প্রশ্ন—পূর্বে আপনি ‘রাসতত্ত্ব’ সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনাকরবেন বলেছিলেন, সুতরাং ঐ সম্পর্কে আরও কিছু বলবেন কি?
উত্তর—নিশ্চয়ই যথাসম্ভব বলবার চেষ্টা করব, তুমি ঐ রাসতত্ত্বের যে বিষয় সম্পর্কে জানতে চাও, তা আমাকে জিজ্ঞাসা কর ।
প্রশ্ন—তাহলে অনুগ্রহ করে আপনি বৃন্দাবনের ‘গোপীভাব’ সম্বন্ধে কিছু বলুন ।
উত্তর—প্রিয় আত্মন—গোপীদের ভাব দেহাতীত, তাঁরা হলেন নিত্যসিদ্ধা। তাঁদের সঙ্গে কাম-কাঞ্চন-আসক্ত সাংসারিক জীবের তুলনা করা যায় না । গোপী বলতে আবার যেন তুমি মেয়েমানুষ ভেবো না। ‘গোপী’ কথার তাৎপর্য—গোপনে যাঁরা গোবিন্দকে ভজনা করেন অর্থাৎ যে ভাবের দ্বারা গোপনে গোবিন্দকে ভজনা করা যায়, তাকেই ‘গোপীভাব’ বলে। এই গোপীভাব ব্রজের একান্তভাব, অন্য কোথাও এই ভাব নেই ।
প্রশ্ন—আপনি এই যে ‘ব্রজ’ শব্দটি বললেন, এই ‘ব্রজ’ সম্পর্কে একটু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করুন না ?
উত্তর—প্রিয় আত্মন্, ‘ব্রজ’ শব্দের অর্থ পথ অর্থাৎ যে পথে গমন করলে সাধক প্রকৃত গোবিন্দকে লাভ করতে পারবেন। সুতরাং ব্রজ ব্যতীত কোথাও ভগবৎ মাধুর্যরস মেলে না । একমাত্র গোপীভাবাশ্রিত ভক্ত ছাড়া ঐ মধুর রসের সন্ধান আর কেহ জানে না বা বুঝতেও সক্ষম হয় না। এইজন্য মহাজনগণ বলেন :-
“ব্রজেতে হয় রসের স্থিতি
বেদবিধি তার নাহিক গতি।”
আর মধুররস হল শান্ত, দাস্য, সখ্য ও বাৎসল্য রসের মিলিত গুণ ।তাই শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে :-
” পূর্ব্ব পূর্ব্ব রসের গুণ পরে পরে হয় ৷
দুই তিন গণনে পঞ্চ পর্যন্ত বাঢ়য় ৷৷
গুণাধিক্যে স্বাদাধিক্য বাঢ়ে প্রতি রসে ৷
শান্তদাস্যসখ্যবাৎসল্যের গুণ মধুরেতে বৈসে ॥”
এই ভজনকে যুগল ভজনও বলা হয় ।
প্রশ্ন—‘যুগল ভজন’ সম্পর্কে কিছু বলুন ?
উত্তর— প্রিয় আত্মন, যুগলের তাৎপর্য হল জীবাত্মা ও পরমাত্মা । জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্মিলনে হয় যুগল মূর্তি। আর তাই হল সচ্চিদানন্দঘন বিগ্রহ এই রসের পাত্র একমাত্র রাধাভাবে ভাবিত প্রেমিক ভক্তরাই । তাই ওটা বেদ-বিধির অগোচর। কাম-কাঞ্চনে আসক্ত সংসার-বদ্ধ জীব এই ভাবের অধিকারী নয়। তাঁরা বেদ-বিধি বাদ দিতে পারেন না। তাঁদের বেদ-বিধি মেনে চলতে হয় । আর ঐ বেদের বিধান অনুসারে যে ভক্তি, তাকেই বলা হয় বৈধি ভক্তি ৷ সুতরাং নববিধা ভক্তি[*নববিধাভক্তি—শ্রবণ,কীর্তন,বিষ্ণুস্মরণ,পদসেবন,অৰ্চন,বন্দন,দাস্য,সখ্যওআত্মনিবেদন।] দ্বারা গোবিন্দের উপাসনা করবে। এই নববিধা ভক্তিই হল নবদ্বীপের ভাব। এই কারণের জন্য মহাজন বলেন :
“চৈতন্যগণের এই নবদ্বীপ সার
বৃন্দাবনে প্রবেশিতে সম্মুখে এই দ্বার ।”
এখন তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ—নববিধা ভক্তির দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হলেতবে দেহ-অভিমান বিনষ্ট হয়। আর দেহ-অভিমান বিনষ্ট হলে বৃন্দাবনে প্রবেশের অধিকার লাভ হয়। সুতরাং দেহ-অভিমান বা অহংবোধ থাকতে ব্রজভাবে অধিকার জন্মে না । কেবলমাত্র দেহ-অভিমানশূন্য অহংমুক্ত গোপীগণই এই ব্রজভাবের অধিকারী।
