প্রিয় আত্মন্,
শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বাণী হতে আমরা জানতে পারি যে—ব্রহ্ম কোনদিন উচ্ছিষ্ট হয়নি । বাস্তবিক তা-ই, ব্রহ্ম কোনদিন উচ্ছিষ্ট হয় না বা হতে পারে না। কিন্তু প্রসাদরূপে ঋষিগণের মুখ হতে ব্রহ্ম আলোচিত হয়েছে। তাই ব্রহ্মজ্ঞ ঋষির মুখ হতে যা শ্রুত হয় তা আত্মতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্বেরই বিশ্লেষণ বা আলোচনা । এক্ষণে আমরা আত্মা বা ব্রহ্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করবার প্রয়াসী হচ্ছি
প্রশ্ন :— আপনি অনুগ্রহ করে প্রথমে আমাকে ‘জীবাত্মা কাকে বলে আর পরমাত্মাই বা কাকে বলে ?” –এই সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তর :— প্রিয় আত্মন্, বিশুদ্ধ চৈতন্যই হল আত্মতত্ত্ব –যা সমস্ত সীমার ঊর্ধ্বে অর্থাৎ দেশ-কাল-পাত্র – টাইম্-স্পেস-ম্যাটার-এর পরে তা-ই হল মহাচৈতন্যস্বরূপ –কূটস্থ পরমাত্মা। তিনি সমস্ত রকম দেশ-কাল-পাত্রের সীমার পরপারে। আর যা দেশ-কাল- পাত্রের মধ্য দিয়ে প্রতিভাসিত অর্থাৎ অধ্যাস হচ্ছে তা-ই আভাস চৈতন্য বা তটস্থ জীবাত্মা । মূলত এই উভয়ের মধ্যে কোন ভেদ নেই, কেবল দেশ-কাল-পাত্রের দ্বারা ভেদ প্রতীয়মান হচ্ছে মাত্র ।
প্রশ্ন :—আপনি এই বিষয়টি যদি আরো একটু বিস্তারিতভাবে বলেন তাহলে আমার পক্ষে বুঝার সুবিধা হয়।
উত্তর :—প্রিয় আত্মন্, জীবাত্মা এবং পরমাত্মার মধ্যে স্বরূপতকোন ভেদ নেই । দেশ-কাল-পাত্রের মধ্য দিয়ে যখন তা অধ্যাস বা প্রতিভাসিত হয় তখন তা জীবাত্মা নামে অভিহিত। সুতরাং দেশ-কাল-পাত্রের অভিমানই জীবত্ব আর ঐ জীবাত্মাই যখন দেশ-কাল-পাত্রের বন্ধন-মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ অবস্থা লাভ করে, তখন পরিচ্ছন্নতাহেতু জীবত্বের অভিমান অপসারিত হয়। ঐ অবস্থায় দেশ-কাল-পাত্রের কোন বন্ধন থাকে না। ঐ বিশুদ্ধ চৈতন্যরূপ আত্মাতেই পরমাত্মার স্বরূপ বোধ হয় । দেশ-কাল-পাত্রের মধ্য দিয়েই ত্রিগুণ প্রপঞ্চরূপ মহাবিশ্ব প্রকটিত হচ্ছে। আর তত্ত্বের অবিমিশ্র অবস্থাটি দেশ-কাল-পাত্রের পরে। ঐ অবস্থাই মহাচৈতন্য বা পরমাত্মা ।
সুতরাং যতক্ষণ দেশ-কাল-পাত্রের বন্ধন বা জীবত্বের মলিনতা ততক্ষণই জীবাত্মায় পরমাত্মায় ভেদ পরিদৃশ্যমান। কিন্তু যখন দেশ- কাল-পাত্রের বন্ধনমুক্ত হয়ে জীবত্বের মলিনতা অপসারিত হয় তখন ব্যক্তি-অভিমানের অভাবহেতু সমস্ত রকমের ভেদ দূরীভূত হয়ে যায়, কেবলমাত্র পরমাত্মাই বোধ হয়ে থাকেন
তাহলে এখন বুঝতে পারছ—দেশ-কাল-পাত্রের দ্বারাই ভেদ পরিলক্ষিত হয়। স্বরূপত কোন ভেদ নেই। জীবত্বের অভিমান অপসারিত হলে সমস্ত ভেদ দূরীভূত হয় এবং একমাত্র মহাচৈতন্যস্বরূপ পরমাত্মাই অনুভূত হন। তুমিই হলে বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ আত্মা
প্রশ্ন :—এটা কেমন করে ধারণা করব—এই সম্পর্কে বলুন।
উত্তর :— প্রিয় আত্মন্, তুমি বিচার করে দেখ—সমস্ত অনুভবের তুমি হলে অনুভবি, যাবতীয় দৃশ্য সকলের তুমি হলে দ্রষ্টা, যাবতীয় ঘটনার তুমি হলে সাক্ষী এবং সকল জ্ঞানের তুমি হলে বিজ্ঞাতা।জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি—এই তিন অবস্থা তোমার প্রকৃতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। তুমি এই অবস্থাগুলির সাক্ষীস্বরূপ। দেহ, ইন্দ্রিয়, মন-বুদ্ধিরূপ—এই ত্রি অভিমানিক শরীরের তুমি স্বামী। ত্রি অভিমান-(স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ) বিশিষ্ট শরীর তুমি নও। সমস্ত অবস্থাতেই তুমি বিশুদ্ধ বোধরূপে নিত্য বর্তমান। তুমিই হলে ঐ বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ আত্মা।
