প্রিয় আত্মন্ !

ব্রহ্ম বা পরমেশ্বর অখণ্ড এবং অদ্বৈত তত্ত্ব। তিনি সর্ব মূলা- ধার, অপরিণামী, অপরিবর্তনশীল, চিরন্তন, শাশ্বত এবং সনাতন । আর চরাচর বিশ্বজগৎ অনাদি, কিন্তু চিরন্তন নয় । এটা ষট্‌বিকার— (প্রাগোৎপত্তি, উৎপত্তি, প্রবৃদ্ধি, রূপান্তর, ক্ষয় ও লয় দ্বারা সর্বদা পরিমাণশীল। দেশ ও কালের মধ্যে দিয়ে সদা রূপান্তরিত ও পরিবর্তিত হয়ে চলছে । এই চরাচর বিশ্বজগৎ গতিশীল—সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়ের আবর্তন দ্বারা আবর্তিত হচ্ছে।

সুতরাং বুঝতে পারছ যে, বিশ্বজগৎ অনাদি হলেও চিরন্তন নয়, কারণ এটা পরিণামী আর ব্রহ্মই এবং সনাতন ও সমস্ত কিছুর মূলাধার । একমাত্র চিরন্তন, শ শাশ্বত

প্রশ্ন—তাহলে এই জগতের উদ্ভব কেমন করে সম্ভব হয় ?— আপনি অনুগ্রহ করে এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করুন ।

উত্তর—প্রিয় আত্মন্ ! এই জগৎ-সংসারের উদ্ভবের মূলে চিন্ময় পরাবাক্ প্রণব । সৃষ্টির পূর্বে বিশ্বসংসারের মূল স্বরূপ পরাবাক্ প্রণব অস্ফুটভাবে ব্রহ্মে অবস্থান করে। এই প্রণবই সমস্ত জগতের কার্য-কারণের মূলে —মহাকারণ স্বরূপ।

অব্যক্ত অবস্থা হতে প্রথম প্রণব ব্যক্ত হয়। এইজন্য প্রণব হল মহাবিশ্বের আদিকারণ বা আদিনাম এবং আদিরূপ । অস্ফুট অবস্থা হতে স্ফুটতত্ত্বে প্রণবের প্রকাশই হল বিশ্বসংসার। এইপ্রণবের সঞ্চালন ক্রিয়াই সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়রূপে আবর্তিত হচ্ছেআর প্রণবের আবর্তনই বিশ্বসংসাররূপে প্রতিভাসিত।

চিন্ময় পরাবাক্ প্রণবই ব্রহ্মের প্রকৃতি। প্রণবের অবরোহ এবং আরোহক্রমে একটিআবর্তন বা কল্প সম্পূর্ণ হয়। প্রণবের অবরোহ গতিতে বিস্তার হল সৃষ্টি, যথাক্রমে পরা, পশ্যন্তি, মধ্যমা ও বৈখরীরূপে। আর প্রণবের আরোহ গতিতে সংকোচই হল প্রলয় । যা যথাক্রমে বৈখরী, মধ্যমা, পশ্যন্তি হয়ে পরাবাকে পুনরায় লীন হয় । এই সৃষ্টি ও প্রলয়ের মধ্যবর্তী অবস্থাকে স্থিতি বলা হয় ।

সুতরাং প্রণবের ক্রমবিকাশে হয় সৃষ্টি, ক্রম-সংকোচে হয় প্রলয় এবং মধ্য অবস্থা হল স্থিতি। আর এইভাবে প্রণবের সঞ্চালনেই সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়রূপ জগৎ-সংসার ত্রিগুণের প্রবাহ দ্বারা আবর্তিত হচ্ছে।

প্রিয় আত্মন্ ! এই প্রণবই সমস্ত কিছু ব্যাপ্ত হয়ে আছে, কারণ সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় চিন্ময় পরাবাক্ প্রণবেরই বিস্তার বা আবর্তন ।

