প্রশ্ন :–অনুগ্রহ করে এখন আপনি সত্য বা আত্মতত্ত্ব বোধের ক্ষেত্রে কি অন্তরায় এবং কিভাবে আত্ম-বোধ করা যেতে পারে –এই সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেন তো খুবই উপকৃত হই ?
উত্তর :–প্রিয় আত্মন্–তোমার স্বরূপের মধ্যেই সনাতনত্ব বা অমরত্ব নিহিত আছে। বিশুদ্ধ মন বা প্রজ্ঞার সাহায্যে যে কোন বস্তুকে অনন্তকালের পরিপ্রেক্ষিতে দর্শন করতে পারো ।
মানব যতই প্রকৃতির কার্যকারণ শৃঙ্খলা বুঝতে পারবে, ততই অনাবশ্যক জিনিসের বন্ধন হতে মুক্ত হবার সামর্থ্য্য অর্জন করবে। মানুষের মন যখন অনিত্য বা অচির বস্তুর প্রতি নিবদ্ধ হয়, তখনই মানবের জীবনে আসে নানারকম দুঃখ-কষ্ট এবং অতৃপ্তি-অসন্তোষ । মানবের কাম্য বিষয়টি যদি অপরিবর্তনীয় এবং চিরন্তন সত্তা হত, তাহলে মানবের আবেগকে প্রশমিত করত। কিন্তু মানবের কাম্যবস্তু যেহেতু ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হচ্ছে— যেহেতু তার কোন চিরন্তন সনাতন সত্তা নেই, সেহেতু মানব বিভিন্ন আবেগের দ্বারা বিক্ষুব্ধ হচ্ছে।
প্রিয় আত্মন্—মানব রাগ, দ্বেষ, ঘৃণা, হিংসা, ভয় প্রভৃতি আবেগের দ্বারা তাড়িত হয়ে কখনও উৎফুল্ল – কখনও বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। ফলে প্রকৃত জীবনের আনন্দ কি এবং শান্তি কি তা অনুভব করতে পারে না। আবেগপাশে আবদ্ধ মানবের বিভ্রান্তিকর অবস্থা ! মানবের পরম লক্ষ্য সন্বন্ধে অজ্ঞতাই বন্ধনদশার একমাত্র কারণ ।
প্রিয় আত্মন্ ! পরিদৃশ্যমান জগতের প্রতিটি বস্তুই সসীম। প্রতিটি বস্তু অপর একটি বস্তু কর্তৃক উৎপন্ন এবং এইভাবে একটি অনন্ত কার্য-কারণের শৃঙ্খলাবর্তনে আবর্তিত হচ্ছে প্রত্যেকটি বস্তুজগৎ ।
সুতরাং যখন তোমার মনে হচ্ছে যে, তুমি একটি বাহ্য-বস্তুকে প্রত্যক্ষ করছ, তখন প্রকৃতপক্ষে তুমি তোমার দৈহিক অবস্থার একটি সংবেদন পাচ্ছ। আর এই সংবেদন দৈহিক অবস্থার দরুণ সৃষ্ট হয়েছে এবং দৈহিক অবস্থা আবার একটি বস্তু ও তোমার ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দ্বারা উৎপন্ন হয়েছে। যেহেতু সংবেদন দুটি উপাদানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল, সেহেতু এই সংবেদন কোন উপাদানকে সঠিকভাবে তোমার সম্মুখে তুলে ধরতে পারে না । অতএব ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতামাত্রই অসম্পূর্ণ বা অস্পষ্ট।
প্রিয় আত্মন্—বিবেকহীন মনে অস্পষ্ট ধারণা সকল বিদ্যমান । আর মনের মধ্যে অস্পষ্ট ধারণা যত বেশী থাকে, মন ততই আবেগের দ্বারা তাড়িত হয় । অস্পষ্ট ধারণা হতেই কামনার উদ্ভব হয় এবং তখন তা প্রবল আবেগরূপে আবির্ভূত হয়। কিন্তু যদি বিবেক জাগ্রত থাকে, তাহলে মনের অস্বচ্ছ বা অস্পষ্ট ধারণাগুলি স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন নির্মল অন্তঃকরণে জাগতিক কামনার আবির্ভাব হয় না। নির্মল অন্তঃকরণেই ভগবৎ প্রেমের আবির্ভাব হয় এবং সংসারাবেগের বা বাসনার প্রভুত্ব হ্রাস পায় – মানবজীবনে প্রেমের আসন সুদৃঢ় হয় ।