প্রশ্ন—এই যে ‘ব্রজের গোপীভাব’–এই সম্পর্কে যদি একটু বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন তো আমার পক্ষে বোঝা খুবই সুবিধা হয় ।
উত্তর—প্রিয় আত্মন—আমি এই সম্পর্কে বিস্তারিতভাবেই আলোচনা করছি, তুমি মনোযোগ পূর্বক শ্রবণ কর । এই গোপীভাব বুদ্ধি দ্বারা বোঝা যায় না, এটা ভক্তিমার্গের অতি উচ্চতম অবস্থা ৷ শ্রীভগবানে আত্মসমর্পণই এর মূল মন্ত্র । এই ভাব হল ভগবৎ- ভজনে অপূর্ব নিষ্ঠা-ভক্তি এবং একান্ত শরণাগতি । সুতরাং এটা হল ব্রজের অধিরূঢ ভাব। ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ—এই চতুবর্গ ফলকে বাদ দিয়ে সমস্ত প্রকারের জাগতিক কামনা-বাসনা শূন্য হয়ে পরমাত্মার প্রতি প্রীতি—এটাই দুর্লভ গোপী ভাব । ‘ভক্তমাল’ গ্রন্থে পরমভক্ত বিল্বমঙ্গলের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি একটা উক্তি হতে গোপীভাবের নিদর্শন পাওয়া যায় :-
“হস্তমুৎক্ষিপ্য যাতোঽসি বলাং কৃষ্ণ! কিমদ্ভুত ৷
হৃদয়াদযদি নির্যাসি পৌরুষং গণয়ামি তে ॥”
অর্থাৎ—“হে কৃষ্ণ ! তুমি জোর করিয়া হাত ছাড়াইয়া চলিয়া যাই- তেছ, তাহাতে আর বিচিত্র কি ?যদি আমার হৃদয় ছাড়িয়া (বলপূর্বক ) চলিয়া যাইতে পার, তাহা হইলেই বুঝিব তোমার পৌরুষ।”
গোপীরা আরও বলেন :-
“মোদের এমন সাধের পরাণ বঁধুয়া
নয়নে লুকিয়ে থোবো,
প্রেম চিন্তামণি রসেতে গাঁথিয়া
হিয়ার মাঝারে নোব।”
আমায় মুক্ত কর, আমায় রক্ষা কর—এইরূপ ভাব গোপীদের নয়। যাঁরা আপন হৃদয়মন্দিরে গোবিন্দকে স্থাপন করে গোপনে তাঁর ভজনা করেন, মুক্তি তো তাঁদের দাসী!। তাঁদের প্রত্যাশাবিহীন ভালবাসা, শুধু ভালবাসার জন্য ভালবাসা — নিষ্কাম ভগবৎ ভক্তের এটাই একমাত্র কাম্য। এটা অন্তরের অন্তস্তলের একান্ত নৈষ্ঠিকভাব। এটাই হল গোপীভাব।
প্রশ্ন—আপনি অনুগ্রহ করে গোপীদের ‘পরকীয়া প্রেম’ সম্বন্ধে কিছু বলুন না ?
উত্তর—প্রিয় আত্মন, পরতত্ত্ব হল সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ। তিনি হলেন পরমাত্মা। আর ঐ পরতত্ত্বে একান্ত ভালবাসা বা পরমাত্মা কৃষ্ণে প্রগাঢ় মতিই হল ‘পরকীয়া প্রেম’। বিষয়াসক্ত জীব সদগুরুর কৃপায় সংসারের অনিত্যতা বুঝতে পারে এবং পরমাত্মাই একমাত্র নিত্য সত্য জেনে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণতে বুদ্ধি স্থির করে অর্থাৎ জড় জগতের প্রতি নিরাসক্ত হয়ে চিন্ময়ী ভাগবতী লীলায় প্রবেশের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠে। সুতরাং এখন তুমি নিশ্চয় বুঝলে যে, শ্রীকৃষ্ণে একান্ত মতিই হল পরকীয়া প্রেম ।
প্রশ্ন–আচ্ছা আপনি যে বললেন ‘চিন্ময়ী ভাগবতী লীলা’—এই ‘চিন্ময়ী ভাগবতী লীলা’ সম্পর্কে একটু আলোচনা করবেন কি ?
