[শ্রীরামপুরে(হুগলি) যখন ন’কাকা যেতেন তখন বিভিন্ন ধরনের ভক্তরা ওনার সিটিং-এ আসতো।তাদেরই দু-একজনের কথা হচ্ছিল। এখন প্রসঙ্গ হচ্ছিল তথাগত নামের একটি তরুন সন্ন্যাসীর…….]
প্রথম যেদিন ন’কাকার সাথে তথাগত-র সাক্ষাৎ হোল , সেই ব্যাপারটা ছিল খুবই Interesting ! ন’কাকা সেদিন শ্রীরামপুরে অসীম ব্যানার্জীর বাড়িতে আছেন ৷ ভক্তরা সবাই জড়ো হয়েছে , আলোচনা শুরু হবে __এমন সময় জানা গেল তথাগত ন’কাকার সাথে দেখা করতে ওখানে আসছে !
আমরা আগের দিন যখন শ্রীরামপুরে পৌঁছুলাম, তখনই শুনেছিলাম যে তথাগত নামের সাধক ছেলেটি ন’কাকার সাথে দেখা করতে আসবে। আমরা শুনেছিলাম সাধারণতঃ তথাগত বড় একটা বাড়ির বাইরেই বেরোতো না – সেখানে এতটা আসতে হবে ! আসবে তো ? আমাদেরও একটা কৌতুহল ছিল এই নবীন সাধুবাবা বা সাধকটিকে দেখার ! অবশ্য তার আগের দিন বিকালে বা সন্ধ্যার দিকে তথাগত-র মা এসে ন’কাকার সাথে দেখা করে গেছেন ! তাঁর কাছ থেকে তথাগত সম্বন্ধে নানা কথা শুনেই কৌতুহলটা বেড়েছিল! ওর মা বলছিল যে তথাগত-র সাথে রাত্রে অনেক দেব-দেবী , মহাপুরুষরা দেখা করতে আসে! তাদের অনেককে ওনার মা-ও দেখেছেন! এমনকি অসীমদার ঘরে থাকা গুরু মহারাজের ফটো দেখে বললেন যে , “এনাকে(গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ)-ও দুদিন দেখেছি! একদিন উনি(গুরু মহারাজ_স্বামী পরমানন্দ) তথাগত-র ঘর থেকে বেড়িয়ে আসছিলেন তখন দেখলাম , আর একদিন দেখলাম উনি (গুরু মহারাজ_স্বামী পরমানন্দ) আমাদের ছাদে দাঁড়িয়ে গঙ্গার জলের দিকে চেয়ে রয়েছেন (ওদের বাড়ীটা একদম গঙ্গার তীরেই ছিল)”। তাছাড়া ওর মা বলেছিল যে_ওনার ছেলে নিজে নিজেই নিজের সন্ন্যাস নিয়েছে ! সমস্ত ক্রিয়া অর্থাৎ সন্ন্যাসের জন্য হোম-যজ্ঞাদি সব ক্রিয়াই তথাগত ছাদে বসে বসে নিজে করেছে! যজ্ঞাদি ক্রিয়ান্তে ও মা-কে বলেছিল, “যাও ! ঘর খুঁজে গেরুয়া কাপড় নিয়ে এস” ৷ ওর মা পড়েছিল মহাফাঁপড়ে ! রাত্রিবেলায় কোথায় পাবে গেরুয়া কাপড় ? কিন্তু ছেলের উপর মায়ের অগাধ বিশ্বাস – ছেলে যখন বলছে , তখন নিশ্চই ঘরে রয়েছে গেরুয়া কাপড় ! সমস্ত আলমারির কাপড় ফেলে ফেলে খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেলো গেরুয়া কাপড় ! ছেলের পৈতার (বহু বছর আগে) সময় ব্যবহৃত কাপড় কোন কারণে “স্মৃতি” হিসাবে মা রেখে দিয়েছিলেন – যার কথা তাঁর নিজেরই মনে ছিল না , সেইটা পাওয়া গেল ! তবে তথাগত গেরুয়া কাপড় পড়তো না – অন্তর্বাস হিসাবে ভিতরে পড়তো ।
সেদিন ন’কাকার কাছে তথাগতর মা খুব দুঃখ করছিলেন । বাবা-মা হিসাবে তাঁরা চোখের সামনে দেখছেন যে ছেলেটি দিনের পর দিন খুদ-ঘাঁটা খাচ্ছে(তথাগত সাধারণ চালের ভাত খেতোনা, ওর চেতনায় একটা কথা কাজ করতো যে_ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষ তো পেট পুরে ভালো চালের ভাত খেতে পায় না __তাই ও সব চাইতে কম দামী চালের খুদ বা ভাঙা গুঁড়ো হয়ে যাওয়া চাল, নিজে বাজার খুঁজে কিনে আনতো এবং স্বপাক রান্না করে খেতো) , অথচ তাঁরা ভালো চালের ভাত খাচ্ছেন , বিভিন্ন সব্জী বা হয়তো সময় সময় মাছ-মাংসও খাচ্ছেন ! এতে মায়ের মনে খুবই কষ্ট হয় ! – এইসব নানাকথা সেদিন তথাগতের মা ন’কাকাকে বলে গেলেন!
