প্রশ্ন—হে দেব, আপনি কুলকুণ্ডলিনীর কথা প্রসঙ্গে যে সাড়ে তিন লক্ষ নাড়ী সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করেছিলেন, সেই সম্পর্কে আরো কিছু শুনবার আমার অতীব আগ্রহ হচ্ছে।

উত্তর—প্রিয় আত্মন্ ! সমস্ত নাড়ী অঙ্গ-প্রতঙ্গে গমন পূর্বকনিজ নিজ কার্য সম্পূর্ণ করে থাকে। আবার কার্য সম্পূর্ণ করে পুনরায় উৎপত্তি স্থানে এসে মিলিত হয়। এই নাড়ীসকল হতেই শাখা-প্রশাখা-রূপে সাড়ে তিন লক্ষ নাড়ী সমগ্র মানব শরীরে বিদ্যমান রয়েছে। ঐ সমস্ত নাড়ী দ্বারা সমগ্র শরীরে প্রাণবায়ু সঞ্চারিত হয় । সেইজন্য এই সকল নাড়ীকে ভোগবহা নাড়ী বলা হয়। নাড়ীজাল ওতপ্রোতভাবে মানব শরীরে ব্যাপ্ত রয়েছে। সমস্ত নাড়ীই বায়ু চলাচলের পথস্বরূপ এবং প্রাণবাহিনী। তারা মূলাধার হতে সহস্রার পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। বায়ু চলাচলের মার্গস্বরূপ এই নাড়ীসমূহ প্রাণক্রিয়ার সহায়ক ।

মানব শরীরের যাবতীয় ক্রিয়া এই নাড়ীসকলের মাধ্যম দিয়ে হয়ে থাকে। মূলাধার হতে মস্তকোপরি যে সমস্ত নাড়ী বিস্তৃত রয়েছে, তারাই রসবহা, রক্তবহা, রূপবহা, স্পর্শবহা, শব্দবহা, গন্ধবহা ও প্রাণবহা। এমন কি মানব শরীরের ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া, মনের ক্রিয়া, বুদ্ধির ক্রিয়া—এই সমস্তই বায়ু বা প্রাণস্পন্দন জাত ৷ জ্ঞান, ইচ্ছা এবং ক্রিয়া সমস্তকিছুই নাড়ীচক্রের দ্বারা সম্পাদিত হয়ে থাকে।

তান্ত্রিক মতে মেরুদণ্ডের অগ্রভাগে ষোড়শ কলায় পূর্ণ চন্দ্র নিত্য বিরাজমান । আর ঐ চন্দ্র সর্বদা অধোমুখে সুধা বা অমৃত বর্ষণ করছে। । আবার ঐ অমৃত বা সুধা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সূক্ষ্মরূপে প্রবাহিত হতে থাকে। একভাগ শরীরের পুষ্টির জন্য ইড়া নাড়ীতে প্রবিষ্ট হয়, তন্ত্রের ভাষায় তার নাম মন্দাকিনী । ঐ মন্দাকিনীর জল সমস্ত শরীরের পুষ্টি বর্ধন করে থাকে । ঐ সুধাময় চন্দ্রকিরণ মানব শরীরের বাম ভাগে অবস্থিত ইড়া নাড়ীর মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে সর্বদা। দ্বিতীয় ধারা শ্বেতবর্ণ বিশুদ্ধ দুগ্ধবৎ ও আনন্দপ্রদ । ঐ ধারা সৃষ্টির নিমিত্ত সুষুম্না পথ ধরে মেরুদণ্ডের নিম্নদেশে গমন করছে । মেরুস্থলে অর্থাৎ মেরুদণ্ডের নিম্নদেশে দ্বাদশ কলাযুক্ত প্রজাপতি সূর্য অবস্থান করছে। এই সূর্য ঊর্ধ্ব রশ্মিযুক্ত। ঐ সূর্য ঊর্ধ্ব রশ্মি হয়ে মানবদেহের দক্ষিণ ভাগে অবস্থিত পিঙ্গলা নাড়ীতে প্রবহমান এবং কিরণদ্বারা অমৃতময় চন্দ্ৰক্ষুধা বা দেহস্থ ধাতুসমূহকে গ্রাস করে থাকে ৷ আবার ঐ সূর্যমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল কর্তৃক পরিচালিত হয়ে সমগ্র শরীরে বিচরণ করে থাকে। তন্ত্রমতে বলা হয় ঐ সূর্যমণ্ডল লগ্নযোগে অর্থাৎ উপযুক্ত সময়ে পিঙ্গল৷ নাড়ীতে সঞ্চারিত হয়ে মুক্তিপ্রদায়ী হয়। আবার লগ্নানুসারে সমস্ত সৃষ্টবস্তু নাশও করে থাকে । তান্ত্রিকগণ মুক্তি-প্রদায়ীলগ্ন গুরু পরম্পরায় শিখে থাকেন।