উত্তর—প্রিয় আত্মন্, চিন্ময় অর্থাৎ অপার্থিব বা অপ্রাকৃত, যা সম্পূর্ণ জড়বিকার রহিত—অশরীরী তত্ত্ব। সহজ কথায় তাকেই ভগবৎ প্রেম বলা হয় । এটা বাহ্যভাব হতে অন্তরভাবে প্রবেশ ।
প্রশ্ন—এই ‘চিন্ময় ভগবৎ প্রেম’ সম্পর্কে আপনি অনুগ্রহ করে কিছু বলবেন কি ?
উত্তর—প্রিয় আত্মন, ভগবৎবিষয় শ্রবণ-কীর্তন-মননাদি এই নবধা ভক্তির দ্বারা ভক্তের চিত্ত যখন আর্দ্র বা দ্রবীভূত হয়, তখন ভক্তের চিত্তে এক প্রকার রসের উদ্ভব হয়। তাকেই বলা হয় ভক্তিরস বা পরকীয়া রস। পরতত্ত্ব শ্রীকৃষ্ণে অনুরাগবশতঃ ভক্তহৃদয়ে এই রসের উদ্ভব হয়ে থাকে বলেই একে পরকীয়া রস বলা হয়। সুতরাং বুঝলে তো বিষয়াসক্ত চিত্তে শ্রবণ-কীর্তনাদি দ্বারা যখন ঐ রসের আবির্ভাব ঘটে, তখন ভক্তের মন সাংসারিক বিষয়াদি হতে মুক্ত হয়ে কৃষ্ণ-উন্মুখ হয় । আর এটাই হল পরকীয়া প্রেম বা চিন্ময় ভগবং লীলায় প্রবেশ ।
প্রশ্ন—আপনি ‘রস’ বললেন—এই ‘রস’ ব্যাপারটা কি, একটু বিস্তারিতভাবে বলুন না ?
উত্তর—প্রিয় আত্মন—বেদে ব্রহ্মকে বলা হয়েছে, ‘বসো বৈ সঃ’—অর্থাৎ ব্রহ্ম রসস্বরূপ। এই ভগবৎ রসকে বৈষ্ণবগণ পাঁচ প্রকারে বিভক্ত করে থাকেন, যথা—শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। এদের মধ্যে মধুর রসই প্রধান। পূর্বে এই বিষয়ে তোমাকে বলা হয়েছে। এখন বুঝলে তো ভগবত্তত্ত্ব শ্রবণ-কীৰ্ত্তন-মননাদি দ্বারা ভক্তের চিত্তে যে অপার্থিব রসের উদ্ভব হয়, তা সাধকের প্রকৃতি ভেদে পাঁচ প্রকারের (শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর )। ক্রমশঃ এইরস হতে রতি জন্মায় । রতি তিন প্রকারের—সাধারণী, সমঞ্জসা ও সমর্থা । সমর্থা রতিকে প্রধান বলা হয়। এই রতির গাঢ়তম অব- স্থার নাম প্রেম । আর এই প্রেম ক্রমশঃ স্নেহ, প্রণয়, মান, রাগ, অনুরাগ, ভাব ও মহাভাব পর্যন্ত বিকশিত হয় । এই মহাভাবকেই বলা হয় শ্রীমতী রাধা ।
এখন তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারলে যে, রস পাঁচটি এবং তার মধ্যে প্রধান হল মধুর রস । আর রস হতে রতি জন্মায়। রতি আবার তিন প্রকারের, সাধারণী, সমঞ্জসা ও সমর্থা । রতির মধ্যে সাধারণী রতিকে সঙ্গজ প্রীতি বলা হয়, অর্থাৎ এই রতি আত্মমুখেই বিশেষ তৎপর। সমঞ্জসা রতিকে গুণজ প্রীতি বলা হয় অর্থাৎ প্রেমিক হতে প্রেমিকের গুণের প্রতি অধিক আকৃষ্ট। আর সমর্থা রতি হল নৈসর্গিক প্রীতি। এটা সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে – কেবলমাত্র ভালবাসার জন্যই ভালবাসা । এইজন্য চৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে—
“আত্মেন্দ্রিয়-প্রীতি ইচ্ছা তারে বলি কাম ৷
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা—ধরে প্রেম নাম ॥ ”
এই ‘কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি’ সমর্থা রতির প্রেমিকগণই ব্রজের গোপী । প্রিয় আত্মন্, তোমাকে পুনরায় বলছি রস হতে যে রতি উৎপন্ন হয়, তাই গাঢ়তম হয়ে প্রেমে পরিণত হয় আর ঐ প্রেম স্নেহ-প্রণয়াদিক্রমে মহাভাব পর্যন্ত বিকশিত হয়ে থাকে। হলাদিনী-স্বরূপিণী শ্রীমতী রাধা । ঐ মহাভাবই হল এখন বুঝলে তো যে, রস ব্যতীত রসরাজ শ্রীকৃষ্ণকে অনুভব করা যায় না। তাই ভক্তিশাস্ত্রে বলে—
