রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় পড়েছিলাম – “খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশ পাথর”! যতদিন ওই ক্ষ্যাপা পরশ পাথর খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছিল, ততদিন তার মনে কখনো কোনো আফসোস তৈরি হয়নি, সে শুধু অভ্যাসবশতঃ রাস্তার নুড়িপাথর দেখলেই সেটা তার কোমরে জড়ানো একটা একটা লৌহখন্ডে ‘ঠং’করে ঠেকাতো আর ছুঁড়ে ফেলে দিতো ! কিন্তু যেদিন কোনো গ্রামের এক ছোট ছেলে ওই সন্ন্যাসীবেশী ‘খ্যাপা’-কে দেখিয়ে দিল যে তার কোমরের লৌহখন্ডটি স্বর্ণখন্ডে পরিণত হয়েছে – তখন ওই ‘ক্ষ্যাপা’-র মনে আফসোস তৈরি হোল, সে ভাবতে থাকলো – কত বছর ধরে, কত হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে , সে জীবনে কত শত-সহস্র-লক্ষ নুড়িপাথর হাতে করে তুলেছে এবং ওই লোহায় ঠেকিয়েছে – প্রথম প্রথম হয়তো লক্ষ্যও করতো লৌহখন্ড সোনায় পরিণত হোলো কি না ? তারপর নুড়ি-পাথর দেখলেই সেটি লোহায় ঠেকানোটা এমন অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল যে, আর সেটি স্বর্ণখন্ড হোলো কি-না – দেখার প্রয়োজন হোতো না ! হাতের এমন ‘বশ’ হয়ে গিয়েছিল যে, নুড়ি কুড়োনোর পর হাত আপনা-আপনি ঠিক ওটিকে নিয়ে গিয়ে লোহায় ঠেকাতো এবং ‘ঠং’ করে যেই শব্দ হতো অমনি সেটাকে ছুড়ে ফেলে দিতো, আর খ্যাপা সেটাকে তাকিয়েও দেখতো না ৷
গ্রামের সেই ছোট শিশুটি যেদিন খ্যাপাকে ডেকে বললো – ” এই যে সন্ন্যাসী ঠাকুর ! তোমার কোমরে জড়ানো সোনার খন্ডটা কি চকচক করছে গো ! ” অমনি খ্যাপার চমক ভাঙলো ! সে তাকিয়ে দেখে – হ্যাঁ তাইতো ! কোন অজ্ঞাত মুহূর্তে পরশপাথরের স্পর্শে লোহা সোনায় পরিণত হয়েছে ! আবার শুরু হল তার বিপরীত দিকে যাত্রা – আবার শুরু হোল অন্বেষণ, যে পথ ধরে এতদিন সে চলে এসেছে, সেই পথের প্রান্তেই মাটির ধুলায় কোথাও হয়তো পড়ে রয়েছে সেই পরশ পাথর ! যার ক্ষণিক স্পর্শে লোহা সঙ্গে সঙ্গে সোনা হয়ে যায় ।
গুরু মহারাজ এবং ন’কাকার ভক্তদেরও ওই ক্ষ্যাপার মতোই অবস্থা – একদিন সেই পরশপাথরকে হাতে বা হাতের কাছে আমরা পেয়েছিলাম, কিন্তু তখন তাঁর কতটা কদর __তা বুঝিনি ! অনাদরে-বেখেয়ালে তাকে পথের পাশেই ফেলে রেখে চলে এসেছি ,___হেঁটে এসেছি অনেকটা পথ ! নিজের পূর্ব পূর্ব জন্মের সংস্কারবশতঃ আমরা নিত্যদিনের কাজগুলি অভ্যাসমতো করে গেছি – কিন্তু সেই পরশমণির স্পর্শে আমাদের সকলের জীবনে কিছু না কিছু সদগুণের (সৎকর্ম, সৎচিন্তা, সৎআচরণ, সত্য কথা বলার প্রচেষ্টা ইত্যাদি) প্রকাশ ঘটে গেছে ! যেটা সমাজের কেউ (শিশুর ন্যায় সহজ-সরল যে, অন্ততঃ মনের দিক থেকে সে কলুষমুক্ত) চোখে আঙুল দিয়ে এটা দেখিয়ে দেয়, অথবা কোনো সময় আমরা হয়তো নিজেরাই বুঝে উঠতে পারি ৷
তখন আমাদের চৈতন্যে ঘা লাগে, চেতনার জগতে ‘বোধ’ হয় যে, “আমার যা কিছু ভালো – সেটা ঐ মহান মানুষটির স্পর্শেই লাভ হয়েছে !” এই ‘বোধ’-টি না আসা পর্যন্ত সঠিক অন্বেষণ হয় না – ক্ষ্যাপার মতো ‘এটার জন্য- ওটার জন্য’_ উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানোই সার হয় ৷ কিন্তু যখন নিজের কোমরে বাঁধা লোহা – সোনায় রূপ নেয়(অর্থাৎ মানুষ নিজেই নিজের পরিবর্তন টা টের পায়), তখনই ঠিক ঠিক ‘বোধ’ হয় যে – সত্যি সত্যিই “পরশমনি” বলে কিছু একটা বাস্তবিক রয়েছে ! এরপর যে পথে এতদিন উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটা হয়েছে – সেই পথেই এবার সঠিক উদ্দেশ্য নিয়ে হাঁটা শুরু হয় ! এবারের পথ ভাটার টানে ভেসে যাওয়া নয়, এখন উজান পথে হাঁটা !
