প্রশ্ন—হে দেব, পূর্বে আপনার মুখ হতে অনাহত চক্র পর্যন্ত শুনলাম । এবার কৃপা করে বিশুদ্ধ চক্র সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলুন ।
উত্তর- প্রিয় আত্মন, বিশুদ্ধ চক্র তথা ব্যোমগ্রন্থি কণ্ঠদেশে অবস্থিত, দেহস্থ আকাশভূত-দেহকে ধারণ করে থাকে। দেহে আকাশতত্ত্বের প্রধানকেন্দ্র এই কণ্ঠ প্রদেশ এই ব্যোমতত্ত্ব সত্ত্বগুণপ্রধান । এই গ্রন্থি প্রধান ব্যক্তিগণও সেইজন্য সত্ত্বগুণ-সম্পন্ন হন । স্নেহ-ভালবাসা এঁদের ভিতর প্রবল হয়। এঁরা নিঃস্বার্থ প্রেমিক হন । এই গ্রন্থি বিশৃঙ্খল হলে স্বভাবে সাম্যভাব থাকে না, মানব নিরুদ্যম, হতাশাগ্রস্ত এবং শ্রমবিমুখ হয়ে পড়ে। এখন বিশুদ্ধচক্রের আধ্যাত্মিক রহস্য বলছি শোন — কণ্ঠদেশে ধুম্রবর্ণবং ষোড়শদলবিশিষ্ট বিশুদ্ধপদ্ম বিদ্যমান এই পদ্মের ষোলটি দলে লোহিতবর্ণবৎ অনুসারযুক্ত স্বরবর্ণের অক্ষরসকল যথাক্রমে সন্নিবিষ্ট রয়েছে —অং, আং, ইং, ঈং, উং, ঊং, ঋং, ঋং, ৯ং, ৯ং,এং, ঐং, ওং,ঔং, অং, অঃ ।
এই পদ্মের অভ্যন্তরে নভোমণ্ডল বিদ্যমান। ঐ নভোমণ্ডলের মধ্যে ব্যোমবীজ ‘হং’ বিদ্যমান। এই ব্যোমবীজ শুভ্র হস্তিপৃষ্ঠারূঢ় এবং পাশ, অংকুশ, বর ও অভয়মুদ্রা দ্বারা এর চতুভু জ শোভিত। ঐ বীজের ক্রোড়ে দশভুজ পঞ্চমুখ ত্রিনেত্র ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত অর্ধনারীশ্বর সদাশিব বিরাজমান। ইনি বৃষপৃষ্ঠে সিংহাসনে উপবিষ্ঠ। এর দক্ষিণভাগ তুষারশুভ্র এবং বাম ভাগ স্বর্ণবর্ণ । দশ হস্তে তাঁর শূল, টঙ্ক, খড়গ, বজ্র, দাহন, নাগেন্দ্র, ঘণ্টা, অংকুশ, পাশ এবং অভয়মুদ্রা শোভা পাচ্ছে। এই পদ্মের কর্ণিকা অভ্যন্তরে পীতবসনা শ্বেতবর্ণা চতুর্ভুজা শাকিনীশক্তি বিরাজমান রয়েছেন। এঁর চার হস্ত শর, ধনু, পাশ ও অঙ্কুশ দ্বারা শোভিত। ঐ কর্ণিকার ঊর্ধ্ব দেশে বিশুদ্ধ শশাঙ্কমণ্ডল শোভিত থাকে। ঐ শশাঙ্কমণ্ডল পরপদস্বরূপ, শুদ্ধমনা ব্যক্তিগণের মুক্তির দ্বারস্বরূপ ।
প্রশ্ন—হে দেব, আপনি এবার অনুগ্রহ করে আজ্ঞাচক্র সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলুন।
উত্তর—প্রিয় আত্মন্! আজ্ঞাচক্র তথা অহংগ্রন্থি ভ্রূমধ্যে অবস্থিত। এই অহংগ্রন্থি দেহস্থ পঞ্চচক্র তথা গ্রন্থিসমূহের ওপর কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। পঞ্চগ্রন্থির দোষ-দুর্বলতা এই অহংগ্রন্থি সংশোধন করে থাকে । এই গ্রন্থি প্রধান ব্যক্তিগণ সচরাচর উন্নত প্রতিভাশালী হয়ে থাকেন। মহাত্মা, মানবপ্রেমিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতি ব্যক্তিগণ এই গ্রন্থি প্রধান। এই গ্রন্থি বিশৃঙ্খল হলে নীচ, হৃদয়হীন, স্বার্থপর ও শঠ হয়ে থাকে মানব