প্রিয় আত্মন্ ! চিরস্থায়ী—শাশ্বত—অখণ্ড সত্তাই যখন আপন মহিমায় সসীম সাকাররূপ পরিগ্রহ করে প্রকট হন, তখন সেই নাম-রূপ-আনন্দময় সাকার সচ্চিদানন্দ বিগ্রহকেই ভগবান বলা হয়। আর তাঁর প্রতি প্রীতি বা ভালবাসা হতেই কেবল দুঃখ-ক্লেশহীন আনন্দ ও শান্তিময় জীবন পাওয়া যেতে পারে । যিনি প্রকৃতই ভগবানকে ভালবাসেন, তিনি কখনই তাঁর নিকট হতে ভালবাসা চান না। তিনি ষোলআনা মন দিয়ে ভগবানকে ভালবেসে আনন্দ পান – শান্তি পান ।
প্রিয় আত্মন্—আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি। আমি অনুভব করি, অতএব আমি আছি । এই ‘আমি’ কি এবং কে ? সমস্ত কিছুকে সংশয় বা সন্দেহ করা যেতে পারে, কিন্তু সংশয়কর্তার অস্তিত্বে কখনই—কোনমতে সংশয় বা সন্দেহ করা যায় না। সুতরাং সত্যবোধ করবার জন্য নিজের প্রজ্ঞা বা বোধের উপর নির্ভর করাই সমীচীন । কারণ ধর্মশাস্ত্র এবং ধর্মালোচনার ভিতর দিয়ে এক ধরণের মানসিক সুখ ও তৃপ্তি লাভ করা যেতে পারে, কিন্তু নিঃসন্দিগ্ধ সত্যকে জানা যায় না । আর দার্শনিকদের মধ্যে সত্যের স্বরূপ সম্বন্ধে বাদ-বিতণ্ডার অন্ত নেই এবং ঐ দার্শনিকদের মতবাদ নিয়েই সাধারণ মানব বাদ-বিতণ্ডা, তর্ক-বিতর্ক ও বিবাদ করে থাকে ।
প্রিয় আত্মন্—বিবেক-আশ্রয়ী হও। বিবেককে অবলম্বন করলে প্রকৃত সত্যের মর্মকে উদ্ঘাটন করতে পারবে। সুতরাং বিবেককে আশ্রয় করাই শ্রেয়।
এই সংসারে আবেগ-তাড়িত ভাবাবেগসম্পন্ন ভাবপ্রধান মানবই অধিক । তাছাড়া তর্কবাদী বুদ্ধিপ্রধান মানবগণও আছেন, কিন্তু সংখ্যায় এঁরা প্রথমটির তুলনায় কম। আর বিবেক প্রধান মানব খুবই কম দেখতে পাওয়া যায়। এই বিবেক প্রধান মানবগণই প্রকৃত অধ্যাত্ম পথের যাত্রী।
তাই বিবেককে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ভাবাবেগসম্বল করে Site ভাবালুতার আবেগে নিজেকে ভাসালে প্রতারিত হতে হবে। আবার কেবল যুক্তি-তর্ক করে বুদ্ধির কচকচি দ্বারা শুধু তর্ক-বিতর্ক হয়। এটাও আত্মবিড়ম্বনা ছাড়া আর কিছু নয় ।
এইজন্য বিবেককে আশ্রয় করতে হবে। বিবেককে অবলম্বন কর—ভাবকে পরিণত কর শ্রদ্ধায়। অর্থাৎ শ্রদ্ধাভাবাপন্ন হও শ্রদ্ধাহীন হয়ো না । শ্রদ্ধা হারালে মানবের অশান্তির সীমা থাকে না । আর বুদ্ধিকে প্রয়োগ কর সৎ বিচারে। অর্থাৎ বৃথা বিতর্ক না করে প্রকৃত সৎ বিষয়ে চিন্তা করা বা বিচার করা উচিত।
প্রিয় আত্মন্ ! বিবেককে অবলম্বন কর এবং শ্রদ্ধাভাব ও বুদ্ধিকে সঠিক সময়ে উপযুক্তভাবে ব্যবহার কর।
শ্রদ্ধাযুক্তচিত্তে বিবেক অবলম্বন করে বুদ্ধি দ্বারা কিরূপ সঠিক চিন্তা করা যায়—তার একটি নমুনা বা উদাহরণ দেওয়া হল ।
আমি কি ? – তা আমি জানি না । কিন্তু আমি যে আছি এবং আমার যে অস্তিত্ব রয়েছে—এ বিষয়ে আমি সুনিশ্চিত, আমার অস্তিত্বে কোনরূপ সন্দেহ প্রকাশ করা অসম্ভব । কারণ সন্দেহ করতে হলে যিনি সন্দেহ করছেন অর্থাৎ সন্দেহকর্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে হয়। কিন্তু তা অসম্ভব।
সুতরাং এই যে ‘আমি’– যার অস্তিত্বে কোনরূপ সন্দেহ করা চলে না—তার স্বরূপ কি ? প্রিয় আত্মন্ !
