ন’কাকা যে কথাগুলি বলতেন – সেগুলিকে কেউ তাৎক্ষণিকভাবে নোট করেছে কিনা তা জানা যায় না, তবে আমি এই কাজটি কখনো করিনি । গুরু মহারাজের অনেক কথা অনেকেই ছোট ছোট করে নোট করে রাখতো এবং পরে সেগুলি বিস্তৃত করে নিতো ! এইভাবেই গুরু মহারাজের বলা অনেক কথা ‘লেখা আকারে’ এখন আমরা পেয়ে থাকি । ন’কাকার ক্ষেত্রে তেমনটা আমার করা হয়নি এবং আমি জানিনা অন্য কোনো ভক্তেরা এই কাজটি করেছেন কিনা! তবে এ কাজটা করাটাও খুব কঠিন ছিল – কারণ ন’কাকার কথা বলার স্টাইলটা-ই ছিল সম্পূর্ণ আলাদা ! আমি বারবার আপনাদের সকলকে একটা কথা বলার চেষ্টা করছি, সেটা হোলো – গুরুমহারাজ ছিলেন যেন সূর্য, কখনো প্রভাত সূর্য – যেন স্নিগ্ধতায় ভরা, কখনো মধ্যাহ্ন সূর্য – দীপ্তিমান, প্রখরতা, উজ্জ্বলতায় ভরা, অপরপক্ষে ন’কাকা ছিলেন চন্দ্রের শান্ত আলোর ন্যায় প্রকাশিত ! কিন্তু কোনো উত্তাপ নাই – প্রখরতা নাই ! পূর্ণচন্দ্রের আলোর প্রকাশটাও ভক্তেরা বোধহয় তাঁর কাছ থেকে কখনোই দেখতে পায়নি !
এবার ন’কাকার __’কথা বলা’র স্টাইলটা বলি ! তার আগে একটু বলে রাখা ভালো – ন’কাকা কথা বলার চাইতেও কাজের কাজ-টি করে দিতেন – অতি দ্রুত ! তাই তাঁর followers-রা তিনি কি বলেলেন – কতোটা বলেলেন – এই নিয়ে পরোয়াও করে নি । তারা সবাই জানতো ঐ মানুষটার কাছে গেলে, তাঁকে ভক্তিভরে প্রণাম করলে, তাঁর একটু সেবা করতে পারলেই – ওনার প্রসন্নতা অর্জন করা যাবে , আর ঐ মহাপুরুষটির প্রসন্নতা অর্জন করতে পারলেই – সেই ব্যক্তির জীবনের নানা বিঘ্ন নিমেষে কেটে যাবে ! তবে জিজ্ঞাসু বা জ্ঞানচর্চার অধিকারী ব্যক্তিরাও কি ন’কাকার কাছে যেতেন না বা তাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন না ? নিশ্চই করতেন – কিন্তু তাদের জন্য ন’কাকার আলাদা Style ছিল !
আমি যেটা কাছ থেকে দেখেছিলাম বা বুঝেছিলাম সেটাই বলছি – দেখুন, সমস্যা সকলেরই রয়েছে ৷ এক একরকম ব্যক্তির সমস্যা এক একরকম – এই যা পার্থক্য ! সাধারণ গৃহী নর-নারীর হয়তো একেবারে স্থূল সমস্যা – দেহের আধি-ব্যাধি, পরিবারের নানা সংকট, এই সবগুলো দূর করার আর্তি ! বুদ্ধিমান-শিক্ষিত-মানুষজনের হয়তো অনেক কিছু জানার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে – কিন্তু তারও পরিবারে বা ব্যক্তিগত জীবনে কি সমস্যা নাই ? রয়েছে – আর তারা প্রথমটায় ফটরম্-ফটরম্ করলেও চলে যাওয়ার আগে একান্তে, চুপিচুপি, ন’কাকার কানে কানে সেই সমস্যার কথাটি নিবেদন করে তবে যেতো !
