প্রশ্ন—পূর্ব পরিচ্ছেদে আপনি বললেন— বিভিন্ন লোক বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে কর্ম করে, কিন্তু ভক্ত ভগবানের জন্য অভিমানমুক্ত হয়ে কর্ম করেন। —এখন কোনটি অর্থাৎ কিরূপ কর্ম অভিমানমুক্ত ভগবৎ কর্ম বা হিতকর কর্ম এবং কিরূপ কর্মই বা অহিতকর কর্ম— এই ‘কর্ম রহস্য’ সম্পর্কে আপনি যদি বিস্তারিত আলোচনা করেন, তাহলে এই বিষয়টি সম্পর্কে আমার সম্যক ধারণা লাভ হয়।

উত্তর — প্রিয় আত্মন্‌ ! ‘কর্ম রহস্য’ সম্পর্কে আমি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করছি, তুমি একান্ত মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর কর্ম জীবনের লক্ষণ মানব যতক্ষণ জীবিত অবস্থায় থাকে ততক্ষণ মানবকে জীবন ধারণের জন্য কর্ম করতেই হবে—তা স্বেচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক।

শ্বাস-প্রশ্বাস, আহার, নিদ্রা, শৌচ ইত্যাদি কর্ম প্রতিটি মানবকে করতেই হয় এই কর্মগুলিতে ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন প্রশ্নই নেই । কিন্তু যেগুলি মানবের ইচ্ছাধীন কর্ম—সেই কর্মগুলি নির্বিচারে না করে নির্মল বুদ্ধি বা বিবেক দ্বারা যাচাই করে করা উচিত যা বিকম অর্থাৎ দুষ্কর্ম তা বর্জন করা এবং যা বিহিত কর্ম” বা ধর্মসংগত তা জীবনে যোজনা করা উচিত। যেমন বা সমষ্টির জীবনে অনুকূল এবং লোকহিতকর তাই ধর্ম সংগত বা সুকর্ম আর যা সমষ্টির জীবনের প্রতিকূল এবং লোকহিত-বিরোধী—তাই ধর্মবিরুদ্ধ বা দুষ্কর্ম | সুতরাং বিশুদ্ধ বিবেকের বশবর্তী হয়ে লোকহিতকর কর্মে আত্মনিয়োগ করা—এটাই হল কর্মযজ্ঞ ।

প্রিয় আত্মন্! নিঃস্বার্থ কর্মই ভগবানের শ্রেষ্ঠ উপাসনা । ভগবৎমুখী হয়ে কম করাই কম উপাসনা । কেউ কখনও ক্ষণিকের জন্যও কর্মশূন্য থাকতে পারে না, কারণ এই যে মনের বিচার বা বিশ্লেষণ —এটাও তো কম । – অর্থাৎ কায়-মন-বাক্য ও বুদ্ধি অনুযায়ী যা করবে তাই তো কর্ম । এমত অবস্থায় ভগবৎমুখী হয়ে যে কোন কর্ম করাই শ্রেয়ঃ।

শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যোগী অর্জুনকে বলেছেন—তুমি নিয়মিত কর্ম করতে থাক, কারণ অকর্মের অপেক্ষা কর্ম শ্রেষ্ঠ। অকর্ম। হলে শরীরযাত্রাও সিদ্ধ হবে না। অতএব তুমি কর্ম করতে থাক। শ্রেষ্ঠ পুরুষগণ যা করে থাকেন ; ইতর সাধারণ তাই অনুসরণ করে থাকে । সুতরাং শ্রেষ্ঠ পুরুষগণের ত্রিলোকে কোন কর্তব্য বা পাবার কিছু না থাকলেও তাঁরা সদা কর্ম রত থাকেন । যদি তাঁরা কর্ম ত্যাগ করতেন, তাহলে সাধারণ মানবগণও কর্ম ত্যাগ করত এবং কর্ম জগৎ উৎসন্নে যেত। সুতরাং মানবের সমস্ত সৎকর্ম ঈশ্বর-ইচ্ছানুযায়ী হয় এবং তা বিহিত বা ধর্ম সংগত কর্ম ৷