প্রজ্ঞার আলোকেই আত্মার অস্তিত্বকে বোধ করা যায়। প্রকৃত আত্মচৈতন্ত্রের ভিতরই ‘আমি’র অস্তিত্বের জ্ঞান নিহিত আছে । আর এর জন্য কোন প্রমাণের প্রয়োজন হয় না । স্বতঃস্ফূর্ত সহজ এবং স্বাধীন । এই জ্ঞান
যেহেতু আমার সম্বিতের মধ্যেই রয়েছে আমার অস্তিত্বের জ্ঞান—আত্মসত্তার মধ্যেই নিহিত আছে আত্মজ্ঞান, এইজন্য একমাত্র আত্মজ্ঞান দ্বারাই আত্মার অস্তিত্বের বোধ হয়। একেই বলা হয় বোধে বোধ – আত্মবোধ বা আত্ম সাক্ষাৎকার ।
প্রশ্ন – এখন যদি আপনি অনুগ্রহ করে আবেগের দাসত্ব থেকে মানব কিভাবে মুক্ত হবে এবং এক্ষেত্রে বিবেকের কি ভূমিকা –এই সম্পর্কে আলোচনা করেন তাহলে খুবই উপকৃত হই ।
প্রিয় আত্মন্ । মানুষ যখন তার চেতনার এমন স্তরে উপনীত হবে, যখন সংসারের প্রতিটি ঘটনাকে মহাকালের পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে পারবে—বিচার করতে পারবে ; যখন বুঝতে পারবে ঘটনাসমূহ অনিবার্যভাবে মহাকালের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে চলেছে, তখন আর মানব ঘটনাসমূহ নিয়ে বিব্রত বা বিচলিত হবে না ।
আবেগের দ্বারা মানবগণ বিক্ষুব্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত । এই আবেগের কাছে মানব অসহায় ও ক্রীড়নকে পরিণত হচ্ছে । এই ব্যাপারটি সম্বন্ধে যখন মানব সুস্পষ্ট ধারণা করতে পারবে, ঠিক তখনই তা আর মানবকে বিক্ষুব্ধ ও বিচলিত করতে পারবে না ।
প্রিয় আত্মন্ ! উপনিষদে ঋষি বলেছেন—’আত্মানং বিদ্ধি’ -অর্থাৎ আত্মাকে জান । আর নিজেকে জানাই হল আধ্যাত্মিকতার মূল উদ্দেশ্য । আত্মজ্ঞান লাভ না করলে মানব জীবনের পূর্ণতা আসে না । সুতরাং নিজেকে না জানাই মানবজীবনের অপূর্ণতা ।
চিত্তাবেগের অধীনতাই হল বন্ধন। যতক্ষণ মানবের কামনা নশ্বর বস্তুর প্রতি বা অনিত্য বিষয়ের প্রতি ধাবিত হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত মানব বাহ্য বিষয়ের এবং পরিবেশের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। সুতরাং বিবেকের সক্রিয়তায় এই বন্ধন হতে মুক্তি বা স্বাধীনতা লাভ করতে হবে ।
বিবেক জাগ্রত হলে মানব তখন সুস্পষ্ট ও সঠিকভাবে চিন্তা করতে সমর্থ হয়। নিত্যানিত্য বিবেক বা বিচারবোধ জাগ্রত হলে অনিত্য নশ্বর সীমিত বিষয়ের প্রতি আর মন ধাবিত হয় না । আর তখনই এই বন্ধনদশা হতে মুক্তি বা স্বাধীনতা লাভ ঘটে ।
