প্রশ্ন—হে দেব, আপনি যদি অনুগ্রহ করে কালীরূপের রহস্য সম্পর্কে কিছু বলেন তো কৃতার্থ হই

উত্তর—প্রিয় আত্মন্ ! মহাকালের বুকে কালীরূপের প্রতীক রহস্য অতীব চমৎকার। মহাকাল হলেন অখণ্ডতত্ত্ব, পরব্রহ্ম নির্গুণ শিব ( Static ) । আর তাঁর বুকের ওপর ত্রিগুণময়ী আদ্যাশক্তি ( Dynamic), সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়রূপ মহাশক্তির খেলা খেলছেন। ইনিই ত্রিগুণময়ী পরাশক্তি মহাকালী। ঐ আদ্যা- শক্তি মহামায়া সপ্ততত্ত্বরূপ পৃথিবী, জল, অগ্নি, আকাশ, বায়ু, চন্দ্র, সূর্য এবং বিশ্বচরাচর এই বিরাট স্বগুণ ব্রহ্ম ( Physics ) – রূপ বিশ্বপ্রপঞ্চকে ধারণ করে আছেন। সেইজন্য তিনি ব্রহ্মাণ্ড-উদরী । মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহংকার—এই অন্তঃকরণ চতুষ্টয় মায়ের চারটি হাত । এই বিরাট বিশ্বপ্রপঞ্চ জুড়ে যে জ্যোতি বিস্তারিত আছে —তা’ই মায়ের লোল জিহ্বা। তাঁর নেত্র তেজস্বরূপ, কর্ণ আকাশস্বরূপ, নাসিকা বায়ুস্বরূপ, মুখ অগ্নিস্বরূপ এবং তাঁর পদ পৃথিবীস্বরূপ। সমস্ত জীবের মুণ্ড মায়ের গলার মুণ্ডমালা, সমস্ত জীবের মস্তকের নেত্রদ্বারে তিনি তেজরূপে, কর্ণে আকাশরূপে, নাসিকাদ্বারে ঘ্রাণরূপে, মুখদ্বারে অগ্নিরূপে এবং শরীরে পৃথিবীরূপে কার্য করছেন। এইভাবে তিনি চরাচর বিশ্বে সমস্ত কিছু ক্রিয়াত্মক কার্য করছেন। যা’ই ঘটছে — সমস্তই তিনি ঘটাচ্ছেন। তিনি ত্রিগুণময়ী—সমস্ত কিছুতেই ক্রিয়মাণ হয়ে ক্রিয়া করছেন। তাঁরএক হস্তে মুণ্ড, এর তাৎপর্য হল জীব-জগৎ তাঁর আয়ত্তে। অন্য এক হস্তে বরাভয় অর্থাৎ তিনি ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষরূপ চতুর্বর্গ ফল প্রদান করছেন। আর এক হস্তে চন্দ্রমালা-এর তাৎপর্য —তিনি ত্রিলোকের পরম মুক্তি প্রদান করছেন। ত্রিলোকের অর্থ—স্কুল, সূক্ষ্ম ও কারণ । অপর আর এক হস্তে খড়্গা – এর তাৎপর্য হল জ্ঞানখড়গ দ্বারা তিনি অজ্ঞান নাশ করছেন এবং শিবহু প্রদান করছেন । মহাকালের ওপর চলমান গতির তাৎপর্য—সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়রূপ জন্ম, জীবন ও মৃত্যুরূপে সগুণের খেলা বিরাম- হীনভাবে চলছে। নির্গুণের বুকে সগুণের খেলা—এটাই মহাকালের বুকে কালীর প্রতীক রহস্য।

প্রশ্নকর্তা—কালীরূপের অপূর্ব প্রতীক-রহস্য আপনার শ্রীমুখ হতে শুনে খুবই আনন্দ হচ্ছে ।