প্রিয় আত্মন্ ! মানবকে সৎ কর্ম করতে হবে নিরাসক্ত বা নিষ্কামভাবে। ফলের আসক্তি ত্যাগ করে যা কিছু কর্ম কর, তাই যোগ । অর্থাৎ ফলাসক্তি বিহীন কম ই প্রকৃত যোগযুক্ত কর্ম । তাহলে এখন তুমি বুঝতে পারছো যে, নিষ্কাম বা নিরাসক্ত কর্ম মানে নিরুদ্যোগ বা লক্ষ্যহীন কম নয় । নিষ্কাম কর্মের অর্থ ব্যক্তিস্বার্থহীনতা, কিন্তু উদ্দেশ্যহীনতা নয়। ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে পরার্থে অর্থাৎ বহুর হিতে—বহুর সুখে লোকহিতকর কর্ম ই নিরাসক্ত কর্ম । সুতরাং এখন তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারলে যে, নিষ্কাম কর্ম উদ্দেশ্যবিহীন কর্ম নয়, ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে সমষ্টির স্বার্থে লোকহিতকর বা কল্যাণমূলক কম ই হল নিষ্কাম কর্ম ।

সচরাচর সাধারণ মানব স্বার্থবুদ্ধির ঊর্ধ্বে চিন্তা করতে সক্ষম নয়, তারা স্বার্থজনিত কর্ম করতেই অভ্যস্ত ও তৎপর। কারণস্বার্থবুদ্ধির ঊর্ধ্বে থেকে কর্ম করা সাধারণ মানবের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে । যেখানে ব্যক্তিস্বার্থ আছে, সেখানেই মানব স্বার্থত্যাগ করতে কিঞ্চিৎ উদার, কিন্তু যেখানে তার নিজের কিঞ্চিং বা ক্ষুদ্র স্বার্থটুকুও নেই—সেখানে স্বার্থত্যাগ করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যক্তিস্বার্থের নানা অভিব্যক্তির বশবর্তী হয়ে মানব কর্ম করে থাকে—যেমন দারৈষণা, বিত্তৈষণা, লোকৈষণা ইত্যাদি । ব্যক্তিস্বার্থ ভাবনাহেতু মানবের বিবেক অবশ হয়ে থাকে। এইজন্যই ব্যক্তিস্বার্থ-সচেতন মানবের বিবেক অবশ, জ্ঞান সুপ্ত আর তার জন্যই সৎকর্মে বা লোকহিত কর্মে তারা অনুপ্রাণিত হয় না বা উৎসাহ পায় না।

কামনাশূন্য হয়ে কোন কর্ম-ই হয় না—কিছু না কিছু কামনা থাকবেই থাকবে, কারণ কামনাই কর্মের প্রাণশক্তি। যোগী বা সাধকের ভগবৎ দর্শনের বা আত্মোপলব্ধির কামনা থাকে । সংসার-বৈরাগীরও মোক্ষ কামনা থাকে । এখন এই কামনা দুই প্রকারের— শুদ্ধ ও মলিন । আপন ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার জন্য যে কর্ম-তৎপরতা তা মলিন কামনাজাত। আর ভগবৎ উদ্দেশ্যে সমষ্টির কল্যাণে পরহিত কর্ম ই শুদ্ধ কামনাজাত ৷

দেখ, কর্ম ছাড়া এই জগতে কেউ নেই । কর্ম করতেই হবে। প্রকৃতি সকলকে কর্ম করতে বাধ্য করবে। যা কিছু করবে তাই তো কর্মতা সকাম বা নিষ্কাম যাই হোক ।

যেহেতু প্রকৃতি কাউকেই ছাড়বে না। সেহেতু স্বার্থবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে সমষ্টির অনুকূল হিতকর কর্ম করা উচিত। যিনি প্রকৃত সাধু, তিনি নিজ স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সমষ্টির অনুকূল কল্যাণকর্মেনিজেকে নিয়োজিত করে থাকেন।

