গুরু মহারাজ সেদিন(দীক্ষার দিন) জপ-ধ্যানের জন্য নির্দিষ্ট সময় ও নির্দিষ্ট পদ্ধতিও বলে দিয়েছিলেন বা শিখিয়ে দিয়েছিলেন ৷ ত্রিসন্ধ্যা অর্থাৎ দিন রাত্রির তিনটি সন্ধিক্ষণ-ই জপ-ধ্যানের বা ইষ্টমন্ত্র স্মরণ-মননের উপযুক্ত সময় ।

(১) ভোরবেলা বা ব্রাহ্মমুহূর্ত্ত — যখন রাত্রি শেষ হচ্ছে দিন শুরু হচ্ছে এই দুই এর সন্ধিক্ষণ,

(২) মধ্যাহ্ন — দিবাভাগের প্রথম অংশ ও দ্বিতীয় অংশের সন্ধিক্ষণ,

(৩) সন্ধ্যাকাল — যখন দিবাভাগ শেষ হয়ে যাচ্ছে রাত্রির সূচনা হচ্ছে – সেই সন্ধিক্ষণ ৷

উনি বলেছিলেন – এই সময়গুলিতে প্রকৃতিতে-ও ছন্দ পরিবর্ত্তন হয় ৷ এক Vibration থেকে অন্য Vibration -এ যাওয়ার period. এই সময়গুলিতে মন:সংযোগ করলে মহাবিশ্ব প্রকৃতির (মা জগদম্বা) আনুকুল্য লাভ করা যায় ৷ সাধকের পক্ষে ধ্যান-জপে মন বসানো অনেক সহজ হয়ে ওঠে ৷ মসজিদে আজান , গীর্জায়-গীর্জায় ঘন্টাধ্বনি , মন্দিরে মন্দিরে শঙ্খধ্বনি , ঈশ্বরের নাম গুণগান , স্তব-স্তোত্র উচ্চারণ , ধূপ-দীপ প্রজ্বলিত করে মহাশক্তির উদ্দেশ্যে আরাত্রিক , সাধু-সন্তদের ধুনি জ্বালিয়ে সাধন-ভজন , কোথাও বা যজ্ঞাগ্নি প্রজ্জ্বলন করে আহুতি প্রদান — ইত্যাদি যত প্রকারের ঈশ্বরের আরাধনা করা যায় , তা এই সময়গুলিতেই হয় ৷

মানুষ যুগ বিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে আসতে গিয়ে সামাজিক বা পারিবারিক জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ৷ তাই এখন মধ্যাহ্ন সন্ধ্যা বাদ পড়ে গেছে, এখন তাই সকাল_ সন্ধ্যা ! গুরু মহারাজ আমাদের সকলকে উদ্দেশ্য করে ব্রাহ্মমুহূর্ত্ত এবং সন্ধ্যাকালেই ধ্যান-জপ করতে বলেছিলেন (আজ পর্যন্ত ব্রাহ্মমুহূর্ত্তে ধ্যান-জপে বসা হয়তো হাতে গুনে কয়েকদিন হয়েছে , আমার যেটুকু অপূর্ণতা – তা গুরুবাক্য অবহেলারই ফল ৷ তবে তখন অর্থাৎ গুরু মহারাজ থাকাকালীন বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে সাধু-ব্রহ্মচারীদের দেখেছিলাম গুরু-বাক্য পালনের প্রতি কি নিষ্ঠা ! ব্রাহ্মমুহূর্ত্তে ধ্যান-জপ করার জন্য সকলের মধ্যে কি তীব্র Competition! এক প্রহর রাত থাকতে থাকতেই সকলে উঠে স্নান-পায়খানা সেরে নিয়েই ধ্যান-জপে বসে যেতো।

“অত ভোরে কি করে ওঠেন প্রতিদিন?” – এটা জিজ্ঞাসা করায় একজন সাধুবাবা আমাকে বলেছিলেন যে, – “এটা তো খুবই Easy, রাত্রে শোবার আগে বেশী করে জল খেয়ে নাও , তাহলেই ভোরে ঘুম আপনি ভেঙে যাবে ৷” – ওনাদের এই ধরণের নিষ্ঠা দেখে সেই সময় আমি খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম ৷)

উনি ধ্যান-জপ করার পদ্ধতি যেগুলি বলেছিলেন, সেগুলি আমি যেটুকু বুঝেছিলাম তা হোল –

১) মেরুদণ্ড সোজা করে যে কোন আসনে তুমি comfortable বোধ করছো — সেই আসনে বসে ধ্যান জপ করো_পদ্মাসন , গোমুখাসন , সুখাসন – ইত্যাদির যে কোন একটি ৷ তবে মেরুদন্ড সোজা থাকা চাই , তারজন্যই উপরিউক্ত বা ঐ ধরনের অন্য যে কোন আসনে বসা প্রয়োজন ৷ আমাদের মেরুদণ্ডের শেষভাগে বা নিচের দিকে মূলাধার চক্র (Pre-cocsix gland) যেখানে কুলকুণ্ডলিনী শক্তি সাড়ে তিন পাক কুণ্ডলিকৃত হয়ে সুপ্ত ৷ সেখান থেকে মেরুদন্ড বরাবর Straight Line -এ মস্তিষ্কে অবস্থিত সহস্রার ! সাধন-ভজন করার সময় মূলাধার থেকে সহস্রার যদি Straight Line -এ না থাকে তাহলে charging হয় না ৷ ফলে কুলকুণ্ডলিনীর জাগরণ বা অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে না!