উত্তরদাতা—প্রিয় আত্মন্, যিনি মায়ের এই শক্তির ক্রিয়া অনুভব করেছেন, তাঁর প্রকৃতিতে আর শক্তির অভিমান বা অহংকার বলে কিছু থাকে না । তখন তিনি অনুভব করেন—অন্তর প্রকৃতিতে যিনি মহাভাবস্বরূপিণী মহাকালী, বহিপ্রকৃতিতে তিনি দশভুজা দুর্গারূপে সমস্তকিছু ঘটিয়ে চলেছেন। সমস্ত কিছুর মূলেই তিনি—এরূপ বোধ হলে ব্যক্তির আর অহংকার থাকে না । ক্ষুদ্র আমিত্বের বড়াই করে কেবল মূর্খরাই। বৃথা শক্তির গর্ব করে থাকে অজ্ঞানীরাই ।

শিব দুর্গা শিব দুর্গা দুর্গা দুর্গা শিব শিব ।

শিব কালী শিব কালী কালী কালী শিব শিব ॥

প্রশ্ন –হে দেব, আপনার নিকট হতে মহাকাল এবং মহাকালীর প্রতীক সম্পর্কে অপূর্ব ব্যাখ্যা শুনলাম, এইবার এই প্রতীকের যারা আরাধনা করেন— তাঁদের সম্পর্কে কিছু জানতে আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে। আপনি যদি অনুগ্রহ করে কিছু বলেন তো খুবই উপকৃত হই ।

উত্তর—প্রিয় আত্মন্‌, পরমাত্মাকে মাতৃরূপে যাঁরা আরাধনা করেন, তাঁদের শাক্ত বলা হয় । এই শক্তি সাধনার বিরামহীন ধারা চলে আসছে বৈদিকযুগ হতে ভারতবর্ষে বেদ ও তন্ত্র এই দুই নিয়েই ভারতীয় সংস্কৃতি। বৈদিকী আরাধনার সঙ্গে পরাশক্তির তান্ত্রিকী আরাধনার ধারাও সমান্তরালভাবে চলে আসছে এই মহান ভূমি ভারতবর্ষে । শক্তি সাধনার অপ্রতিহত ধারা বৈদিকযুগ হতে প্রবাহিত হয়ে বিবর্তিত আকারে পৌরাণিক যুগে এবং পরবর্তী যুগে আরো বিস্তারলাভ করে। ব্যাপকভাবে এই সাধনা অবলম্বন করে অসংখ্য সাধক পরাশক্তি মহামায়ার আরাধনায় উদ্বোধিত হয়েছেন এবং আজও হচ্ছেন । মাতৃভাবে আরাধনায় বহু সাধক সিদ্ধিলাভ করছেন । শক্তি সাধনার ইতিহাসে তাঁরা উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করূপে শোভা পাচ্ছেন। দেশ-কাল-পাত্র ভেদে সাধকগণের সাধনার বৈচিত্র্যহেতু পরাশক্তি মহামায়া প্রকটিত হয়েছেন বিভিন্ন ভাবে বিভিন্নরূপে । বৈদিকযুগে ব্রহ্মবিদুষী বাক্ হতে আরম্ভ করে পরবর্তী যুগে শক্তি সাধকগণের জীবন ইতিহাস এই ধারায় বিরামহীন অক্ষুণ্ন রয়েছে। বেদ-উপনিষদে যাকে পরব্রহ্ম বলে, তন্ত্রেই তিনি পরাশক্তি । বেদের পরব্রহ্ম এবং তন্ত্রের পরাশক্তি স্বরূপত অভেদ। ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ, যেমন অগ্নি ও অগ্নির দাহিকাশক্তি পৃথক নয়। একভাবে পরাশক্তি মহামায়া তুরীয়া নির্গুণা, অপরদিকে তিনিই সাধকের প্রতি অনুগ্রহ করে নানা মূর্তিতে বিভাসিত হন। প্রাণের ভক্তি ও ভালবাসায় পরাশক্তি মা সাধকের চিত্তে প্রকটিত হন। bed

প্রশ্ন—আপনার মুখ হতে শাক্তধর্মের ইতিহাস সম্যকরূপে অবগত হলাম । হে দেব, এখন যদি তন্ত্র সাধনার রহস্য সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করেন তাহলে কৃতার্থ হই ।