“পরকীয়া ভাবে অতি রসের উল্লাস
ব্রজ ছাড়া অন্যত্র তাহার নাহিক বাস ।”
ইহা একমাত্র ব্রজের নিত্যসিদ্ধা গোপীগণই অনুভব করতে পারেন। ব্রজগোপী ছাড়া কৃষ্ণপ্রেম কেউই আস্বাদন করতে সক্ষম হন না । আর শ্রীরাধাই হলেন এই রসের পূর্ণ পাত্রী। তিনিই একমাত্র রতিতে সমর্থা—হ্লাদিনী শক্তিস্বরূপিণী। আহ্লাদে কৃষ্ণ, তাই— হ্লাদিনী।
প্রশ্ন—এবার আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে ‘রাস’ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলুন ।
উত্তর—প্রিয় আত্মন—পরমাত্মা হল শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ পরতত্ত্ব আর জীবাত্মা হল রাধা অর্থাৎ আত্মতত্ত্ব । আর জীবাত্মার পরমাত্মার সঙ্গে মিলনই হল অপ্রাকৃত চিন্ময় রাস। এই পার্থিব সংসার হল আয়ান এবং জটিল বাসনা হতে জীবের মনে সংসার ভাব উৎপন্ন হয়, তাই আয়ানের মাতা হল জটিলা। আর কুটিল কামনা সংসার আসক্ত জীবকে সর্বদা ত্রিতাপ ক্লেশে ক্লিষ্ট করছে, সেইহেতু এই কুটিল কামনাই হল কুটিলা | আসক্ত জীব যখন এই সংসাররূপ আয়ানকেই প্রভু বা স্বামী ভেবে বসে, তখন ঐ জটিলা-কুটিলা-রূপ বাসনা এবং কামনা তাকে বিব্রত করে সর্বদা নানারকম ক্লেশ উৎপন্ন করে থাকে।
প্রিয় আত্মন, সেইজন্য সংসারকে আয়ান এবং সংসার-আসক্ত জীবকে আয়ান-ঘরণী রাধা আর শাশুড়ী ও ননদকে জটিলা ও কুটিলা বলা হয়। প্রিয় আত্মন— শ্রীকৃষ্ণ সাক্ষাৎকারের পথে জটিলা ও কুটিলা অর্থাৎ কামনা ও বাসনা বড়ই বিঘ্ন । ললিতা হল সদ্গুরু। যিনি কৃষ্ণ সাক্ষাৎকারের ঘটক বা সহায়ক। ললিতারূপ শ্রীগুরু শ্রীরাধারূপ শিষ্যকে মন্ত্রণা দেন কেমন করে আয়ানঘরণী হওয়া সত্ত্বেও জটিলা-কুটিলার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কৃষ্ণ সাক্ষাৎকারের নিমিত্ত অভিসার করতে হবে। ললিতা বলেন রাধাকে—আয়ান-ঘরণী তুমি, এইজন্য তোমাকে গোপনে অভিসার করতে হবে, যেন জটিলা এবং কুটিলা কোন রকমে না। দেখতে পায়। এর অর্থ গুরু বললেন শিষ্যকে—সংসারে থেকেই তোমাকে বাসনা ও কামনা বশ করতে হবে। এদের সঙ্গে বিরোধ করলে চলবে না। কারণ কামনা-বাসনার বিরোধ করলে বিকৃতি হয় । আবার এদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও চলবে না, কারণ আত্মসসর্পণ করলে অনন্তকাল সংসার চক্রের আবর্তনে ভ্রমণ করতে হবে।
প্রিয় আত্মন্, আশাকরি এখন বুঝতে পারছো যে, এই কামনা-বাসনার বিরোধ বা অবদমন করলে চিত্তে বিকৃতি আসে এবং আত্মসমর্পণ করলেও অনন্ত জন্ম ধরে সংসারচক্রে যাতায়াত করতে হয় । তাই পরমাত্মার সাক্ষাৎ করতে হলে এদের বশপূর্বক অতিক্রম করতে হয়। শ্রীগুরুপ্রদত্ত সাধনা দ্বারা অন্তর জগতে যাত্রা করতে হবে। অর্থাৎ বহির্মুখী মনকে অন্তর্মুখী করতে হবে। এই হল রাধার গোপন অভিসার। আমাদের অন্তরের অন্তস্তলে পরমাত্মা বিরাজমান। তাঁকে সাক্ষাৎ করতে হলে অন্তর্মুখী হতে হবে। আর অন্তর ভাবই হল গোপনভাব ।