এখন এই আজ্ঞাচক্রের আধ্যাত্মিক রহস্য বলছি, শোন। ভ্রূমধ্যে শশধরবৎ শুভ্র দ্বিদলবিশিষ্ট আজ্ঞাপদ্ম বিদ্যমান। এই পদ্মের দুই দলে শুভ্রবং দুটি অনুস্বারযুক্ত অক্ষর সন্নিবিষ্ট আছে। তারা হল যথাক্রমে -হং, ক্ষং ৷
এই দ্বিদল পদ্মের মধ্যস্থলে যোনিরূপিণী ত্রিকোণ বিরাজমান এবং ঐ ত্রিকোণে ইতরলিঙ্গ শিব বিরাজমান । ঐ লিঙ্গ বিদ্যুতের ন্যায় উজ্জ্বল এবং ঐখানে বেদের প্রথম বীজ ‘ওঁ’ অবস্থিত। মানবের সূক্ষ্মরূপী মনও ঐ স্থানে অবস্থান করে। ঐ পদ্মের অভ্যন্তরে ষড়াননা এবং প্রত্যেক আননে ত্রিনেত্রযুক্তা চতুভুজা হাকিনীশক্তি বিরাজমান । বিদ্যামুদ্রা, কপাল, ডমরু ও জপমালা তাঁর চারহস্তে শোভা পাচ্ছে। এই আজ্ঞাচক্রের দ্বিদল পদ্মেই বায়ুর লয় স্থান । এর ওপর মনশ্চক্র, তার ওপর সোমচক্র। ঐ সোমচক্রে হংসবীজ অধিষ্ঠিত । আর ঐ হংসবীজের ক্রোড়ে পরমশির বিরাজমান । তাঁর বামে নিত্যানন্দ স্বরূপিণী সিদ্ধকালী বিরাজমান রয়েছেন ।
দ্বিদল পদ্মস্থিত ত্রিকোণ অভ্যন্তরে যে জ্যোতির্ময় প্রণব রয়েছে, তা’ই অন্তরাত্মা । ঐ প্রণবের ঊর্ধ্বে বিন্দুরূপী ‘ম’ কার বিরাজিত এবং ঐ ‘ম’ কারের আদিভাগে শুভ্রবর্ণ নাদ অর্থাৎ একটি শিবলিঙ্গ বিদ্যমান । অন্তরাত্মা জ্যোতিরূপ প্রণব হতে মূলাধার পদ্মের ধরাচক্র পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে ঐ জ্যোতি। আজ্ঞাচক্রের উপরিভাগে মহানাদরূপে শূন্যস্থান বর্তমান। ঐ স্থান নির্বাত, কেবল চিদাভাস প্রকাশমান। তার ওপর পরমব্যোম, সেখানে শঙ্খিনী নাড়ীর শিরোদেশে বিসর্গশক্তির নিম্নে সহস্রদলবিশিষ্ট পদ্মা বিদ্যমান ।
প্রশ্ন—হে দেব, এইবার আপনি সহস্রার চক্র সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলুন, শুনতে বড়ই ইচ্ছা হচ্ছে। উত্তর—প্রিয় আত্মন্, সহস্রার তথা মহগ্রন্থির অন্তর্মুখী রসের নাম সোমধারা। ঐ সোমধারা বা অমৃত মস্তক হতে নেমে এসে মানবদেহের সমস্ত গ্রন্থি এবং স্নায়ুমণ্ডলকে সবল এবং প্রাণবান রাখে ৷ এই গ্রন্থি প্রধান ব্যক্তিগণই পৃথিবীতে মহাপুরুষ ও মহামানব নামে বিখ্যাত হন এবং জগতে অবতাররূপে পূজিত হন। এঁরা অপার্থিব আত্মানন্দ বা ভূমার আস্বাদন করেন। সংসারের ভোগ-জগতের পঙ্কিলতা এ দের বিশুদ্ধমনকে স্পর্শ করতে পারে না। এঁরা নিষ্কলঙ্ক, মহাজ্ঞানী, মহাপ্রেমী এবং মহাত্যাগী হন । এঁদের আবির্ভাবে সংসারে শান্তির আবির্ভাব হয়। সত্য, ত্যাগ, প্রেম ও শান্তির জীবন্তবিগ্রহ এঁরা । জাগতিক রোগ, শোক ইত্যাদি কোন কিছুই এঁদের স্বভাবে বৈষম্য ও বিকার উৎপন্ন করতে পারে না ।
