গুরুমহারাজ: মূর্তিটি দক্ষিণ ভারত (অন্ধ্রপ্রদেশ) থেকে আনা হয়েছে, ওখানকারই একজন স্থপতি এটা করেছে। আমি নন্দিয়ালে(অন্ধ্রপ্রদেশ) সত্যমজিদের ওখানে থাকার সময়ে আমার ওই স্থপতি ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হয়। পরিচয় পাবার পর আমি ওনাকে এই ধরনের একটি কালী মূর্তি তৈরী করার কথা বলি। ভদ্রলোক এটি করতে সম্মত হলে আমি ওর নিজের ঘরের দেওয়ালে একটা sketch এঁকে দেখিয়েছিলাম যাতে ওর ব্যাপারটা বুঝতে বা মূর্তি তৈরী করতে সুবিধা হয়। পরে শুনেছি ওই স্থপতির ঘরে নাকি এখনো ওই diagram টা এখনো রয়েছে এবং ওই ব্যক্তি ওটাকেই পুজো করে! ওর বিশ্বাস এই মূর্তিটি করার পর থেকেই ওর দোকানের পসার খুব বেড়ে গেছে ফলে ওর আয়েরও উন্নতি হয়েছে।
সে যাই হোক মূর্তিটা যখন ভালো করে দেখেছো, তখন বলতো -এর বিশেষ্যত্ব কি? বলতে পারবে না তো? এটার বৈশিষ্ট বা বিশেষ্যত্ব হচ্ছে -একটাই পাথর খন্ড কেটে কেটে শিব, কালী, এমনকি মায়ের অস্ত্র শস্ত্র মুণ্ডমালা সবই প্রস্তুত করা হয়েছে! এই ধরনের মূর্তি পৃথিবীতে খুবই কম আছে। Black granite পাথর থেকে তৈরী এটা, মূর্তিটি তৈরী করার খরচ এবং ওতো ভারী (৫ কুইন্টাল) মূর্তি দক্ষিণ ভারত থেকে নিয়ে আসার ভাড়া ইত্যাদি বাবদ আশ্রমের অনেক টাকা খরচ হয়েছিল। তবে যে ব্যক্তি(স্থপতি) মূর্তিটা বানিয়েছিলো সে খুবই নিষ্ঠা সহকারে কাজটি করেছিল। শুদ্ধাচারে, ভক্তি সহকারে এবং নিরামিষ খেয়ে ও মূর্তির কাজ করতো। যেদিন উল্টোপাল্টা কিছু খেয়ে ফেলতো- সেদিন আর ওই কাজটিতে হাত দিতো না – অন্য কাজ করতো।
প্রথমটায় ভদ্রলোক এই ব্যাপারটায় খুব একটা গুরুত্ব দেয় নি! order টা পাবার পর ও একটা বড় পাথরে খোদাই করতে শুরু করে। বেশ কিছুটা কাজ আগানোর পর একদিন অসাবধানে ঘা মারার জন্য পাথর টা দু টুকরো হয়ে ভেঙে যায়। ও হতাশ হয়ে সব ঘটনা আমাকে জানালো। আমি বললাম_ চিন্তা করো না মায়ের ইচ্ছা নয় যে ওই পাথরে মূর্তি তৈরী হয়, তাই ফেটে গেছে। তুমি সন্ধান করো নিশ্চয় ই ভালো পাথরে পেয়ে যাবে।
ও খুঁজতে শুরু করলো, ওর এক বন্ধুর কাছে ভালো একটা পাথর ছিল – সেইটা নিয়ে এসে ও আবার কাজ শুরু করলো। আর যাতে কোন অনিষ্ট না হয়, তাই নিয়ম নিষ্ঠা সহকারে কাজ করার কথাটা ওকে বলে দেওয়া হয়েছিল – সেইটা ও পালন করতো। ওই কাজ টা করতে করতে ওর মধ্যে একটা তন্ময় ভাব আসত- সেই সময় ওর নানা রকম দর্শনও হোত, মাঝে মাঝেই ও আমার সাথে দেখা করতে যেত, আবার আমরাও ওর কাছে আসতাম কাজ কতটা আগালো_তা দেখতে।