সুতরাং এই চরাচর বিশ্বসংসার ব্রহ্ম বা পরমেশ্বরের প্রকাশ । ব্রহ্ম বা পরমেশ্বর হতে প্রথমে আদিশব্দ পরাবাক্ প্রণব আবির্ভূত হয় । এই জন্য পরমেশ্বরের বাক্যই প্রণব। তিনি অনামী হয়েও তাঁর নাম আছে আর তা হল আদিশব্দ – পরাবাক্ প্রণব । এই চৈতন্যময় পরাবারূপ প্রণবই হল মহাকারণ । বিশ্বসংসাররূপে সমস্ত কিছুই এই পরাবাক্ মহাশক্তির পরিণাম । পরাবারূপ আদিশক্তিই বিশ্বচরাচর সর্বভূতে বিরাজমান । যা জড়-বিশ্বরূপেদেখছ, তাও চৈতন্যময়তারই প্রকাশ ।

প্রশ্ন—এখন আপনি যদি অনুগ্রহ করে পরাবাক্ চৈতন্যময় প্রণবের অস্ফুট অবস্থা হতে স্ফূট অবস্থায় প্রকাশের ব্যাপারটি আরো একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন, তাহলে আমার পক্ষে বুঝবার খুবই সুবিধা হয়।

উত্তর—প্রিয় আত্মন !মহাকারণ অস্ফূট অবস্থা হতে স্ফূটতত্ত্বে (স্ফূট ব্রহ্মে) প্রকাশিত হচ্ছে ৷ অব্যক্ত অবস্থা হতে অভিব্যক্ত হয়ে ব্যক্ত স্থূল বিশ্বসংসাররূপে যা প্রতিভাত, বেদ ও উপনিষদে ইনিই পরাবাক্-ময় আদি শব্দ প্রণব বা উদ্‌গীত ।

পূর্বেই বলেছি—জড়-বিশ্বরূপেও যা দেখছ, তাও ঐ প্রণবেরই প্রকাশ । সুতরাং প্রণবই মহাবিশ্বের মূল আধার । এই পরাবাক্-ময় চিন্ময় প্রণবই প্রধান ব্যক্তশক্তি। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের মাধ্যমে এই ব্যক্তশক্তি ঈশ্বর, হিরণ্যগর্ভ ও শিব (বিরাট)-রূপে প্রকাশিত । এই পরাবাক্ চিন্ময় প্রণবই বোধ, ইচ্ছা ও ক্রিয়ারূপে ত্রিগুণ আশ্রয়ে বিশ্বজগতের যাবতীয় প্রকাশের কারণ । ঐ চিন্ময় পরাবাক্ আদি শব্দই হল মহাশক্তি বা মহাকাল – স্থলদেশে যা ছন্দবদ্ধ সুর ও ভাষারূপে প্রকাশিত ।

প্রিয় আত্মন্ ! ঐ কারণময় মহাশক্তির পরিণাম এই জগৎ । এই বিশ্বসংসার ব্যক্ত শব্দশক্তির গুণের দ্বারা সীমিত। প্রণবের ব্যক্ত গতিশীলতার যে অবস্থা, তাই মহাবিশ্বে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়-রূপে ত্রিগুণের (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) প্রবাহ দ্বারা বিশ্বচরাচরে চঞ্চলভাবে আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু এই সমস্ত আবর্তন-বিবর্তনের ঊর্ধ্বে ব্রহ্মবা পরমেশ্বর যা একমাত্র পরতত্ত্ব—গুণাতীত অখণ্ড সত্তা—সম্পূর্ণ তত্ত্ব। আর এই হল ব্রহ্ম বা আত্মতত্ত্ব ।

ঐ প্রণবরূপ পরাবায় চৈতন্যসত্তাই অক্ষরব্রহ্ম। ঐ অক্ষরব্রহ্মরূপ চৈতন্যই ঈশ্বর। ইনিই সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়রূপে গুণময় লীলা করেন । আর ব্যক্ত চরাচর বিশ্বজগৎ ক্ষরব্রহ্ম। অর্থাৎ এই জগৎ হল ক্ষরব্রহ্ম এবং জগতের আদিকারণ হল অক্ষরব্রহ্ম আর ক্ষর ও অক্ষরের উর্ধ্বে হলেন পরমেশ্বর পরব্রহ্ম।