এবার আসছি আর একটু উন্নত চেতনার ব্যক্তি, যারা ধ্যান-জপ নিয়মিত করে, অধ্যাত্ম পথে রয়েছে, তাদের কথায় । তারাও ন’কাকার কাছে আসতো – কিন্তু প্রথমটায় তারা থাকতো একটু দূরে-দূরে (কারণ ন’কাকা গৃহী, তাছাড়া অতি সাধারণ পোশাক এবং একেবারে সাধারণ Look !) – কিন্তু ন’কাকার কাছে আসা-যাওয়া শুরু করলেই তারা পেয়ে যেতো ন’কাকার অন্তর্জগতের অপার্থিব প্রেমের প্রবাহের খোঁজ ! আর যায় কোথায় – একবার সেই স্পর্শ বা devine touch পেলেই _ “আমি তোমার প্রেমে পাগলিনী”- অবস্থা !
আসলে দেখুন, মহাপুরুষদের আগমন-ই তো হয় মানব কল্যাণের নিমিত্ত ! তাই আমরা সাধারণ মানুষেরা যে কেউ, যে অবস্থাতেই থাকি না কেন – আমরা সবাই তো তাঁর কৃপা পাওয়ার অধিকারী ! আমি চাই বা না চাই, তিনি অযাচিতভাবে সকলকে কৃপা করে যাবেনই – এটাই মহাপুরুষগণের কাজ । চক্ষণজাদীর টগরদার সঙ্গে আমার যখনই এইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, তখন টগরদা একটা কথা বারবার বলে – ” দ্যাখো শ্রীধর ! ‘ধর্ম’ ব্যাপারটা তো আলাদা, ওটা সম্পূর্ণ Individual !”
গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) এইজন্যেই বলতেন – ” দলবেঁধে ধর্ম হয় না ৷” কোনো মহাপুরুষ কিন্তু কখনোই বলেন নি, ‘আমার প্রতিষ্ঠিত ধর্মমতটি-ই শ্রেষ্ঠ, বাকি সব নিকৃষ্ট ‘ – এই কথাগুলো পরবর্তীকালে অজ্ঞানী followers-রা তাঁর মুখে বসিয়ে দিয়েছে , তাদের নিজেদের কথা ওই মহাপুরুষের কথা বলে চালিয়ে দিয়েছে ! প্রকৃত পক্ষে ‘ধর্ম’ হ’ল ধ্যানের গভীরে, জ্ঞানের গভীরে উপলব্ধি বা বোধ ! তুমি ধ্যানের গভীরে ডুবে সেখান থেকে যা যা তুলে আনতে পারবে – সেই বোধটাই তোমার ‘ধর্মবোধ’, আমি যদি ওই গভীরতায় ডুবতে পারি এবং কিছু তুলে আনতে পারি – সেটাই হবে আমার ‘ধর্মবোধ’ ! তা না করে কোনো ধর্মনেতা বা রাজনেতা(এরা ‘নেতা’, এরা যশ, মান, অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তির পিছনে ছুটে বেড়ায় । এসব সহজভাবে পেলে ভালো, পাওয়ায় বাধা সৃষ্টি হলে এরা খুনোখুনি, অগ্নিসংযোগের ন্যায় চরম অমানবিক কাজ করতেও পিছপা হয় না!)-র কথা শুনে প্রভাবিত হয় অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষ । ধর্মভয় অথবা পরকালের সুখভোগের আকাঙ্ক্ষা এই মানুষগুলোরকে অনেকটাই অন্ধ করে তোলে I আর তাছাড়া ওই যে আগে বলা হয়েছে ‘সেন্টিমেন্ট’, এই সেন্টিমেন্ট-ই মানুষের প্রধান শত্রু।
‘Ego’ বা ‘Sentiment’-এর মধ্যে আবার পার্থক্য রয়েছে! রাজসিক ব্যক্তিদের ‘ego’ বা ‘অহং’-ই সমাজের ক্ষতি করে (কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু ভালো কাজও হয়), আর সেন্টিমেন্ট বা ‘অভিমান’ – তমোগুণী অর্থাৎ বেশিরভাগ আমজনতার ভূষণ ! জাত্যাভিমান, বর্ণাভিমান, শিক্ষাভিমান, ধর্মাভিমান, এখন আবার নতুন সংযোজন রাজনৈতিক দলাভিমান ! … [ক্রমশঃ]