এরপর আমরা আসি – “ন’কাকা বীরভূমে”– প্রসঙ্গে । গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ)-এর শরীর ছাড়ার কয়েক বছর পর (২০০৪ – ০৫) বীরভূমে বোলপুরের সন্নিকট আদিত্যপুর আশ্রম পরিচালনার দায়িত্ব পান স্বামী ভুবেনেশ্বরানন্দ বা করিমপুরের নন্দ মহারাজ । নন্দ মহারাজ আদিত্যপুরে পাকাপাকিভাবে আসার আগে কমবেশি এক বছর বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে “আবাসিক অনাথ বালক”-দের দায়িত্বে কাজ করতেন ৷ এই সময়কালে নন্দ মহারাজের সাথে আমার এবং বনগ্রামের ন’কাকা বা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মোটামুটি ভালই অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে ৷ নন্দ মহারাজের খুব ছোটবেলাতেই বাবা ও মা মারা গিয়েছিল , বাড়ির পিসি বা অন্যান্য আত্মীয়দের তত্ত্বাবধানে ওনারা অর্থাৎ নন্দ মহারাজ বা তাঁর ভাই-বোনেরা মানুষ হয়েছিলেন ৷ ফলতঃ পিতার স্নেহের একটা অভাববোধ ওনার ছিলই – গুরু মহারাজের সংস্পর্শে উনি এলেও গুরু মহারাজ ছিলেন স্বীয় ভাস্বর্য্যে উজ্জ্বল – “তিনিই পিতা – তিনিই মাতা – তিনিই বন্ধু-সখা” – একথা ঠিকই , কিন্তু সবসময় গুরু মহারাজের কাছে যাওয়া যেতো না! তুলনায় ন’কাকা যেন মা-য়ের মতো , সদা স্নেহশীল ! যাঁর কাছে সবসময় যাওয়া যায় , সবসময় ফোন করা যায় , তাঁর কাছে বসা যায় , তাঁর পা দুটো টেনে কোলে উপর চাপিয়ে হাত বোলানো যায় , যাঁর কোলে চেপেও বসা যায় ! তাই , নন্দ মহারাজের অন্তরের অন্তঃস্থলের আর্তি ও পিতৃস্নেহের অভাববোধ ক্ষেত্রে গুরুজীর অবর্তমানে ন’কাকার স্নেহ ও আশীর্বাদ বর্ষনে _অনেকটাই পূর্ণ হয়েছিল !
এইবার , সেই নন্দ মহারাজ যখন আদিত্যপুর (বোলপুর) আশ্রমে পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন – তখন বোলপুরে গিয়ে প্রাথমিক ব্যাপারগুলি একটু সামলে নিয়েই উনি ন’কাকাকে আমন্ত্রণ জানালেন – ” ন’কাকা আপনি এইবার আদিত্যপুর আশ্রমে চলুন ।” ন’কাকা রাজী !
আমি যতদিন বনগ্রামে ছিলাম (২০০৫ – ২০০৬ পর্যন্ত ) ততদিন ন’কাকার সাথে আমার দু-বেলাই যোগাযোগ থাকতো । সকালে বনগ্রাম আশ্রমের কোন না কোন স্থানে [আশ্রমের অফিসে অর্থাৎ মুরারী মহারাজের কাছে , তৃষাণ মহারাজের বাবা থাকাকালীন_ তাঁর ঘরে , গোপাল ডাক্তারের ঘরে , পঙ্কজ বাবু (পরবর্তীতে স্বামী পরমাত্মানন্দ)-র ঘরে ইত্যাদি স্থানে] চায়ের আসর বসতো, আর যেখানেই বসুক না কেন সেখানেই আমার ডাক পড়তো!