প্রিয় আত্মন্ ! এখন নিশ্চয় বুঝতে পারলে যে, পরাবা প্রণবের অবরোহ গতিই হল সৃষ্ট-জগৎ – যা পরা, পশ্যন্তি, মধ্যমা ও বৈখরীরূপে প্রতিভাত এবং পরাবাকের আরোহ গতিই হল প্রলয় যা বৈখরী, মধ্যমা, পণ্যন্তি হয়ে পরাবাকে পুনরায় বিলীন হয়ে যায়। আর সৃষ্টি ও প্রলয়ের মধ্য অবস্থা হল স্থিতি । এই অবরোহ ও আরোহ-ক্রমে একটি আবর্তন বা কল্প পূর্ণ হয়ে থাকে অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় দ্বারা একটি আবর্তন বা কল্প পূর্ণ হয় । এইভাবে বিশ্ব গৎ অনাদিকাল হতে আপ চরাচর সৃষ্ট জগৎ হতে আপন স্বভাবে আবর্তিত হচ্ছে প্রণবেরই অভ্যন্তরে । কল্প হতে কল্পান্তর এই একভাবে পরাবাক্ চিন্ময় প্রণব আবর্তিত হচ্ছে

প্রিয় আত্মন্ ! এইভাবে পরমেশ্বর বা পরব্রহ্ম আপন প্রকৃতি চিন্ময় পরাবাক্ প্রণব দ্বারা আপনাকেই আপনি আস্বাদন করছেন। এই হল আপন প্রকৃতি দ্বারা আপন রস-মাধুর্য বা আনন্দরস আস্বাদন। বেদাদি শাস্ত্রে এই জন্য ব্রহ্ম বা পরমেশ্বরকে রসস্বরূপ বলা হয়েছে। যথা – ‘রসো বৈ সঃ’—তিনি রসস্বরূপ। (তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২/৭)।

প্রিয় আত্মন্ ! পরমেশ্বরের আপন চিন্ময় প্রকৃতি নিয়ে আপনাতেই যে আপনার রস আস্বাদন—এইটাই তাঁর লীলা- বিলাস বা লীলারস-মাধুর্য আস্বাদন।

*******************************************************************************************************

প্রিয় আত্মন !

পরমেশ্বর হতে প্রথম তাঁর আপন প্রকৃতি পরাবাক্ চিন্ময়প্রণব আবির্ভূত হন – যা পূর্বেই তোমাকে বললাম । আবার এই প্রণব হতে মহৎ উৎপন্ন হয় এইরূপে ক্রমান্বয়ে মহৎ হতে ব্যোম ( Space ), ব্যোম হতে মরুং অর্থাৎ তড়িৎশক্তি ( Plasma ), মরুং হতে তেজঃ ( Gas ), তেজঃ হতে অপ ( Liquid) এবং অপ হতে ক্ষিতি (Solid) উৎপন্ন হয়ে থাকে । গতির তারতম্য অনুসারে পদার্থসকল বিভিন্ন রূপ ও বিচিত্র গুণ ধারণ করে। পদার্থের কণারা গতি ও কম্পাঙ্কের দ্বারা বিভিন্নরূপে বিচিত্রভার প্রাপ্ত হয়ে থাকে।

দেশ-কাল-পাত্র বা পদার্থ (Matter)-রূপে এই চরাচর বিশ্বজগৎ পরিদৃশ্যমান—যা পঞ্চভূতের উপাদানজাত মিশ্রণরূপে প্রতিভাত বা প্রকাশিত ৷

ক্ষিতি, অপ, তেজঃ ও মরুৎ ( Solid, Liquid, Gas ওPlasma ) এই চারটি উপাদান ব্যোমতত্ত্বে অবস্থিত ; অর্থাৎ আকাশ ( Space ) অবলম্বন করে অবস্থান করে।