‘চরৈবেতি’ কথাটির তাৎপর্য এখানে নিহিত রয়েছে। এই অভিসারের উদ্দেশ্য শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎকার। ললিতারূপ সদগুরুর পরামর্শে শ্রীরাধারূপ-শিষ্য সচ্চিদানন্দ সাধনায় মগ্ন হন— উদ্দেশ্য পরমাত্মার সাক্ষাৎকার। জীবাত্মা ও পরমাত্মার একরসতাই হল সচ্চিদানন্দ চিন্ময় রাস । জীবাত্মা তখন সম্পূর্ণ কামনা-বাসনা শূন্য হয়ে ধর্ম,অর্থ, কাম, মোক্ষ—এই চতুর্বর্গ ফলের কামনাও ত্যাগ করেন এবং অত্যন্ত একনিষ্ঠভাবে পরমাত্মার প্রীতির জন্য আকুলভাবে তাঁকে ভালবাসতে থাকেন অর্থাৎ পরতত্ত্বে মিলিত হবার জন্য অন্তর ভূমিতে সাধনায় নিমগ্ন হন । এই ভাবকে পরকীয়া মতি বা পরকীয়া প্রেম বলা হয়—যা পূর্বে তোমায় বলেছি। এই প্রেম সম্পূর্ণ নির্মল, বিশুদ্ধ ও কামনা-বাসনা শূন্য । এটা অভিমানবর্জিত এবং প্রত্যাশাবিহীন । এই প্রেম পরতত্ত্বে অর্থাৎ পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণে অর্পিত বলে একে পর কীয়া প্ৰেম বলা হয়। ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন যে, কোটীমুক্ত মধ্যে দুর্লভ কৃষ্ণভক্ত। একমাত্র পরমাত্মার প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তিমান সাধকই হলেন ভক্ত এবং যিনি তাঁর নামে ও প্রেমে মাখামাখি হয়েছেন—তিনিই কৃষ্ণভক্ত এবং কৃষ্ণ-প্রেমিক ৷
প্রিয় আত্মন্—এ তত্ত্ব বড়ই মধুর । শ্রীকৃষ্ণ-প্রসাদ ছাড়া এ তত্ত্ববুঝতে পারা যায় না । তাই ভক্ত বাউল বলেছেন
“কৃষ্ণপ্রেম সুধাসিন্ধু
যদি পাই একবিন্দু
যে বিন্দু জগৎ ডুবায় ।
তথাপি বাউলে কয়
কহিলেও কেবা পেতে চায়।”
বৃন্দাবনের গোপীদের এই শ্রীরাধার ভাব । প্রেমসাধিকা গোপীদের 10 প্রেমের পাত্র হলেন বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণ। মধুর ব্রজলীলার এটাই মাধুর্য। আর এখানেই মাধুর্য রতির পরিপূর্ণ বিকাশ। এটা হল জীবাত্মা ও পরমাত্মার মহামিলন—সাক্ষাৎ শৃঙ্গার—স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির অপূর্ব পূর্ণ সমন্বয় ৷
প্রিয় আত্মন্—ভক্তিমান সাধক যেদিকে তাকান, সেদিকেই কৃষ্ণকে দেখতে পান। আত্মদর্শী কৃষ্ণভক্ত সমস্তই কৃষ্ণময় দেখেন । সমস্ত কিছুতেই শ্রীকৃষ্ণের অস্তিত্ব ও আবির্ভাব বোধ করেন। তাঁর “যাঁহা যাঁহা নেত্র পড়ে / তাঁহা তাঁহা কৃষ্ণ স্ফুরে।” অর্থাৎ সর্বভূতে ভগবৎ দর্শন হয় । বেদান্তের এটাই ব্রহ্মভাব । উপনিষদের এটাই ‘আত্মানং বিদ্ধি’ । সর্বভূতে ভগবৎ দর্শনই হল ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব, শৈবের শিবত্ব, বৈষ্ণবের বিষ্ণুপদ ও শাক্তের মাতৃপদ । আর এর মধ্যে রয়েছে বেদের ‘সোহহং’ কথাটির তাৎপর্য । তাছাড়া ‘তত্ত্বমসি’, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’, ‘প্রজ্ঞানম্ ব্রহ্ম’ ও ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’—এই চারটি মহাবাক্যেরও এখানেই সার্থকতা ।
প্রশ্ন—তাহলে আপনার কথামত এখন বুঝতে পারলাম যে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনই হল চিন্ময় রাস—তাই নয় কি ?