বিভিন্নমুখী বায়ুতাড়িত তরঙ্গের মতো চিত্তাবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়ে মানবসকল তাদের কার্যের পরিণাম কি তা বুঝতে অসমর্থ হয়ে পড়ে এবং নানারকম জটিল কর্ম-আবর্তে জড়িয়ে পড়ে। আর কর্মবিপাকে পড়ে নানারকম সুখ-দুঃখ এবং স্ফূর্তি-ক্লেশ ইত্যাদি ভোগ করে থাকে। আপন চিত্ত সংস্কারবশত অনুকূল পরিস্থিতিতে সুখ ও স্ফূর্তি এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দুঃখ ও ক্লেশ ভোগ করে থাকে।
মানুষের কর্মপ্রেরণা চিত্ত-সংস্কার আবেগ দ্বারা প্রেরিত এবং ঐ চিত্তাবেগ ক্রমে ইচ্ছা-অনিচ্ছা ইত্যাদি বৃত্তি দ্বারা মানবের কর্ম করার ইচ্ছাকে জাগ্রত করে । ক্রমে ঐ ইচ্ছা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানবের ইন্দ্রিয়সকল কর্ম করে থাকে ।
সুতরাং অবিবেক অর্থাৎ বিবেকহীন চিত্তাবেগ ও কর্মপ্রবৃত্তি হতে মুক্তিই মানবজীবনের স্বাধীনতা
প্রিয় আত্মন্ ! বিবেকহীন অসংযত ও অসম্পূর্ণ চিত্তাবেগ হতে মুক্তি—এটাই চিত্তবৃত্তি নিরোধ অবস্থা। চিত্তবৃত্তি নিরোধ হলে সমাধি অবস্থা উপস্থিত হয়। এই সমাধি অবস্থাতে প্রকৃত আত্ম- স্বরূপের জ্ঞান হয়। আর এই পূর্ণ পরম সত্য একবার হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেই সমস্ত অজ্ঞান ও অবিদ্যার নাশ হয় ; দ্বিতীয়বার আর ভ্রান্তি উপস্থিত হয় না।
বিবেকহীন অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত অভিজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা হতেই আবেগ-বিক্ষেপের সৃষ্টি হয়। প্রজ্ঞার সাহায্যে মহাকালের পরি- প্রেক্ষিতে প্রকৃত সত্য সম্পর্কে যখন মানবের সঠিক জ্ঞান হয়, তখনই মানব চিত্তের এই আবেগ-বিক্ষেপ হতে স্বাধীন হয়। আবেগ- বিক্ষেপ-মুক্ত শান্ত সমাহিত চিত্তে তখন স্বরূপের বোধ হয়। আর তখনই হয় প্রকৃত আনন্দ এবং শান্তির বোধ। মানব আবেগের দাসত্ব হতে স্বাধীন বা মুক্ত হয়। জীবনের মুক্তি বা স্বাধীনতা ।
প্রিয় আত্মন্ ! একমাত্র তখনই এটাই মানবচিত্তের উত্তেজনা মনকে চঞ্চল করে এবং মনের চাঞ্চল্যই দেহকে সক্রিয় করে নানাবিধ দৈহিক কার্য ঘটিয়ে থাকে। এইভাবে বুদ্ধি-মন-প্রাণ-দেহকে আশ্রয় করে অহংকার কর্ম করে থাকে । কিন্তু আত্মা চৈতন্য—সাক্ষীস্বরূপ—সমস্ত ঘটনার সাক্ষীস্বরূপ—সমস্ত অনুভবের অনুভবী—বিজ্ঞাতাস্বরূপ—সমস্ত দৃশ্যের দ্রষ্টাস্বরূপ—সৎ-চিৎ-আনন্দ ।
প্রিয় আত্মন্–এই আত্মার অস্তিত্ব তোমার স্বরূপেরই অন্তর্গত ।তাই নিজেকে জান, তাহলেই জানতে পারবে প্রকৃত আত্মতত্ত্ব কি ।