এখন যদি বল প্রকৃত কাকে বলছেন ? তাহলে বলতে হয় — যিনি সদাচার-সম্পূর্ণ, আত্মজয়ী, পরোপকারী, স্বার্থবুদ্ধিরহিত ও প্রেমিক তিনিই প্রকৃত সাধু।

প্রিয় আত্মন্ ! নিষ্কাম বা নিরাসক্ত কর্ম করলে অধ্যাত্ম চেতনার বিকাশ ও উন্মেষ হয়। স্বার্থপর কপট যারা, তাদের দোষ দেখে সৎকর্ম বা মহৎ কর্ম হতে বিরত থাকা ঠিক নয়। সৎকর্মে অনুপ্রাণিত হও। স্বার্থপরদের দোষ দেখবে না, কারণ তারা হতভাগ্য—নিশ্চয় তারা পরমেশ্বরের করুণার পাত্র । এই জন্য তাদের প্রতি সহৃদয় হও–তাদের ভালবাসতে থাক । তাহলে দেখবে তারা অচিরেই দোষক্ত হবে। এ আর জোর করে কাউকেই দোষমুক্ত করানো যায় না । স্বেচ্ছায় তাদের মধ্যে ত্যাগের প্রেরণা না এলে, স্বার্থপর মানব কোনদিন স্বার্থত্যাগ করতে পারে না। আবার জোর করে কোনদিন বা কখনও কারও চরিত্র বদলানো বা পরিবর্তন করা যায় না । কেউ যদি ভুল করে তাহলে তর্ক করে কিংবা বিতণ্ডা করে অথবা বল প্রয়োগের দ্বারা তার ভুল সংশোধন করতে পারবে একমাত্র হৃদয় দ্বারা সহানুভূতি দ্বারা ভালবেসে তাদের ভুল সংশোধন করতে পার—নতুবা সম্ভব নয়। ভালবাসা এবং সহানুভূতি দ্বারা মানবের বিবেক জাগ্রত হবে এবং বিবেক জাগ্রত হলে স্বার্থবুদ্ধি ক্রমশঃ ধীরে ধীরে লোপ পাবে। আর মানব তখনই সৎকর্মেঅনুপ্রাণিত হবে ।

এখন ঐ সৎকর্ম বা মহৎ কর্ম করবার জন্য প্রয়োজন সুস্বাস্থ্যের জ্ঞান অর্জন এবং শুকর্ম করতে হলেও সুস্বাস্থ্যের একান্ত আবশ্যক । সেহেতু সুস্বাস্থ্য মানবের একান্ত কাম্য। সমষ্টির কল্যাণের জন্য কর্ম করতে হলে সুস্বাস্থ্যের বা মজবুত দেহের প্রয়োজন। সুস্বাস্থ্য গড়ে তোলার জন্য ব্যক্তিকেই উদ্যোগী হতে হবে

প্রিয় আত্মন্, দেখ, কেহ যদি উপার্জনে অক্ষম হয়, তাহলে সেই ব্যক্তি সমষ্টির বোঝা হয়ে দাড়ায় এবং যে সদসৎ জ্ঞানলাভ না করে, সেও সমষ্টির কোন কল্যাণকর্মে লাগতে পারে না। সুতরাং স্বাস্থ্যগঠন, উপার্জন এবং জ্ঞানার্জন—এগুলি ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং উদ্দেশে হলেও সমষ্টির কল্যাণকারক অ অতএব শরীর সুস্থ রাখা মানবের একান্ত কর্তব্য, তা না হলে জ্ঞানালোক উজ্জ্বল রাখা খুবই কঠিন। । ভগ্নস্বাস্থ্য—শ্রমকাতর—অলস যারা, তারা শুধু নিজেই নিজেদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে না, সমষ্টির জীবনও তাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অলস এবং অবসন্নচিত্ত—নির্বীর্য মানব কখনও সৎকর্ম ও ধর্ম লাভ করতে পারে না । তেজোদীপ্ত—শক্তিমান এবং দৃঢ় চরিত্র-সম্পন্ন বিবেকীরা একমাত্র পরহিতে কল্যাণকর্ম করতে পারেন । অলসতা জীবনকে পঙ্গু করে ফেলে এবং অলস জীবনেই যত অসৎ চিন্তা ও কুকর্মের প্রবণতা অলস জীবনই বিশেষ করে কুকর্মে আসক্ত। অলস এবং শ্রমবিমুখরা তাদের জীবনে ইহলোকে এবং পরলোকে আপন সর্বনাশ ডেকে আনে