আশ্রমে সকালের দিকে আমার কাজ ছিল হয় ছাত্রদের খাতা দেখা (যেহেতু সেইসময় আমি বনগ্রাম পরমানন্দ হাইস্কুলের টিচার ছিলাম) অথবা লেখালেখি করা। মে সময়ের কথা বলা হচ্ছে , সেইসময় আমার বেশিরভাগ সময় কাটতো গুরুমহারাজের অডিও এবং ভিডিও ক্যাসেট শুনে লেখা! সেই গুলোই পরবর্তীতে চরৈবেতি কার্যালয় থেকে “পরমানন্দ কথামৃত” (1/2/)_নামে প্রকাশিত হয়েছিল।
আমি আর গুরু মহারাজের ছোট ভাই গৌতম তখন থাকতাম সাধনা ভবনের (গুরু মহারাজের ঘরের পিছনের দিকে যে তিনতলা Building) ১৭নং ঘরে ! সকাল থেকেই ঘরে কাজ যা-ই করি না কেন – সবসময় উৎকর্ণ হয়ে থাকতাম কখন ন’কাকা ডাক দেবেন – “শ্রীধর ! চলে এসো !” আমি সাথে সাথে-ই দৌড় দিতাম ! এইভাবে প্রতিদিন সকালে ন’কাকার সাথে যোগাযোগ হোত –আর এক জায়গা হবার পর থেকেই চলতো নানান গল্প-গুজব ! আর বিকালের দিকে আমি চলে যেতাম ন’কাকার বাড়িতে ! ওখানে চা খেয়ে – একটু গল্প-গুজব করে উনি আশ্রমে চলে যেতেন , আর আমি হাঁটাহাঁটি করার জন্য জাবুইডাঙার দিকে পা বাড়াতাম (সেইসময় আশ্রমের অনেকেই এই পথে হাঁটাহাঁটি করতে যেতো – ফলে বেড়িয়ে পড়লেই সঙ্গী পাওয়া যেতো !) ! কিন্তু এসব কথা অনেক পড়ে বিস্তারিত বলা যাবে – এখন আমরা আবার ফিরে যাই ” বীরভূমে ন’কাকা ” প্রসঙ্গে ৷
নন্দ মহারাজের আমন্ত্রণে ন’কাকা বোলপুর (আদিত্যপুর) যেতে রাজী হয়েছিলেন এবং রাজী হয়েই উনি আমাকে জানালেন – “বাবা ! চলো , একবার আদিত্যপুর (বোলপুর) আশ্রম থেকে ঘুরে আসি ।” আমি তো একপায়ে খাড়া ! রাজী হয়ে গেলাম। সেই ন’কাকার সাথে আমার আদিত্যপুর মিশনে যাওয়া শুরু হয়ে গেল!
এবার আমার সাথে প্রথমবার ন’কাকার আদিত্যপুর আসা-(ন’কাকা এর আগেও আদিত্যপুর আশ্রমে অন্যভাবে এসেছিলেন!তখন ভল্লাবাবুর বাড়িতে এসে উঠেছিলেন।)-র বর্ণনাটা করা যাক ! সেদিন আমরা বনগ্রাম থেকে বেড়িয়ে জাবুইডাঙায় এসে বাস ধরে বর্ধমান এসেছিলাম। বর্ধমান থেকে ট্রেনে প্রান্তিক স্টেশনে নেমে ন’কাকাকে জিজ্ঞাসা করলাম – ” এবার তাহলে কিভাবে যাওয়া যাবে ? “ন’কাকা বললেন – ” চলো বাবা, হেঁটেই চলে যাই !” তাই হোল ৷ প্রান্তিক স্টেশন থেকে বনডাঙা (সাঁওতাল পল্লী)-র পাশ দিয়ে একটা বড় জলাশয়ের বাঁধ ধরে সোজা এলেই – মাঠের মধ্যে অবস্থিত ‘আদিত্যপুর পরমানন্দ মিশন’ ! সরাসরি প্রান্তিক ষ্টেশন থেকে মিশনে হেঁটে এলে হয়তো ২৫/৩০ মিনিট লাগে।(ক্রমশঃ)