ঐ চারটি ভৌত অবস্থা তথা সমস্ত ভৌত জড় পদার্থের অবলম্বনই হল আকাশ বা ব্যোমতত্ত্ব । আর এইগুলি পরিবর্তনশীল অর্থাৎ গতি ও কম্পাঙ্কের তারতম্য ঘটলে এইগুলির অবস্থার পরিবর্তন হয়। সুতরাং এইগুলির স্থায়ী ( Permanent ) কোন রূপ নেই সমস্ত পদার্থই পরিণামী – সেইজন্য এই গুলিকে জড় দশা ( Phase ) বলা হয়। এই বিশ্ব-জগৎও অনাদি কিন্তু চিরন্তন নয় ( It’s beginningless but not permanent ) ৷

প্রিয় আত্মন্ ! —এইভাবে প্রতিটি উপাদান ক্রমানুযায়ী পূর্ববর্তী উপাদান জাত।

পরাবাক্ চিন্ময় প্রণব হল ব্রহ্মের প্রকৃতি, যাকে বেদশাস্ত্রে অক্ষরপুরুষ নামে অভিহিত করা হয়, আর এই বিশ্বসংসার হল তাঁর প্রকাশ – বেদাদি শাস্ত্রে যাকে ক্ষর প্রকৃতি নামে অভিহিত করা হয়। এই ক্ষর ও অক্ষর অর্থাৎ প্রকৃতি ও পুরুষের ঊর্ধ্বে পরমেশ্বর বা ব্রহ্ম । যা একটু আগেই আলোচনা করা হল ।s p

প্রিয় আত্মন্— পরমেশ্বর অদ্বৈত ও অখণ্ডস্বরূপ । তিনি আপন প্রকৃতি অর্থাৎ চিন্ময় পরাবাক্ প্রণব দ্বারা আপনাকে আস্বাদন করছেন—এই হল বিন্দু-বিসর্গের খেলা বা পরমেশ্বরের মাধুর্যময়

ঐ পরাবাক্ চিন্ময় প্রণবই দ্বিধারূপ ধারণ করেন—পুরুষ ও প্রকৃতি অর্থাৎ অক্ষর ও ক্ষররূপে। তিনি আপন প্রকৃতিকে দ্বিধা বিভক্ত করেন রস আস্বাদনের জন্য। উদাহরণস্বরূপ উপনিষদে উল্লিখিত :-

ওঁ আত্মৈবেদমগ্র আসীৎ । ……..

স বৈ নৈব রেমে তস্মাদেকাকী ন রমতে সদ্বিতীয়মৈচ্ছৎ ।

স হৈতাবানাস যথা স্ত্রীপুমাংসৌ সম্পরিস্বক্তৌ

স ইমমেবাত্মানং দ্বেধাহপাতয়ৎ ততঃ পতিশ্চ পত্নী চাভবতাং ৷৷

                                                                 [বৃহদারণ্যকোপনিষৎ— ১-৪-৩]

—অর্থাৎ সেই আত্মা বা পরমেশ্বর প্রথমে একাকী ছিলেন। তিনি কখনও রমণ করতে পারেন নি, কারণ কেহই একাকী রমণ করতে পারে না ৷ তিনি দ্বিতীয় কাউকে (স্ত্রী) কামনা করেছিলেন । তাঁর আত্মভাব যেন স্ত্রী-পুরুষের পরস্পর গভীর আলিঙ্গিত ( মিথুনীভূত ) একটি ভাব । এই ভাবাপন্ন নিজেকে তিনি দুই- ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। তার একভাগ পুরুষ ( পতি ) আর একভাগ প্রকৃতি ( পত্নী ) ।

প্রিয় আত্মন্, এখানে আমরা দেখছি যে, তাঁর ভিতর তিনটি ভাব বা সত্তা নিহিত আছে। একটি পুরুষসত্তা—ভোক্তারূপে, অপরটি প্রকৃতি বা স্ত্রীসত্তা ( পত্নী ) ভোগ্যরূপে আর একটি হল উভয়ের মিলনজাত একীভূত আনন্দময় সত্তা ।