প্রিয় আত্মন্‌ ! স্বার্থভাবনা বিসর্জন দিয়ে সমষ্টির কল্যাণে আত্মনিয়োগ কর। কারণ প্রত্যেককে আপন আপন কর্মের জন্য দায়ী হতে হবে। একের দুষ্কর্ম বা অপরাধের ফল অন্য কেউ ভোগ করবে না বা অন্যে এর জন্য দায়ী হবে না। প্রত্যেকে আপন আপন কর্মানুসারে ফলভোগ করে থাকে। এই জন্য বিড়ম্বনা না করে এবং লোকদেখানো কর্ম না করে পরমেশ্বরে বুদ্ধি স্থির করে সৎকর্ম এবং ধর্মসংগত কর্মে আত্মনিয়োগ কর। সকলের কল্যাণের সঙ্গে তোমাদের কল্যাণও নিহিত আছে কারণ

এখন তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারলে যে—কর্তার বা কর্মীর বুদ্ধির ওপর কৃতকর্মের শুভাশুভ ফলাফল নির্ভর করে। আর প্রতিটি কর্মের শুভাশুভ ফলাফল নিশ্চিত ।

প্রিয় আত্মন্ ! সমস্ত কর্ম ই কালের মধ্যে । কোন কর্ম ই কালরাজ্যের বাইরে নয় । আর এই কালের অধিপতি হলেন ঈশ্বর । এই বিশ্বটা কার্য-কারণের আবর্তন। কার্য সম্পূর্ণ হয় কালের আয়ত্তে—কালের বহির্ভূত কোন কার্যই নেই।

মানব যখন অহংবুদ্ধিবশতঃ কর্ম করে অর্থাৎ ‘আমি কর্ম করছি’ —এরূপ বুদ্ধি নিয়ে কর্ম করে, তখন সে অহংবুদ্ধি হেতু সুকর্মে র সুফল এবং কুকর্মের কুফল কর্মের অভিমানবশতঃ ভোগ করে থাকে । মানব পাপ এবং পুণ্যের যথাক্রমে দুঃখ ও সুখ ভোগ করে থাকে অজ্ঞান-অবিদ্যাহেতু । ভ্রান্তিবশতঃ ‘আমি করছি’—এরূপ অভিমানহেতু সুখ-দুঃখের কর্ম ফল ভোগ করে থাকে। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানী বা প্রকৃত প্রেমিক অভিমানশূন্য হয়ে ভগবদ্‌বুদ্ধিবশতঃ কর্ম সম্পন্ন করে থাকেন। তাঁরা ব্যক্তিস্বার্থ রহিত এবং অহংকারে উদাসীন হয়ে স্ব-ইচ্ছায় শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে ঈশ্বর-ইচ্ছায় কর্ম রত থাকেন । যিনি ভগবৎ ইচ্ছায় কর্ম সম্পন্ন করেন এবং আমিত্বের অভিমান শূন্য—তাঁকে কর্মের শুভ বা অশুভ ফলভোগ করতে হয় না। তিনি কর্ম মুক্ত, শুধুমাত্র কর্মে র জন্যই কর্ম করেন। —এই হল কর্মরহস্য বা কর্মযোগ।