প্রশ্ন—আপনার মুখ হতে তন্ত্রের অদ্ভুত রহস্যসকল জানতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। কৃপা করে এবার তন্ত্রের নাড়ী- সাধনা সম্পর্কে কিছু বলুন।

উত্তর -প্রিয় আত্মন্, তন্ত্রমতে বায়ুর স্থূলতা এবং সূক্ষ্মতার ওপর নাড়ীর স্থূলতা এবং সূক্ষ্মতা নির্ভর করে থাকে । তন্ত্রমতে সাধকের সাধনা এই বায়ুশুদ্ধির ওপর নির্ভর করে। শক্তির প্রবাহমার্গ হল নাড়ী। সুতরাং সাধক সাধনার দ্বারা বায়ুকে যত বিশুদ্ধ করেন, সাধনার পথে তাঁর ততই অগ্রগতি ঘটে থাকে

প্রাণায়াম ক্রিয়ার দ্বারা ঐ প্রাণবায়ু ক্রমশ সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্মতর হতে থাকে এবং নাড়ীসকলও ক্রমশ বিশুদ্ধ অবস্থা প্রাপ্ত হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্মতর অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে যখন নিরুদ্ধ গতি হয়, তখন দেহস্থ নাড়ীজাল উপসংহৃত হয় এবং সমস্ত বৃত্তি নিরুদ্ধ অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে দ্বন্দ্বাতীত পরম সাম্যভাবের উদয় হয়। এই প্রাণবায়ুর নিবৃত্ত অবস্থায় মহামিলন অর্থাৎ শিব-শক্তির মিলন হয় এবং তদ্‌জনিত যে সমরস উৎপন্ন হয়, তাই ভাগবতী আনন্দ বা পরমানন্দ এইটাই তন্ত্রের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। রাজযোগমতে একে চিত্তবৃত্তি নিরোধ বলে। এই হল নির্বিকল্প অবস্থা। অপরাপর যোগিগণ একেই নির্বাণ বলে অভিহিত করে থাকেন।

প্রশ্ন –হে দেব, আপনার নিকট হতে যে অপূর্ব সাধনরহস্থ্য শুনছি, অনুগ্রহ করে এই বিষয়ে আরো বিস্তারিতভাবে বললে আমার পক্ষে বুঝবার খুবই সুবিধা হয়।

উত্তর -প্রিয় আত্মন্, জড় ও চেতন যেন একই শক্তির দুটি অবস্থা, সেইরূপ স্থুল ও সূক্ষ্ম একই বায়ুর দুটি অবস্থা । যে সাধনার দ্বারা জড়কে চেতনে তথা স্থূলকে সূক্ষ্মে পরিণত করা যায়—মৃন্ময়ী চিন্ময়ীরূপ ধারণ করে—তাই তান্ত্রিক ক্রিয়াচার ।

অতএব নাড়ীকে অবলম্বন করে প্রাণবায়ুর সাধনাই হল এই যোগের মূল রহস্য ।

মলযুক্ত বক্রনাড়ীতে যে বায়ু সঞ্চারণ করে, সেই বায়ু বক্রগতি তথা স্থূলতা প্রাপ্ত হয়। আর ঐ স্থুল বায়ুকে জড়শক্তি আখ্যা দেওয়া হয়। যোগাভ্যাস দ্বারা ঐ বায়ু যখন ক্রমশ সরল ও সূক্ষ্ম হতে আরম্ভ করে, তখন নাড়ীমার্গও ক্রমশ বিশুদ্ধতা প্রাপ্ত হতে থাকে। আর ঐ সূক্ষ্ম বায়ু সরলপথ অবলম্বন করে থাকে। ঐ সরল পথ হল সুধুয়। পথ, বায়ু যত সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্মতর হতে থাকে, ততই সুষুম্নার মধ্যে অবস্থিত নাড়ীসকল উন্মক্ত হতে থাকে। যথাক্রমে সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে বজ্রানাড়ী, বজ্রানাড়ীর মধ্যে চিত্রানাড়ী এবং চিত্রানাড়ীর মধ্যে ব্রহ্মনাড়ী অবস্থিত এইগুলি সাধকের সাধনালব্ধ বোধ। অবশেষে ব্রহ্মনাড়ী উন্মুক্ত হলে, ঐ পথে কুণ্ডলিনী শক্তি প্রবাহিত হয়ে ঊর্ধ্ব গামী হয় এবং মস্তকোপরি সহস্রারে পরমেশ্বর পরম শিবের সঙ্গে মিলিত হয়। যোগী পরমানন্দে মগ্ন হয়ে ঐ মহারস তথা অমৃত আস্বাদন করে থাকেন । এই হল তন্ত্রের নির্বাণলাভ

প্রশ্ন – হে দেব, আপনার নিকট কুণ্ডলিনী জাগরণের অদ্ভুত কথা জানতে পারলাম । এই কুণ্ডলিনী জাগরণের আরো কি অন্য উপায় আছে ?