উত্তর—হ্যাঁ তাই । তিনি রস, উপনিষদে তাঁকে রসস্বরূপ বলা হয়েছে । তিনিই সাক্ষাৎ শৃঙ্গার অর্থাৎ আদিরস। সমস্ত রসের মূলেই হল আদিরস । ঐ মূল বা আদিরসকে শৃঙ্গার মূর্তি বল। হয় । ঐ রসে একরস হওয়াই রাস । জীবাত্মা যখন পরমাত্মায় মিলিত হয়। অর্থাৎ একরস হয়—তখন তাই সাক্ষাৎ শৃঙ্গারস্বরূপ রসঘন চিন্ময় যুগল বিগ্রহ । এই হল রাসলীলার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ।
প্রশ্ন— কিন্তু আমরা ভাগবতে শুনেছি রাধা-কৃষ্ণের সঙ্গে বৃন্দাবনে আরও ষোল হাজার গোপিনী রাসে অংশ গ্রহণ করেছিলেন—এরও কি কোন আধ্যাত্মিক তাৎপর্য আছে ?
উত্তর— প্রিয় আত্মন্—এটা বড়ই অদ্ভুত এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্যসম্পন্ন ।মানবদেহের মস্তকোপরি সহস্রারচক্রে সহস্রদল কমল শোভিত আছে, তা সাধারণতঃ জীবে সুপ্ত থাকে। সাধনা দ্বারা ঐ সুপ্ত সহস্রদল কমল প্রস্ফুটিত হয়। সহস্রদল কমলের এক- একটি দলে ষোলটি করে পাপড়ি থাকে । এক হাজারটি দলে ষোলটি করে পাপড়ি থাকলে ষোল হাজারটি পাপড়ি হয়। তাকেই ষোল হাজার গোপিনী বলা হয়ে থাকে ৷
প্রশ্ন—আপনি অনুগ্রহপূর্বক এই বিষয়টি আরো একটু পরিষ্কার করে। বললে আমার পক্ষে বুঝবার খুবই সুবিধা হয়।
উত্তর— প্রিয় আত্মন—সহস্রারচক্রে সহস্রদল কমলের কর্ণিকা অভ্যন্তরে। অর্থাৎ নিকুঞ্জবনে জীবাত্মা ও পরমাত্মাস্বরূপ শ্রীরাধাকৃষ্ণের রাসমঞ্চ । অর্থাৎ সহস্রার হল নিকুঞ্জবন, আর সহস্রদল কমল, হল রাসমঞ্চ । অষ্টসখা ও অষ্টসখী ষোড়শ, কলা অর্থাৎ প্রতি দলে ষোলটি করে পাপড়ি। প্রতি ষোলজন পিছু এক হাজার গোপিনী, সমস্ত মিলে হয় ষোল হাজার। আর সেখানেই হয় জীবাত্মা৷ এবং পরমাত্মার মিলন। প্রিয় আত্মন্—যদি এই ‘রাসতত্ত্ব’ সম্পর্কে তোমার আরও কিছু জিজ্ঞাসা থাকে, তাহলে পরে একান্তে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জেনে নেবে ।