প্রশ্ন :—এবার আপনি অনুগ্রহ করে বলুন—আত্মাকে কেমন করে জানা যায় ।
প্রিয় আত্মন্—আত্মাই আত্মাকে জানে, কোন কিছুর দ্বারা তাকে জানা যায় না। কারণ আত্মতত্ত্ব মন-বুদ্ধি-বাক্যের পরে। উপনিষদে বলা হয়েছে অবাঙ মনসগোচর অর্থাৎ তা বাক্য, মন এবং বুদ্ধিরও অতীত। আত্মাই সমস্তকে প্রকাশ করে, কোনকিছু আত্মাকে প্রকাশ করতে পারে না। সুতরাং আত্মতত্ত্ব ত্রিগুণাতীত— সমস্ত দেশ-কাল-পাত্রের পরে। যেমন বুদ্ধি নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তি, এটা সত্ত্বগুণ হতে উৎপন্ন হয়। বুদ্ধির সাক্ষী আত্মা। আত্মাই বুদ্ধিকে প্রকাশ করে, বুদ্ধি আত্মাকে প্রকাশ করতে পারে না। আবার যেমন মন-সংকল্প-বিকল্পাত্মক বৃত্তি, যা রজোগুণ হতে উৎপন্ন হয়। মন আত্মাকে প্রকাশ করতে পারে না। মনের অধিষ্ঠান বুদ্ধি । এরূপ অহংকার অভিমানাত্মিকা বৃত্তি—যা তমোগুণ হতে উৎপন্ন হয়। অহংকার আত্মাকে প্রকাশ করতে পারে না ; অহংকারের অধিষ্ঠান মন । তো এখন বুঝলে তো, অহংকার মনেতে অধিষ্ঠিত, মন বুদ্ধিতে অধিষ্ঠিত এবং বুদ্ধির সাক্ষী আত্মা। অতএব আত্মাই সমস্ত কিছুর অধিষ্ঠান এবং প্রকাশক। আত্মাকে কেউ প্রকাশ করতে পারেনা, আত্মাই আত্মাকে বোধ করে এই হল বোধে বোধ বা আত্মসাক্ষাৎকারের রহস্য।
প্রশ্ন :- আপনার বর্ণনা দ্বারা অবগত হলাম — আত্মার দ্বারা আত্মাকে জানা যায় বা বোধে বোধ করা যায়, মন-বুদ্ধি-অহংকার দ্বারা তাকে জানা যাবে না; কারণ আত্মতত্ত্ব মন-বুদ্ধির অতীত কিন্তু আত্মতত্ত্ববিদ্গণ আত্ম-বোধের নিমিত্ত সাধনার উপদেশ করে থাকেন। অথচ সমস্ত প্রকারের সাধনাই শরীর-মন-বুদ্ধি দ্বারা অনুশীলন করতে হয়। সুতরাং যে তত্ত্ব মন-বুদ্ধির অতীত তাকে মন-বুদ্ধির সহায়ে সাধনা দ্বারা বোধ করা সম্ভব কি? এই সম্পর্কে সবিস্তারে বর্ণনা করলে খুবই ভাল হয়।
উত্তর :—প্রিয় আত্মন্, সংসারের সমস্ত প্রকারের সাধনাই চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত। সাধনা দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হলে আত্মাই আত্মাকে অনুভব করে । আর তা-ই হল আত্ম-সাক্ষাৎকার | এই জন্যই আত্মতত্ত্ববিদগণ ব্যক্তির প্রকৃতি অনুসারে তাকে সাধনার নির্দেশ করে থাকেন। চিত্ত পরিচ্ছন্ন হলে দেশ-কাল-পাত্রের বন্ধনমুক্ত হয়, জীবত্বের অভিমান অপসারিত হয়—তখন আত্মতত্ত্ব বোধে বোধ হয়ে থাকে এর কোন উপমা নেই । তবুও উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে বা এর ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। যেমন আকাশে মেঘ থাকলে সূর্য প্রত্যক্ষ হয় না, কারণ পৃথিবী-আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কিন্তু ঐ মেঘ দ্বারা সূর্য কখনই আবৃত নয় । সূর্য স্বপ্রকাশ এবং নিত্য প্রকাশিত। কেবলমাত্র পৃথিবী-আকাশের মেঘ অপসারিত হলেই সূর্য প্রত্যক্ষ হবে। এখন বুঝে দেখ, সূর্য পূর্ব হতেই প্রকাশমান কেননা পৃথিবী-আকাশ মেঘাচ্ছন্ন আছে বলে সূর্যকে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। যখনমেঘের অপসারণ হবে তখনই সূর্য প্রত্যক্ষ হবে । এইরূপ জীব পৃথিবীতুল্য, তার চিত্তে অজ্ঞানরূপ মেঘ ঘনীভূত। তাই আত্মস্বরূপ সূর্যকে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। অজ্ঞানরূপী মেঘ সরে গেলেই আত্মরূপী সূর্য প্রত্যক্ষ হবে। উদাহরণটি নিশ্চয় তোমাকে বুঝতে সাহায্য করেছে ।
প্রশ্ন :—আজ্ঞে হ্যাঁ, বুঝেছি। কিন্তু আবার একটি প্রশ্ন মনে উদয় হচ্ছে !