এই গ্রন্থি বিশৃঙ্খল হলে সাধারণত দেখা যায় মানব পঙ্গুত্ব, জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ও ক্লীবত্ব অবস্থা প্রাপ্ত হয়।
এই মহৎ গ্রন্থির ঊর্ধ্বদেশে ব্রহ্মরন্ধ্র অবস্থিত। গুণাতীত এই ভূমি চেতনার অনন্ত পারাবার । এখানে বিজ্ঞানঘন চৈতন্য বিরাজ- মান । এখন ঐ সহস্রার চক্রের আধ্যাত্মিক রহস্য বলছি ।
শিরোদেশে বিসর্গ শক্তির নিম্নে সহস্রদলবিশিষ্ট পদ্ম বিদ্যমান । এটা অধোমুখে বিকশিত রয়েছে। তার পাপড়ি সূর্যের ন্যায় দীপ্তিশালী। ঐ পদ্মের দলগুলিতে স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ সমেত পঞ্চাশটি অক্ষর কুড়িবার চক্রাকারে আবর্তিত রয়েছে। এই সহস্রদল-অভ্যন্তরে পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় জ্যোৎস্নাজাল বিস্তার করে রয়েছে। এর অভ্যন্তরে একটি বিদ্যুৎরূপী ত্রিকোণ বিদ্যমান। ত্রিকোণ অভ্যন্তরে গুরুস্বরূপ মহাবিন্দু বিরাজমান । এই শূন্যস্থান পরমানন্দময় । এখানে আকাশরূপী পরমশিব অবস্থান করছেন। ইনিই পরমাত্মা বা ব্ৰহ্ম ।
এই স্থানে অরুণবর্ণবৎ মৃণাল তন্তুর শতাংশের একাংশবৎ, আকৃতিতে বিদ্যুৎতুল্য অমানাগ্নি ষোড়শীকলা বিদ্যমান যা সর্বদা প্রকাশমান এবং অধোমুখী । এখান হতে নিরন্তর অমৃতরূপ সুধাধারা বিগলিত হচ্ছে। আবার ঐ অমাকলার অভ্যন্তরে একগাছা কেশের সহস্রাংশের একাংশ পরিমাণ নির্বাণকলা বিদ্যমান রয়েছে। যা হল তত্ত্বজ্ঞান স্বরূপিণী । এর আকৃতি অর্ধচন্দ্রবং এবং আদিত্যের ন্যায় প্রভাযুক্ত। একে মহাকুণ্ডলিনী বলা হয়। এই নির্বাকলার অভ্যন্তরে নির্বাণশক্তি বিরাজিত। ইনি কেশাগ্রের কোটী অংশের একাংশ, কোটী সূর্যবৎ দীপ্তিশালিনী । ইনি ত্রিভুবন জননী, নিরন্তর প্রেমসুধা বর্ষণ করছেন । প্রিয় আত্মন্—এই নির্বাণকলাশক্তির অভ্যন্তরে সর্বশক্তির আশ্রয়স্বরূপ বিশুদ্ধ তত্ত্বজ্ঞানদাতা পরমশিব অবস্থিত। নির্বাণকলার নিম্নভাগে অব্যক্ত আনন্দস্বরূপিণী নিবোধিকা নামে অগ্নি প্রজ্বলিত অবস্থায় থাকে । এই নির্বাণকলার ভিতরেই পরবিন্দু তথা শিব ও শক্তির মিলিত সত্তা অবস্থিত। একেই বৈষ্ণবগণ পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার মিলন স্থান বলে থাকেন এবং একেই বেদোক্ত পুরুষ-প্রকৃতির মিলন স্থান বলা হয় । আর তন্ত্রেও একেই শিবশক্তির মিলন স্থান বলা হয় ৷