সুতরাং আনন্দ হল বিন্দু, ভোক্তা হল পুরুষ এবং ভোগ্য বা প্রকৃতি হল বিসর্গ । আর এটাই হল বিন্দু বিসর্গের খেলা বা পরমেশ্বরের লীলা ।

তিনি নিজে রসস্বরূপ—আপন প্রকৃতি দ্বারা তিনি আপন রসমাধুর্য আস্বাদন করছেন।— এই হল পরাবাক্ প্রণবরহস্য বা বিন্দু বিসর্গ খেলা বা চিন্ময় লীলাবিলাস ।

উপনিষদে পরমেশ্বরকে রসস্বরূপ বলা হয়েছে। যথা :-

‘রসো বৈ সঃ ৷

রসং হ্যেবায়ং লব্ ধ্বানন্দী ভবতি।

কো হ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণাৎ

যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ

এষ হ্যেবানন্দয়াতি ।’

                                       [— তৈত্তিরীয়োপনিষৎ-২। ৭]

—অর্থাৎ তিনি রসস্বরূপ । জীব ঐ রসস্বরূপকে প্রাপ্ত হয়ে সুখী হয়। যদি আকাশে ঐ আনন্দস্বরূপ না থাকতেন, তবে কেই বা অপান ক্রিয়া করত, কেই বা প্রাণন কার্য করত। সুতরাং ঐ রসস্বরূপ যদি না থাকতেন, তাহলে কেহ-ই নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে প্রাণধারণ করতে পারত না।

আবার উপনিষদে তাঁকে আনন্দস্বরূপ বলা হয়েছে । যথা :-

আনন্দো ব্রহ্মেতি ব্যজনাৎ ৷

আনন্দাদ্ধ্যের খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে ৷

আনন্দেন জাতানি জীবন্তি ।

আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তীতি ।

                                           [—তৈত্তিরীয়োপনিষৎ ৩। ৬]

অর্থাৎ আনন্দই ব্রহ্ম । আনন্দ । হতে প্রাণিসমূহ জন্মগ্রহণ করে, আনন্দ দ্বারাই জীবন ধারণকরে এবং আনন্দতেই প্রতিগমন ও প্রবেশ করে ।

প্রিয় আত্মন্—এখন নিশ্চয় বুঝলে যে, ঐ রসস্বরূপ অদ্বৈত অখণ্ডসত্তা প্রথমে আপন অদ্বৈতস্বরূপে একা ছিলেন। কিন্তু তখন তিনি নিজেকে আস্বাদন করতে পারেন নি। এইজন্য তিনি ( রসস্বরূপ ) আপন প্রকৃতিকে ( প্রণব তত্ত্ব – যা অস্ফুটভাবে পরমেশ্বরে বিরাজমান থাকে । ) প্রকট করলেন। এইরূপে তাঁর প্রকৃতি চিন্ময় প্রণব দ্বিধা বিভক্ত হয়ে দুটি সত্তায় পরিণত হল । ঐ দুটি সত্তার একটি পুরুষ, অন্যটি প্রকৃতি। এই পুরুষ ও প্রকৃতির ভিতর কখনই আত্যন্তিক বিচ্ছেদ নেই ৷ এরা একই স্বরূপের দুটি অঙ্গ মাত্র। তথাপি বাহ্যত এরা পরস্পর বিরুদ্ধ কেবল লীলার নিমিত্ত। পরস্পর আপাত বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও একটি অপরটির জন্য প্রতীক্ষা করে থাকে । কারণ এককে বিনা অপরে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হতে পারে না। সেইহেতু পুরুষ আপন পূর্ণতার জন্য প্রকৃতিকে এবং প্রকৃতি আপন পূর্ণতার জন্য পুরুষকে কামনা করে থাকে। অতএব দুই নহে— দুই-এ মিলে এক । একটি অর্ধাঙ্গ, অপরটি তার অবশিষ্ট অর্ধাঙ্গ।