২)নাড়ীশুদ্ধি বা সহজ প্রাণায়াম অভ্যাস অন্তত: ৫/১০ মিনিট ৷ এটিকে এখন রামদেব বাবার দৌলতে সবাই অনুলোম-বিলোম হিসাবে জানে অর্থাৎ ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ডান নাসারন্ধ্র টিপে ধরে বাম নাসারন্ধ্র দিয়ে শ্বাস টেনে এবার অন্যান্য আঙুল দিয়ে বাম নাসারন্ধ্র টিপে ধরে ডান নাসারন্ধ্র দিয়ে শ্বাসটা ছাড়া এবং সেটাতেই পুনরায় শ্বাসগ্রহণ করে, প্রথমবারের ন্যায় সেটি বন্ধ করে অন্যটিতে ছাড়া ৷ এইবার সেটিতে গ্রহণ করে অন্যটিতে ছাড়া ! এইভাবে একই নাসারন্ধ্রে শ্বাস ছাড়া ও গ্রহণ অন্যটিতেও ছাড়া এবং গ্রহণ! এই প্রক্রিয়া ৫ মিনিট থেকে ১০ মিনিট করার কথা গুরু মহারাজ বলেছিলেন ৷ এতে কি হয় — না শরীরে বায়ুর সাম্যতা আসে ৷ প্রাণ-অপান তখন সমানে প্রবাহিত হয় ৷ এই অবস্থায় ধ্যান-জপ করলে মন খুব সহজেই একাগ্র হয় ৷ প্রাণের সাম্য না হলে তো মন স্থির হয় না —

তাই এই পদ্ধতির অনুশীলন একান্ত প্রয়োজন । যে কোনো মানুষ সকাল -সন্ধ্যা শুধু সহজ প্রাণায়াম অভ্যাস করলেও শারীরিক বা মানসিক ভাবে প্রভূত উপকার পাবে ।

৩) জপ্ – সহজ প্রায়ানাম শেষ করে ইষ্টমন্ত্র বা গুরুপ্রদত্ত বীজ মন্ত্রের শ্বাসে প্রশ্বাসে জপ । মন্ত্রের দুটি অংশ, শ্বাস টানতে টানতে প্রথম অংশ এবং শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে দ্বিতীয় অংশ । চোখ বন্ধ করে এই ক্রিয়া চলতে চলতে ভাবতে হবে যে যখন শ্বাস ভরছি তখন তার সাথে মন্ত্রের প্রথম অংশ কুলকুণ্ডলীতে গিয়ে পৌছাচ্ছে আর শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে দ্বিতীয় অংশ জপের সময় ভাবতে হবে তা যেন মেরুদন্ড বরাবর সহস্রারে গিয়ে পৌছাচ্ছে । এই ক্রমে “জপ” করতে করতেই কুলকুণ্ডলীর জাগরন এবং তার অগ্রগতির কাজ শুরু হয়ে যাবে ।

৪)মুদ্রা- গুরুমহারাজ দীক্ষা দানের সময় ব্যক্তি ভেদে বা অধিকারী ভেদে (সঠিক এটা আমার জানা নাই) ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিকে ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রার অভ্যাস করতে বলেছিলেন । কাউকে হয়তো উনি ব্রহ্মযোনি মুদ্রা কাউকে হয়তো খেচরী মুদ্রা (আমি এই দুটোর কথাই জানি)-ইত্যাদি অভ্যাসের জন্য বলেছিলেন । ধ্যান জপে নির্দিষ্ট আসনে বসার পর ,নাড়ীশুদ্ধি বা সহজ প্রাণায়াম হয়ে গেলো , এবার ঐ মুদ্রায় কমপক্ষে ৫ মিনিট অধিক পক্ষে ১০/১৫মিনিট বা তার বেশি থাকতে হবে ।

এই মুদ্রা দুটি (ব্রহ্মযোনি বা খেচরী) অভ্যাস করতে থাকলেই প্রাণ স্থির এবং মন একাগ্র হয়ে যাবে । শরীর হালকা বোধ হবে । ফলে শরীর এইবার ধ্যানের উপযুক্ত হয়ে উঠবে ।

৫) ধ্যান- গুরুমহারাজ বলেছিলেন উপরিউক্ত ৪টি step হবার পর ধ্যান অভ্যাস করতে ।

মানুষের হৃদয়ের তিনটি অবস্থান – ১| শরীরের মাঝখানে Thymus gland বা অনাহত চক্রে ২| ভ্রুমধ্যস্থ স্থানে অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে বা Pituitary gland -এ এবং ৩। শরীরের সর্বোচ্চ অবস্থানে সহস্রারে বা Penal gland -এ।

সদগুরু_ শিষ্যের চেতনার অবস্থা অনুযায়ী বা তার স্বভাব ও সংস্কার বিবেচনা করে এই তিন টির মধ্যে যে কোনো একটি স্থানে মনোসংযোগ করে ধ্যান করতে বলেন । এগুলি যেন এক একটা কেন্দ্র । কেন্দ্র থেকে যেমন বৃত্তের বিস্তার হয় তেমনি এই সব স্থানে কুলকুন্ডলিনীর ক্রিয়া হলে তবেই সাধকের উত্তরনের পথ প্রশস্ত হয়।