উত্তর—প্রিয় আত্মন, তন্ত্রশাস্ত্রের মতে মানবদেহের মেরুদণ্ডের নিম্নপ্রদেশ হতে মস্তক পর্যন্ত কতকগুলি চক্র বা পীঠ আছে । এইগুলি যথাক্রমে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধচক্র, আজ্ঞাচক্র ও সহস্রার। মেরুদণ্ডের নিম্নদেশে গুহ্য ও লিঙ্গের মধ্যবর্তী স্থানে মূলাধার চক্র অবস্থিত । এইরূপ লিঙ্গমূলে স্বাধিষ্ঠান চক্র, নাভিমূলে মণিপুর চক্র, হৃদয় আকাশে অনাহত চক্র, কণ্ঠদেশে বিশুদ্ধ চক্র, ভ্রমধ্যে আজ্ঞাচক্র এবং মস্তকোপরি সহস্রার চক্র অবস্থান করছে।

প্রশ্ন—হে দেব, আপনি যে এই চক্রগুলির কথা বললেন, এগুলি কি বাস্তবে আছে, না এইগুলির কল্পনা করা হয়েছে ?

উত্তর—প্রিয় আত্মন্, নিশ্চয়ই, এই চক্রগুলির বাস্তব অস্তিত্ব আছে, শুধু কল্পনাই নয় জীববিজ্ঞানে এগুলির পরিভাষা অন্যরূপ, যেমন Pre-coccyx region বা Perinium (মূলাধার), Gonad (স্বাধিষ্ঠান), Adrenal (মণিপুর ), Thymus (অনাহত), Thyroid (বিশুদ্ধ), Pituitary ( আজ্ঞাচক্র) এবং Pineal (সহস্রার)। এই গ্রন্থিগুলির দ্বারাই মানব শরীরের যাবতীয় কার্যকলাপ চলছে। জীববিজ্ঞানে একে বলে এণ্ড্রক্রিন অর্কেস্ট্রা অব দি ফিজিক্যাল বডি (Endocrine Orchestra of the Physical body. )।

প্রশ্ন – এখন বুঝলাম শরীরের ইন্দ্রিয়গুলির যাবতীয় কার্যকলাপ এই গ্রন্থিগুলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে । হে দেব, এবার অনুগ্রহ করে পুনরায় পূর্বের প্রসঙ্গ সম্পর্কে আরো কিছু বলুন ।

উত্তর—প্রিয় আত্মন্–দেহস্থ কুলকুণ্ডলিনী শক্তি প্রযুপ্ত অবস্থায় মূলাধার চক্রে অবস্থান করে। সাধনার দ্বারা সাধক ঐ সুপ্ত কুণ্ডলিনী শক্তি জাগ্রত করে যচক্র ভেদ করে সহস্রারে নিয়ে যান। সেখানে পরম চৈতন্যরূপী পরম শিব বিরাজমান । সাধক তাঁর সঙ্গে ঐ কুণ্ডলিনী শক্তির মিলন ঘটিয়ে শিবশক্তির মিলনজনিত চরম ও পরম আনন্দ অনুভব করেন। শাক্তগণ বলেন –মূলাধারস্থিত কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে সহস্রারে পরম শিবের সঙ্গে মিলন ঘটাতে হবে এবং তান্ত্রিকমতে একে শিব-শক্তির মিলন বলা হয়।থকে নি

প্রশ্ন—হে দেব, এই যে আপনি কুলকুণ্ডলিনীর কথা বললেন, যদি অনুগ্রহ করে বিস্তারিত ভাবে ঐ সম্পর্কে কিছু বলেন তো আমার পক্ষে বুঝবার সুবিধা হয় ।