উত্তর—প্রিয় আত্মন্, তন্ত্রমতে বহু আচার স্বীকৃত আছে। অধিকারী ভেদে ঐ আচারসকলের যে কোন একটি আচার সাধকগণ অবলম্বন করে থাকেন । তা সাধকের প্রকৃতি অনুসারে নির্বাচনহয়।

প্রশ্ন—দেব, আপনি বললেন তন্ত্রে অনেক আচার স্বীকৃত আছে, ঐ আচারগুলি কি কি ? তা জানবার বড় আগ্রহ হচ্ছে

উত্তর—প্রিয় আত্মন্‌, ঐ আচারগুলি যথাক্রমে বেদাচার, বৈষ্ণবাচার, দক্ষিণাচার, বামাচার, বীরাচার, দিব্যাচার, পশ্বাচার, চিনাচার, অঘোরাচার, কাপালিকাচার, সহজাচার ইত্যাদি। কিন্তু সমস্ত কিছুর মূলেই হল ঐ কুলকুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণ ঘটিয়ে সহস্রারে পরমশিবে মিলিত করা।

মূলত তিনটি প্রথায় কুলকুণ্ডলিনী জাগরণ করবার ব্যবস্থা আছে – যথা প্রাণায়াম, রসায়ন এবং ঔষধি ।

তন্ত্রসাধনা খুবই বিজ্ঞানসম্মত এবং এর ক্রিয়া ঠিকমতো করলে চাক্ষুষ ফল সাথে সাথেই পাওয়া যায় । কিন্তু বহু সাধকই উপযুক্ত গুরুর অভাবে বিভিন্ন ঋদ্ধি-সিদ্ধির চক্রে পড়ে যান আর আসল উদ্দেশ্য ভুলে ঐ সিদ্ধির মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকেন ।

প্রশ্ন—হে দেব, আপনি এইমাত্র সিদ্ধির কথা বললেন এবংআমি এর পূর্বেও বহু জায়গায় শুনেছি—তান্ত্রিকগণ নানারকমসিদ্ধি জানেন এবং সিদ্ধির প্রয়োগ করেন। ঐ সিদ্ধিগুলি কি এবংতার তাৎপর্যই বা কি—একটু অনুগ্রহ করে বলবেন কি ?

উত্তর—প্রিয় আত্মন্, সিদ্ধি হল যোগলব্ধ শক্তি। ঐ অষ্টসিদ্ধি হল যথাক্রমে—অণিমা, লঘিমা, মহিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, ঈশিতা, বশিতা ও কামবশিতা ।

অণিমা—অণুবৎ হওয়া বা সূক্ষ্ম শরীর ধারণ করা ।

লঘিমা—পাতলা বায়বীয় শরীর ধারণ করা ।

মহিমা – বৃহৎ আয়তন তথা বৃহৎ শরীর ধারণ করা ।

প্রাপ্তি—ইন্দ্রিয়গণের ওপর আধিপত্য লাভ করা এবং ইন্দ্রিয়াদির ভোগ্যবিষয় ইচ্ছামাত্র প্রাপ্ত হওয়া ।

প্রাকাম্য—দূরদর্শন, দূরশ্রবণ, দূরগন্ধ-প্রাপ্তি, দূরস্বাদ-গ্রহণ, দূরস্পর্শ এবং দুষ্প্রাপ্য বিষয়ভোগ ৷

ঈশিতা—দূর-দূরান্তব্যাপী নিজশক্তি প্রেরণের সামর্থ্য।

বশিতা – ক্ষুধা-তৃষ্ণা রহিত হওয়া, শীত-গ্রীষ্মে ক্লেশভোগ না করা ।

কামবশিতা—ভোগের সামগ্রী থাকা সত্ত্বেও ভোগে নিস্পৃহ বা নিবৃত্তি ।

—এইগুলি ছাড়াও আরো অনেক সিদ্ধি আছে, যেমন কায়াকল্প, পরকায়া প্রবেশ, পরচিত্ত প্রজ্ঞা, ইচ্ছামৃত্য, সংকল্প সিদ্ধি—ইত্যাদি । প্রিয় আত্মন্, এই সকল শক্তি বা সামর্থ্যের লোভ সম্বরণ করে মোহশূন্য হয়ে প্রকৃত শিবতত্ত্বৈ খুব কম সাধকই উপনীত হতে পারেন। একমাত্র সদগুরুর কৃপা ছাড়া এই সমস্ত শক্তিকে অগ্রাহ্য করা যায় না । সদ্গুরুর দিব্য প্রেরণায় এবং তত্ত্বজ্ঞানমূলক উপদেশ ভিন্ন এগুলি হতে মুক্ত হওয়া খুবই কঠিন ।