উত্তর :—প্রিয় আত্মন্, তুমি নিঃসংশয় হয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারো।
প্রশ্ন :- আপনি বললেন অজ্ঞানরূপ মেঘ চিত্তাকাশে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, তা কেমন করে চিত্তে আসল এবং তার প্রকৃতিই বা কি ? —এই সম্পর্কে আমাকে সবিস্তারে বলুন ।
উত্তর :—প্রিয় আত্মন্, অজ্ঞান হল অবিদ্যা, এটা অনাদি । কিন্তু অনাদি হলেও চিরন্তন নয়। জ্ঞানিগণ এই অবিদ্যাকে মায়া বলে থাকেন। মায়া হল ব্রহ্মের প্রকৃতি। ব্রহ্ম মায়ার স্বামী বা সাক্ষী অথবা অধিষ্ঠান । তাই ব্রহ্ম মায়া দ্বারা আক্রান্ত নয়।
ত্রিগুণের প্রবাহ দ্বারা এই মহাবিশ্ব আবর্তিত হচ্ছে আর ঐ ত্রিগুণময়ী মায়াই হল ব্রহ্মের প্রকৃতি – যা দেশ-কাল-পাত্র রূপে প্রকটিত বা পরিদৃশ্যমান আর এই সম্পর্কে পূর্বেও তোমাকে কথা প্রসঙ্গে বলেছি ।
প্রিয় আত্মন্—জ্ঞানিগণ আত্মবিচার অনুশীলন দ্বারা দেশ-কাল-পাত্রের বন্ধনমুক্ত হয়ে ত্রিগুণময়ী অবিদ্যারূপী মায়াকে অতিক্রম করেন এবং দেশ-কাল-পাত্রের অতীত পরম চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্মকে সাক্ষাৎ করেন। যোগিগণ এই অজ্ঞানকে মল বা বাসনা নামে অভিহিত করেন । ঐ বাসনা যথাক্রমে মল, বিক্ষেপ ও আবরণরূপে চিত্তাকাশকে আচ্ছন্ন করে। চিত্তের ঐ আচ্ছন্ন বা আবরিত ভাবকে তাঁরা অজ্ঞান বলেন ৷ ঐ অবিদ্যাই হল জীবভাবের কারণ আর ঐ বাসনা-বীজ হতেই সকল প্রকার বাসনার উৎপত্তি। চিত্ত যতক্ষণ ঐ বাসনা-মল বা অজ্ঞান দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে ততক্ষণ ব্যক্তি আত্মস্বরূপ হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে আত্মারূপে বোধ করতে পারে না। সে তখন নিজেকে আত্মা ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা করে থাকে এবং দেশ- কাল-পাত্রের সীমার প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে- যা তোমাকে আগেই বললাম । যাইহোক সে দেশ-কাল-পাত্রের সংস্কারবশত আপনাতে নাম-রূপের উপাধি আরোপ করে থাকে এবং ঐ উপাধি অর্থাৎ কল্পিত আমিই তার স্বরূপ—এইরূপ ভাবতে থাকে । ত্রিগুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সংস্কারবশত ঐ আমি অনুকূল এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সুখ ও দুঃখ ভোগ করে থাকে—এটাই হল জীবভাব। এখন তুমি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ যে, বাসনার মূল হল অবিদ্যা আর অবিদ্যা-মায়া হল ব্রহ্ম’র প্রকৃতি আর তাই যথাক্রমে মল-বিক্ষেপ-আবরণ-রূপে চিত্তে আবির্ভূত হচ্ছে । ঐ আবরিত আচ্ছন্ন ভাবই হল অজ্ঞান—যা আত্মস্বরূপ হওয়া সত্ত্বেও অনাত্মভাবে ভাবিত করাচ্ছে—যা সাক্ষীস্বরূপ হওয়া সত্ত্বেও উপাধি আরোপ করে সুখ- দুঃখ ভোগ করাচ্ছে—যা শরীরের স্বামী হওয়া সত্ত্বেও ‘আমি শরীর’ এইরূপ ভাবনায় ভাবিত করাচ্ছে এটাই হল অবিদ্যা বা অজ্ঞান । শাস্ত্রে একেই ভ্রান্তি বা মায়া বলে। সাধনা দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হলেএকে অতিক্রম করা যায় আর তখনই বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ আত্মাকে বোধ করা যায় ৷