পরদিন সকালের দিকে তথাগত এলো ন’কাকার সাথে দেখা করতে! আমরাও ওর সম্বন্ধে নানা কথা শুনে একটু উন্মুখ ছিলাম ওকে দেখার জন্য, ওর মুখ থেকে কিছু কথা শোনার জন্য ! ভারতীয় প্রাচীন পরম্পরাকে ঠিক ঠিক ভাবে রক্ষা করে চলেছে বা ধরে রেখেছে যাঁরা – তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান তো থাকবেই – ওকে দেখার কৌতুহলটা এই জন্যই !
তথাগত এলো ! হাঁটতে হাঁটতেই এলো ! দেখলাম প্রায় ৬ ফুটের উপর লম্বা , রোগা-পাতলা একটি যুবক ছেলে , যার পা ঠিকমতো পড়ছে না টলমল করছে ! চোখের দৃষ্টি পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে , মাথায় বড় বড় ঘন চুল অযত্নে অবিন্যস্ত – জট পাকায়নি কিন্তু জট পাকাতে দেরীও নাই ! গায়ের রঙ ফর্সা নয় তবে কালোও নয়! কিন্তু মুখের রঙটা যেন কাগজের মতো সাদাটে! এরকম টা হয় _যারা একদম রোদে বেরোয় না , ঘরে বসে ধ্যান-জপ করে তাদের মুখমন্ডলের রঙ এই ধরনের স্বচ্ছ হয়ে যায় (অাগেও দু-একজন সাধককে আমি এইরকমটাই দেখেছিলাম)! ঐ বাড়ীর গৃহকর্তা হিসাবে অসীম ব্যানার্জী একটু আগিয়ে গিয়ে ওকে আহ্বান করে নিয়ে এসে ঘরের মধ্যে বসালো! ন’কাকা এবং কিছু ভক্তমন্ডলী ঐ ঘরে আগে থাকতেই বসেছিলো ! তথাগতর জন্য একটা আলাদা আসন দেওয়া হোল– ও সেখানেই বসলো! আগেই আমরা শুনেছিলাম তথাগত বাইরে কোথাও কিছু খায় না – শুধু মাটির ভাঁড়ে জল খায় এবং একটু বাতাসা বা নকুলদানা (ঠাকুরের প্রসাদ হিসাবে) খেলেও খেতে পারে , অন্য কিছু নয় [তবে সেদিন অবশ্য খেয়েছিল , একটা গোটা হিমসাগর আম ওকে যখন গুরু মহারাজের প্রসাদ হিসাবে ‘রুনু'(আমার স্ত্রী) দিয়েছিল তখন ও খুব আনন্দ করে বাচ্চা ছেলেটির মতো কামড়ে কামড়ে হাত চেটে চেটে খেয়েছিল ৷পরে ও বলেছিল যে__কদিন ধরেই নাকি ওর দর্শন হচ্ছিল যে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ওকে বলছিলেন “আনন্দ করে আম খা”!]! ফলে সকলেই তখন চা-বিস্কুট খাচ্ছিলো –ও কিন্তু তখন কিছুই খেলো না !
আমি ওকে খুবই লক্ষ্য করছিলাম , দেখলাম অত্যাধিক লম্বা বলেই হয়তো একটু ঝুঁকে বসে আছে , তবে বসে বসেই বাচ্চাদের মতো নড়াচড়া করছে ! ওর মধ্যে শিশুসুলভ একটা ভাব ছিলো – এটা আমরা তখন খুব দেখেছি ! কিন্তু যখনই কথা বলতে শুরু করতো – তখন কিন্তু শান্ত অথচ গম্ভীর , যেন যথার্থ জ্ঞানী ! তবে কথা বলার সময় গীতা , উপনিষদ বা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথার উল্লেখ করতো ! এটা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, ও ওর সাধন-কুঠীরে সব সময়ই যে সাধন-ভজন করে তা নয়, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থও পড়াশোনা করে।। (ক্রমশঃ)