এবার কিন্তু সাধক Sincere – আর ভুল হবার কোনো chance থাকে না । এবার যদি পরশপাথর হাতে আসে – আর “ছোরেগা নেহি”, এবার হাতে পেলে একেবারে বাগিয়ে ধরা যাবে ! এখন তাই – “প্রভু ! আমি তোমাকে যেন পাই”–এই প্রার্থনা নয়, এবার প্রার্থনা হবে _”প্রভু ! তুমি আমাকে তোমার করে নাও !”_ “প্রভু ! আমাকে তোমার কাজে লাগাও !”_ “আমার `আমি’-র যেন অবসান ঘটে, সবই যেন ‘তুমি-ময়’ হয়ে ওঠে !”
তবে, গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ আবার সবার ঊর্ধ্বে, সবার সবকিছুর ঊর্ধ্বে ৷ উনি একবার বলেছিলেন – ” তাই বলে তোরা যেন আমাকে ‘পরশমনি’ ভাবিস না ! আমি ‘পরশমনি’ তৈরি করি ! আমি যাদেরকে তৈরি করি – তারা সমাজের শত-সহস্র মানুষকে আলোর পথ, মুক্তির পথ দেখাবে । তারা এক একজন শত-সহস্র লোহা-কে স্বর্ণখন্ডে রূপান্তর ঘটাবে ৷”
আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম – তাহলে ‘পরশমনি’ তৈরি করতে পারে এমন পাথরের নাম কি হতে পারে – তাহলে তিনি কি “কৌস্তভ মনি” অথবা “সম্যন্তক মনি” !!
যাইহোক, আমরা আমাদের আলোচনায় ফিরে আসি । ন’কাকাও তো একজন ‘পরশমণি’ ছিলেন ! তাঁর স্পর্শ্যে যারা-ই এসেছে, তারা তা জানে এবং আন্তরিকভাবে সেটা মানেও । তিনি যতদিন শরীরে ছিলেন, ততদিন তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ভক্ত জনেদের কত নিশ্চিন্ততা, কত নির্ভরতা, কত দুশ্চিন্তামুক্ততা ! ‘ছেলে খুবই দুরন্ত’– তাই ন’কাকার কাছে বারবার অনুযোগ-অভিযোগ , কিন্তু একটা বিরাট নিশ্চিন্ততা ‘ছেলে যতই যা হোক, ন’কাকা তো মাথার উপরে রয়েছে – সুতরাং তার কোনো কিছু খারাপ হবে না, সবকিছু ভাল-ই হবে ৷’ ‘মেয়েটি পড়াশুনার জন্য বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে – মা-বাবার দুশ্চিন্তার অন্ত নাই, কিন্তু ন’কাকা তো রয়েছে, নিশ্চয়ই মেয়ের কোনো অসুবিধা হবে না !” – এইরকম সব নিশ্চিন্ততা ! যত ভক্ত _তত তাদের সমস্যা, আর ন’কাকার কাছেই যেন সমস্ত সমস্যার সমাধান!
আজ ন’কাকা শরীরে নাই – এখন কিন্তু ওইসব ভক্তজনেরা সেই ‘পরশমনি’কে হারিয়ে ফেলার অভাব ‘বোধ’ করছে এবং তারা নিজে নিজেই নিজেদেরকে উন্নত করার চেষ্টায় রত হয়েছে ! এইটাই তো লোহার ‘সোনা’ হয়ে ওঠা ! এই মানুষ-ই তো ‘সোনার মানুষ’ হতে পারে – শুধুমাত্র তার চেতনার উত্তরণ এবং বিবেকের জাগরণ ঘটিয়ে !
আমরাও, হরির অবতার গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ এবং সাক্ষাৎ শিবাবতার ন’কাকা (শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়)-র কাছে একান্ত প্রার্থনা করি – যেন সকল ভক্তজনেরা গুরুমুখী-ইষ্টমুখী হয়ে ওঠেন, গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী সাধন-ভজন করে তাদের আত্মিক উন্নতি ঘটাতে সমর্থ হ’ন ! বহির্জগতের আনন্দ এবং শান্তি না খুঁজে নিজের অন্তর্জগতে ধ্যানের গভীরতায় – জ্ঞানের গভীরতায় প্রবেশ করে জগতের রহস্য – জীবনের রহস্যের “বোধ” করতে সমর্থ হ’ন ৷ তাহলেই ঠিক ঠিক “ঈশ্বরের বোধ” হবে, অনাবিল-অপার্থিব শান্তি ও আনন্দের আস্বাদন হবে ! আর এটাই তো মানব জীবনের উদ্দেশ্য! সুতরাং এই উদ্দেশ্য মানবের যত তাড়াতাড়ি fulfil হয়_তত‌ই তাকে আর জন্মমৃত্যুর চক্রে বারবার ফিরে ফিরে আসতে হয় না!
গুরু মহারাজ এবং ন’কাকার কাছে সবার মঙ্গলের জন্য, সকলের কল্যানের জন্য প্রার্থনা জানাই__যাতে অধ্যাত্ম পথে সকলের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়!!
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।
জয় গুরু পরমানন্দ – জয় ন’কাকা !!