ইতিমধ্যে ওর মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছিল, সেটা আমরা জানতাম না মূর্তির কাজ সম্পন্ন হবার পর আমি যখন ওখানে গেলাম(1988),ও আমার কাছে দীক্ষা প্রার্থনা করল। এরপর নানান ঘটনা__অত derails_এ যাচ্ছি না।
মূর্তিটির ওজন ছিল প্রায় ৫ কুইন্টাল। ১৯৮৮ সালে ওটা আনা হয়েছিল, আর মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বনগ্রামের মুখার্জী বাড়ির বর্তমান মন্দির নির্মাণের পর অর্থাৎ ১৯৯১ সালে। ওত ভারী মূর্তিটা বেদীতে টেনে নিয়ে যাওয়াই মুখার্জী বাড়ির লোকেদের কাছে দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছিলো। অনেক লোক ডেকে টেনে টেনে নিয়ে গিয়ে তবে মূর্তিকে বেদীতে স্থাপন করা হয়। তারপর কৃষ্ণনগর থেকে একজন ভালো ঠাকুর গড়ার কারিগর কে এনে রঙ করানো হয়।নাম দেওয়া হয়েছে মা “করুণাময়ী”। মা করুণাময়ী এখানে বালিকা মূর্তিতে বিরাজমানা। আমার নিজের ইষ্ট মা জগদম্বাও কুমারী বালিকা মূর্তিতেই আমাকে প্রথম দর্শন দিয়েছিলেন। সেই জন্যই এখানে ওই রূপ মূর্তি করা হয়েছে। দক্ষিণ ভারতে(অন্ধ্রপ্রদেশ ) আমাদের আশ্রমের দীক্ষিত সব পরিবার রয়েছে ওদের বেশির ভাগ মানুষেরই রঙ কালো। ওদের মধ্যে এক ভদ্র পরিবারের একটি বালিকার(তখন বালিকা ছিল)-মুখের দিকে তাকিয়ে আমার ইষ্টদেবীর সাদৃশ্য পেয়েছিলাম। ওই বালিকাটির মুখমণ্ডলের অবয়ব এঁকেই শিল্পীকে সেটা মূর্তিতে ফোটাতে বলেছিলাম – ও অনেকটাই চেষ্টা করেছে সেটা করার, কিন্তু পারেনি।
দ্যাখো, বনগ্রামের এই পীঠ টি কিন্তু খুবই প্রাচীন। পূর্বে পূর্বে এখানে বহু মন্দির তৈরী হয়েছিল- সেগুলি ধংস ও হয়ে গেছে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মূর্তিও তৈরি হয়েছে- সেগুলিও কালের গহ্বরে চলে গেছে।কিন্তু এই পীঠ টি নষ্ট হয়নি- এটা রয়ে গেছে। এখন আবার নতুন মন্দির তৈরি হলো এবং নতুন মূর্তি প্রতিষ্ঠা হলো। দ্যাখা যাক, এগুলির স্থায়িত্ব আবার কত বছর হয়।
এই মন্দিরের মালিকানাও বদল হয়েছে বার বার। এখন মুখার্জী পরিবার এবং ওনাদের আত্মীয় গাঙ্গুলীরা এর মালিকানায় রয়েছে।পূর্বে অন্য অন্য পরিবার এর পূজা পাঠ করেছে। পরবর্তীতে হয়তো আবার অন্য কোনো পরিবারের লোকেরা করবে। মা-কিন্তু থেকে যাবে, স্থান থেকে যাবে – এই জন্যই বলা হয় ‘স্থানমাহাত্ম্য’। তবে এতো হাজার বছরের পুরোনো এই মায়ের স্থান, এখানে কোনো সাধকের সিদ্ধিলাভ ঘটেছে এমন কথা কিন্তু শোনা যায়নি! শুধুমাত্র ন’কাকার(শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) ছোটবেলায় মায়ের দর্শন লাভ হয়েছিল। পরবর্তী কালে এই মাতৃস্থান কে কেন্দ্র করে আরও কত কি হবে -তার খবর একমাত্র ঐ মা-ই জানেন।