে যায় যে _অরুনবাবু হল গুরুমহারাজের ডাক্তার!”) সেদিন উনি বাঙাল ভাষায় মজার মজার গল্প বা কথা বলে পরিবেশকে বেশ মজাদার করে তুলেছিলেন! দীপ্তি বৌদি এবং মানিকদা(বোস)-ও originally ওপার বাংলার মানুষ _ফলে ওনারাও এতে অংশগ্রহণ করে বেশ মজা পাচ্ছিলেন। রমেনবাবু হলেন নিপাট ভদ্রলোক _ওনাদের পন্ডিত বংশ! পূর্বে ওনাদের বাড়িতে টোল ছিল, বড় বড় পন্ডিতেরা ঐ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। উনি বা ওনার পরিবারের লোকজনের সাথে গুরুমহারাজের খুবই প্রেমপূর্ন সম্পর্ক ছিল। রমেনবাবু চাকরি সূত্রে রাঁচি রোডে থাকাকালীন গুরুমহারাজ কতবার যে ওনাদের কোয়ার্টারে গেছিলেন তার ইয়ত্তা নাই! রমেনবাবুর আর একটা পরিচয় হোল _উনি আমাদের আশ্রমের প্রবীণ সন্ন্যাসী স্বামী শংকরানন্দের ভগ্নিপতি।সুযোগ মতো সে সব কথা অন্য একদিন বলা যাবে। এখন আসি সেদিন আমাদের বাড়ির কথায়!বাঙাল ভাষার আলোচনায় অংশ নিয়ে রমেনবাবু দু-একটা ফোরং কেটে আসরটাকে আরও জমিয়ে দিচ্ছিলেন।
এইভাবে বেশ খানিকটা সন্ধ্যা হয়ে যাবার পর সবাই মিলে নদীর ধার থেকে বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করা হোল। সন্ধ্যার পর আর গ্রামের মানুষজন বিশেষ কেউ আমাদের বাড়িতে আসে নি। ফলে সেই রাত্রে বাড়ির দোতলায় ওনার ঘরে ঘরোয়া ভাবে গল্প-গুজব হয়েছিল। সেইসময় ঐ অঞ্চলে দু-চার জন ছাড়া আশ্রমের দীক্ষীত ভক্ত বিশেষ কেউ ছিল না। ফলে রাত্রি টা ঘরোয়া পরিবেশেই কাটল। আমার ছোটদিদি(চুড়পুনি গ্রামে থাকতেন, এই মাত্র একমাস আগে উনি শরীর ছেড়েছেন) – কে আমার মা (আমাদের মা তখনও শরীরে ছিলেন) ডেকে পাঠিয়েছিলেন গুরুমহারাজের সাথে দেখা করানোর জন্য। ছোটদিদির বাড়ির চিলেকোঠার ফাঁকে বড় লক্ষীপেঁচা বাসা বেঁধেছিল। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছিল এই যে, পেঁচাটির বাচ্চা হয়েছিল এবং ওদের বাবা-মা নানারকম কীটপতঙ্গ, ব্যাঙ, টিকটিকি, ইঁদুর ইত্যাদি মেরে নিয়ে আসে ওদেরকে খাওয়ানোর জন্য। এর ফলে ভীষণ দূর্গন্ধ হয় এবং ব্যপারটা অস্বাস্থ্যকরও বটে। দিদির জিজ্ঞাসা ছিল _ওনার কি করা উচিত, পেঁচাটিকে রাখা উচিত না বাসা ভেঙে ফেলা উচিত!!
গুরুমহারাজ কোন উত্তর দিলেন না _শুধু বললেন _”লক্ষীপেঁচা!! বাচ্চা হয়েছে!! আমাকে একটা দিও তো! আশ্রমে নিয়ে গিয়ে রাখব!”
দিদি অবশ্য পেঁচার বাচ্চা আশ্রমে দেয় নি _উনি ও নেন নি।
যাইহোক, রাত্রিতে সবার শোবার ব্যবস্থা করা হয়ে গেলে আমি গুরুমহারাজের কাছে যেতেই উনি বললেন যে উনি বাথরুমে যাবেন। আর এর পরেই ঘটল আমার জীবনের অন্যতম লজ্জাজনক ঘটনাটি! যেটি এখনও মনে পড়লে আমি লজ্জিত হই, দুঃখ পাই, নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিই!
আমাদের বাড়ির পায়খানা-বাথরুম ছিল পুরোনো আমলের এবং তা ছিল বাড়ির সীমানার বাইরে! এর কারন হোল তখনকার মানুষের (আমার বাবা-জ্যাঠাদের) মানসিকতা ছিল _পূর্বপুরুষদের ভিটেয় পায়খানা-বাথরুম বানানো অপরাধ!
তখন পায়খানা যেতে হোলে বাড়ি থেকে টিউবওয়েল থেকে জল তুলে বালতি করে নিয়ে যেতে হোত_আবার ফিরে এসে কলতলায় গিয়ে হাত-পা ধুতে হোত।
বাথরুমে জল দেওয়া ছিল _কিন্তু যাতে ওনাকে টিউবওয়েলে যেতে না হয় সেইজন্য আমি এক বালতি জল নিয়ে বাড়ির বাইরে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। উনি বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এসে আমাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সস্নেহে বললেন _”কি রে! এই ঠান্ডার মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস!!” তারপর জল নিয়ে এসেছি দেখে উনি নিজেই মগ ডুবিয়ে জল নিতে যাচ্ছিলেন! আমি ওনাকে বাধা দিয়ে তাড়াতাড়ি মগটা জলভর্তি করে ওনার হাতে ঢেলে দিতে শুরু করলাম। কিন্তু এমন আহাম্মক আমি _উনি যে নিচুতে দাঁড়িয়ে, আর আমি একটু উপরে সিঁড়িতে! এই অবস্থায় আমার উচিত ছিল আর একধাপ নিচে নেমে এসে হাত নিচু করে, ওনার হাতে জল ঢালা! কিন্তু তা করি নি! বোকার মতো ওনার সাথে কথা বলতে বলতে জল ঢালতে শুরু করেছিলাম। এতে ওনার নিচের দিকের পায়ের কাছে গেরুয়া কাপড়ে জলের ছিটা লাগছিল। উনি তাড়াতাড়ি কাপড় টা একটু গুটিয়ে নিয়ে নিজেই ঝুঁকে আর একটু নিচু হয়ে গেলেন! ফলে আমাকেও নিচে নামতে হোল এবং নিচু হয়ে ঝুঁকতে হোল! কিন্তু আমার জন্য গুরুমহারাজের কাপড়ে জলের ছিটে লাগল _.. আমার এই আহাম্মকির যন্ত্রণা আমাকে আজও কুঁরে কুঁরে খায়! ভগবানের সেবা করা কি অত সহজ! আর তা কি সবার দ্বারা হয়!! (ক্রমশঃ)