এই যে পুরুষের স্বীয় পূর্ণতার জন্য প্রকৃতির দিকে ঈক্ষণ এবং প্রকৃতির স্বীয় পূর্ণতার জন্য পুরুষের দিকে ঈক্ষণ—এইটাই সৃষ্টির মূল রহস্য ।

এই একই তত্ত্বের দুটি দিক । এতে ভেদও নেই আবার আত্যন্তিক অভেদও নেই—যুগপৎ ভেদ ও অভেদরূপে বিরাজমান। পরম পুরুষ ও পরমা প্রকৃতির যুগপৎ এই মিলিত অবস্থা—বাউলগণ একেই ‘যুগল তত্ত্ব’ বলে থাকেন । পরম প্রিয় পরমেশ্বরের এই হল রসঘন আনন্দময় লীলা ।

প্রিয় আত্মন্ ! এক এবং বহু, কিন্তু এর মধ্যবর্তী অবস্থা হল দুই। কারণ দুইকে আশ্রয় না করে এক বহুরূপে প্রকাশিত হতে পারে না। বহু’র অবস্থাতেই ভেদ পরিস্ফুট হয়ে থাকে, কিন্তুযখন ঐ পরিস্ফুট ভেদ অপসারিত হয়, তখন যাবতীয় ভেদ, অভেদের ভিতরই অপসংহৃত হয়ে থাকে ।

কারণ যেখানে কেবল একই সত্তা এবং যেখানে একের মধ্যে দ্বিতীয়ের আভাস বিদ্যমান বা জাগরুক থাকে না, সেখানে এক নিজেকে বোধ করতে পারে না। আর যে অবস্থায় বোধ নেই, সেখানে আনন্দের আস্বাদন কোথায় ? সুতরাং ঐ এক অবিভক্ত পরম সত্তাই দুটি ভাবসত্তায় পরিণত হয় । অর্থাৎ ঐ এক অবিভক্ত সত্তার মধ্যেই দ্বিতীয় সত্তার স্ফুরণ হয়। আর ঐ অবস্থায় রসমাধুর্য ক্ষরিত হয় এবং আনন্দের আস্বাদন হয় । প্রিয় আত্মন্ । এখন বুঝতে পারলে যে, ঐ একই অদ্বৈত বিন্দু দুই রূপে ( বিসর্গরূপে ) প্রকাশ পায় এবং একের সঙ্গে দুইয়ের আকৃষ্য ও আকর্ষক সম্পর্ক থাকে ।

ঐ এক হতেই বিন্দুদ্বয়ের নির্গমন হতে লাগল আবার ঐ বিন্দুদ্বয় সংকুচিত হয়ে একের মধ্যে লীন হতে লাগল । এই হল চিন্ময় প্রণবতত্ত্বে ‘বিন্দু বিসর্গের খেলা’ বা পরমেশ্বরের চিন্ময়লীলা আর ঐ সংঘর্ষজনিত যে আনন্দরসের প্রাদুর্ভাব হচ্ছে তাই আনন্দরসোল্লাস বা অনাবিল ভূমানন্দ । তিনি (পরমেশ্বর ) ঐ রসমাধুর্য আস্বাদন করছেন ।

প্রিয় আত্মন্ ! ঐ চিন্ময় প্রণবতত্ত্বে বিন্দু-বিসর্গের খেলা হতে আনন্দরস বা অমৃতস্রাব নির্গত হচ্ছে— তাই প্লাবিত হয়ে বাষ্পোদ্গামের ন্যায় সমগ্র বিশ্বে সঞ্চার প্রাপ্ত হচ্ছে। মেশ্বরের বিশ্বসৃষ্টির মূল রহস্য -এই হল পর-

প্রিয় আত্মন্—আনন্দ প্রতিষ্ঠিত – পরমেশ্বরের মহিমা অপার।