এই আত্মার অস্তিত্ব, মানা বা না মানার উপর নির্ভর করে না, যা জানা বা বোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং মানা বা না মানা—এগুলি বাদ-বিতণ্ডা বা বুদ্ধির কচ কচি। স্বরূপের বোধের মধ্যে দিয়েই আত্মতত্ত্বকে জানা যায় ।
প্রিয় আত্মন্ -অন্তর্মুখী হয়ে নিজেকে জানবার চেষ্টা কর। নিজেকে জেনেই আত্মাকে জানা যায়। কারণ তুমিই সেই পরম আত্মসত্তা। আর আত্মার অস্তিত্ব তোমার স্বরূপেরই অন্তর্গত বলে স্বরূপের জ্ঞানেই আত্মজ্ঞান হয়ে থাকে।
উপনিষদ বলেন –‘আত্মানং বিদ্ধি’ অর্থাৎ আত্মাকে জান। এই আত্মাই ব্ৰহ্ম । আত্মা উপাধিরহিত (Passive)। কোন নাম-রূপ উপাধির বিশেষণ দ্বারা তাকে বিশেষিত করা যায় না— যদি তা করা হয় তাহলে তার পূর্ণ সত্তার খর্বতা সাধিত হয় । অর্থাৎ তাকে সীমাবদ্ধ করা হয়। সুতরাং ব্রহ্ম বা আত্মা অখণ্ড – অদ্বৈত তত্ত্ব।
প্রিয় আত্মন্ ! এই শাশ্বত সত্তাকে একও বলা যায় না, কারণ এককে সংখ্যাবাচক মনে করা যেতে পারে এবং সেই ক্ষেত্রে একের বিপরীত বহুর অস্তিত্ব আছে। সুতরাং ব্রহ্ম নিজেই নিজের কারণ—সনাতন এবং অখণ্ড । কোন সসীম নামে তাকে অভি- হিত করলে, তাকে সসীমে পরিণত করা হয়। এইজন্য ব্রহ্ম সম্বন্ধে নেতিবাচক উক্তিই হতে পারে।
ব্রহ্ম সকল জিনিসের চিরস্থায়ী সত্তা। এই দৃশ্যমান জগতের পিছনে যে নিত্য শাশ্বত—সনাতন সত্তা বিরাজমান ত-ই ব্রহ্ম ।
প্রিয় আত্মন্ !—এই আত্মা স্বয়ম্ভূ — অর্থাৎ সত্তা যার স্বরূপের অন্তর্গত। এইজন্ম আত্মা নিজেই নিজের কারণ। আত্মা শাশ্বত সনাতন — নিত্য সত্তা, যা শুদ্ধ—বুদ্ধ— মুক্ত সচ্চিদানন্দ ।
এই আত্মা অসীম-অনবদ্য, কখনই সসীম হতে পারে না।কারণ সীমাবদ্ধতার অর্থ ই হল পরনির্ভরতা এবং যা পরনির্ভরশীল, তা কখনই সনাতন সত্তা হতে পারে না । পরম সত্য অদ্বিতীয়- অখণ্ড। অখণ্ড’র বহুত্ব অসম্ভব। যা একের বেশী অসীম সত্তা থাকতে পারে না। সুতরাং অসীম তথা অখণ্ডের কেবলমাত্র একটিই অস্তিত্ব থাকতে পারে। যদি একাধিক অস্তিত্ব থাকত, তাহলে তারা পরস্পর পরস্পরকে সীমাবদ্ধ করত এবং যা সীমাবদ্ধ, তা কখনই অসীম, অখণ্ডসত্তা হতে পারে না।
প্রিয় আত্মন্, যে সমস্ত সসীম পদার্থ বা বিষয় আমরা ইন্দ্রিয় সাহচর্যে অনুভব করে থাকি, সেইগুলির অস্তিত্বের জন্য একটি স্বয়ংসিদ্ধ—স্বাধীন— অসীম — অখণ্ড সত্তার প্রয়োজন। আর সেই সত্তার উপরই যাবতীয় সসীম পদার্থ সকলের অস্তিত্ব নির্ভর করে ।
এইজন্য প্রত্যেক সসীম পদার্থের সত্তা ঐ অসীম, অখণ্ড সত্তাতেই নিহিত। আর ঐ অখণ্ড সত্তাই পরম সত্য—যা শাশ্বত -সনাতন—পরম ব্রহ্ম।