পরদিন ১৬ই বৈশাখ রবিবার সকালে রবীনকে আমাদের গাভীগুলি ও তাদের বাছুরগুলিকে এমন সস্নেহে শ্রীহস্ত বুলিয়ে আদর করতে দেখলাম — মনে হল বিশ্বপিতা ও মাতার স্নেহ-মমতা তার মধ্যে দিয়ে ঝরে পড়ছে। তারপর চা-পানের পর জামাইবাবু (রঘুনাথ গাঙ্গুলী) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভগবান সম্বন্ধে কিছু বলুন।’ সঙ্গে সঙ্গে রবীন উল্টে জিজ্ঞাসা করল ‘আপনিই কিছু বলুন না – আমরা শুনি।’ এইভাবে উভয়ের মধ্যে এক মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠল এবং দীর্ঘক্ষণ ভগবৎ আলােচনা চলতে লাগল ।
মধ্যাহ্ন ভােজনের পর বহু ভক্ত সমাবেশে তাদের নানান ধরণের জিজ্ঞাসায় রবীন এমন প্রজ্ঞাপূর্ণ উত্তর দিতে লাগল—যেন মনে হল স্বয়ং কিশােরবেশী শুকদেব প্রাজ্ঞ ঋষিদের সামনে প্ৰবচন করছেন। বিকালে বাড়ির পরিজনদের সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতার পর বাড়ির ছােট ছােট ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে শিশুবৎ এমন আনন্দ করতে লাগল তখন তাকেও বাড়ির একজন শিশু বলেই বােধ হল। এদিন সন্ধ্যায় মায়ের মন্দিরে নাম-গানের পর রায়না থেকে মিহির বলে যে ছেলেটি এসেছিল যার সন্ন্যাস গ্রহণের পর নাম হয়েছিল স্বামী প্রজ্ঞানন্দ, সে বাউল গান ধরলে তার গানে মাতােয়ারা হয়ে স্বভাৰ বাউল রবীনও গান গাইতে শুরু করল। মায়ের আঙ্গিনা সঙ্গীতের মূর্ছনায় এবং আনন্দলহরীতে মুখর হয়ে উঠল। মধ্যমগ্রামের তৃষাণও সেইদিনই বনগ্রামে এসেছিল । মিহির ও তৃষাণের ব্যবহারে বাড়ির সকলেই খুব আনন্দিত হল। গভীর রাত পর্যন্ত ভগবৎ আলােচনা চলল। উপস্থিত সকলের ক্লান্তি নিজের মধ্যে নিয়ে সেই আনন্দময় পুরুষ কেবল সকলকে আনন্দই দান করতে লাগল।
পরদিন সকালে চা-পানান্তে রবীন আমাদের জিজ্ঞাসা করে বসল, ” বলুন তাে অধ্যাত্মভাবের আদি কবি কে ?” দিয়ে তিনি নিজেই উত্তর দিলেন—“চণ্ডীদাস।” তারপর চণ্ডীদাসের বহু অজানা কাহিনী এবং ঠাকুর-দেবতার সম্বন্ধে অদ্ভুত সব গল্প করতে লাগল। বেলা ৯টায় জাবুইগ্রামে ভক্ত বাবলুদের বাড়ীতে রবীন সহ আমরা কয়েকজন গেলাম। সেখানে খবর পাওয়া মাত্র অনেক ভক্তবৃন্দের সমাগম হল। শুরু হল ভগবৎ প্রসঙ্গ। বাঁধভাঙ্গা জলের ন্যায় অবিরাম ধারায় তাঁর শ্রীমুখে অপূর্ব ভগবৎ প্রসঙ্গ শুনে সকলেই আনন্দে আপ্লুত হয়ে গেল। তারপর সন্ধ্যা নাগাদ রবীন সহ আমরা বনগ্রামে ফিরলাম । রাত্রিতে রবীন নিজ জীবনের নানা ঘটনা ও মজার মজার গল্প বলে আনন্দ দিতে লাগল। রাত্রি ৯টা নাগাদ শুরু হল শ্যামাসঙ্গীত। মায়ের গান শুনতে শুনতেই জগদম্বার বালক একেবারে ভাবাবিষ্ট হয়ে গেল এবং বেশ কিছুক্ষণ পর তবে ঐ ভাব কাটল। এইভাবে এক দিব্যভাবের মধ্যে দিয়ে আনন্দমণ্ডিত দিনগুলি যেন দ্রুত শেষ হয়ে গেল ! (ক্রমশঃ )