উত্তর—প্রিয় আত্মন, তন্ত্রমতে প্রাণকে বায়ু বলা হয় এবং এই প্রাণবায়ু যাকে আশ্রয় করে ক্রিয়া করছে—তাকে নাড়ী বলা হয় নাড়ী হল সাধারণত প্রাণবায়ু চলাচলের পথ বা রাস্তা। মানবদেহের অভ্যন্তরে জালের ন্যায় অসংখ্য নাড়ী পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। এই নাড়ী সর্বসমেত তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার। এই সাড়ে তিন লক্ষ নাড়ীর ভিতর আবার চৌদ্দটি নাড়ী প্রধান । এগুলি যথাক্রমে— সুষুম্না, ইড়া, পিঙ্গলা, গান্ধারী, হস্তিজিহ্বা, কুহু, সরস্বতী, পূষা, অলম্বুসা, শঙ্খিনী, পয়স্বিনী, বারুণী, বিশ্বোদরী ও যশস্বিনী। আবার এই চৌদ্দটি নাড়ীর মধ্যে তিনটি নাড়ী শ্রেষ্ঠ— যথাক্রমে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না ৷

এই তিনটি নাড়ীর মধ্যে আবার সুষুম্না (Governing Channel) হল সর্বশ্রেষ্ঠ । মানব-দেহের অন্য সমস্ত নাড়ী এই সুষুম্না নাড়ীকে আশ্রয় করে বর্তমান রয়েছে । সেহেতু সুষুম্না নাড়ীই হল সর্বপ্রধান তন্ত্রমতে সুষুম্নানাড়ী যোগ সাধনার বিশেষ উপযোগী। ইড়া নাড়ী [Functional channel of the central sensory nervous system (Lunar)] মানবদেহের মেরুদণ্ডের বাম ভাগে অবস্থিত । এই নাড়ী সুষুম্না নাড়ীকে আলিঙ্গন পূর্বক প্রতিটি চক্র বেষ্টন করে বাম নাসাপুট হয়ে আজ্ঞাচক্রে গিয়ে মিশেছে। পিঙ্গলা নাড়ীও [Functional channel of the central sensory nervous system ( Solar )] তদ্রূপ মানবদেহের মেরুদণ্ডের দক্ষিণ ভাগে অবস্থিত। এই নাড়ীও সুষুম্না নাড়ীকে আলিঙ্গন পূর্বক প্রতিটি চক্রকে বেষ্টন করে দক্ষিণ নাসাপুট হয়ে আজ্ঞাচক্রে গিয়ে মিশেছে। সুষুম্নানাড়ী মেরুদণ্ডের মধ্যভাগে অবস্থিত । সেইজন্য একে মধ্যনাড়ীও বলা হয় । মূলাধার চক্রে এই তিনটি নাড়ী একত্রিত মিলিত থাকে, তারপর এখান হতে আলাদা হয়ে পুনরায় আজ্ঞাচক্রে গিয়ে মিলেছে । তন্ত্রের পরিভাষায় এই দুটি স্থানকে ত্রিবেণী বলা হয়। একটি যুক্ত ত্রিবেণী (মূলাধার চক্র), অপরটি মুক্ত ত্রিবেণী (আজ্ঞাচক্র)। সুষুম্না নাড়ী মূলাধার চক্রের অভ্যন্তর হতে মস্তকোপরি সহস্রার পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে ধুতুরা ফুলের ন্যায়। এই সুষুম্না নাড়ীর অভ্যন্তরে সূক্ষ্মরূপে বজ্রনাড়ী অবস্থিত এবং বজ্রানাড়ীর অভ্যন্তরে অতি সূক্ষ্মভাবে চিত্রাণী নাড়ী অবস্থান করে। আবার ঐ চিত্রাণীর অন্তর্গত ব্রহ্ম নাড়ীর অবস্থান । আর ঐ ব্রহ্মনাড়ীর পথ দিয়েই কুলকুণ্ডলিনী শক্তি সহস্রারে উপনীত হয়ে পরম ব্রহ্মস্বরূপ পরম শিবের সঙ্গে মিলিত হয়। আর অন্যান্য সমস্ত নাড়ীও মূলাধার চক্র হতে উত্থিত হয়েছে।

প্রিয় আত্মন্—এখন এই পর্যন্ত থাক্, পরে এই বিষয় নিয়ে আবার আলোচনা করা যাবে।