(“বীরভূমে ন’কাকা ” _এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছিল। বীরভূমে গিয়ে আমার দীর্ঘদিনের দেখা ন’কাকা কেমন যেন পাল্টে গেলেন _সেই সব কথা হোক! আলোচনা আরও এগিয়ে চলুক!)
সবার জন্য উন্মুক্ত, সবার কাছে উদার – — এই ন’কাকাকে আমি সত্যিই কিন্তু আগে দেখিনি ! বর্ধমানে উনি নিজেকে ঢেকে-ঢুকে রাখতেন , শক্তিকে চেপে-চুপে রাখতেন, কোনোরকম আবেগ বা উচ্ছ্বাসকে একদম পাত্তাই দিতেন না । কিন্তু বীরভূমে এসে ন’কাকা হয়ে গেলেন একদম উদার , খোলামেলা , সবার জন্য উন্মুক্ত ! প্রথমে আমি চমকে গেছিলাম যে ঘটনায় , এবার সেই ঘটনাটা বিস্তারিত বলছি ৷ সনৎ কাকুর সম্পর্কিত বেয়াই মশাই , (কীর্ণাহারের পার্থ চ্যাটার্জির শ্বশুরমশাই) সুকুমার মুখার্জির বাড়ি বীরভূমের তারাপীঠের সন্নিকটস্থ গ্রাম ‘চাকপাড়া’-য় ৷ সুকুমার বাবু বিশিষ্ট ভদ্রলোক এবং খুবই ভক্ত মানুষ ! উনি ন’কাকাকে সাক্ষাৎ বামদেব জ্ঞানেই ভক্তি করতেন। ন’কাকা প্রথমবারের জন্য যে বার সুকুমার বাবুর বাড়ি ‘চাকপাড়া’-য় গেলেন , ঠিক তার আগেই ওনার ছোট মেয়ে ( যার সিউড়িতে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত মাষ্টারমশাই-এর ছেলে মিলুর সাথে বিবাহ হয়েছিল)-র বিবাহ হবার কিছুদিনের মধ্যেই Mis-carriage হয়েছিল, এবং তারপর থেকে মেয়েটির দারুণ শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল!
ন’কাকা চাকপাড়া আসছেন জেনে [প্রথম বছর চাকপাড়া যাবার ব্যবস্থা করেছিল পার্থ (কীর্ণাহার) ও ওর স্ত্রী জবা, যেহেতু ওরা আশ্রমের পুরোনো ভক্ত) মুকুজ্জে মশাই ছোট মেয়েকে আগে থেকেই বাড়িতে এনে রেখেছিলেন । মেয়েটিকে দেখার পর আমার মনে হয়েছিল _ছোট বয়সের মেয়ে (সবে দ্বাদশ শ্রেণী উত্তীর্ণ হবার পরেই বিবাহ হয়েছিল) , তার উপর বিবাহের অল্প দিনের মধ্যেই ঐরকম একটা ‘Mishap’ হওয়ায় রোগা-পাতলা ফরসা মেয়েটি তখন সত্যি সত্যি একেবারেই ভেঙে পড়েছিল ৷! ‘ন’কাকার ন্যায় মহাপুরুষের পায়ে একবার ফেলতে পারলেই – মেয়েটির শোক ও অবসাদ থেকে মুক্তি ঘটবে এবং মেয়ের পরবর্তী জীবন সুখের হবে’ – মুকুজ্জে মশাই-এর এটি দৃঢ় বিশ্বাস ছিল(চাকপাড়ার মুকুজ্জে মশাই এর ন’কাকার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাস যে কতটা প্রবল ছিল _তা যারা দেখেননি, তারা কোনো কারণেই বুঝতে পারবে না ! প্রত্যেকবার ন’কাকা যখন ওনার বাড়ি থেকে চলে আসতেন _তখন ন’কাকার পা-দুটো ধরে মুকুজ্জে মশাই-এর হাউহাউ করে কান্নার দৃশ্য– এখনও আমাদের চোখে ভাসে!)
ন’কাকা ঐ মেয়েটির ব্যাপারে কিছু কথা আগে থেকেই (ফোনের মাধ্যমে)- জানতেন । আমি কিন্তু কিছুই জানতাম না – সেজন্যই হয়তো ব্যাপারটা যখন আমার সামনে ঘটল , তখন আমি অতটা বেশী অবাক হয়েছিলাম !
ন’কাকা দলবল (নন্দ মহারাজ , আমি অসিত দা , সনৎ কাকু)-সহ পৌঁছে গেছিলেন বিকেলের মধ্যেই । সেবার আদিত্যপুর আশ্রম থেকে ট্রেনে মুকুজ্জে মশাই-এর বাড়ি চাকপাড়া যাওয়া হয়েছিল ৷ ট্রেনটি ‘তারাপীঠ’ স্টেশনে থামার কথা নয় – ওটার স্টপেজ ছিল রামপুরহাটে । কিন্তু চাকপাড়া গ্রামটি ‘তারাপীঠ’ স্টেশনের কাছাকাছি হওয়ায় – হঠাৎ করে ট্রেনটি ওই স্টেশনেই থেমে গেল এবং বলাই বাহুল্য ন’কাকার সাথে সাথে আমরাও টুক করে ঐ স্টেশনেই নেমে পড়েছিলাম! সুকুমার বাবু তো এরমধ্যেও বামদেবের অলৌকিকত্বের সাদৃশ্য পেয়ে গেলেন এবং তা সগৌরবে আমাদের কাছে প্রকাশও করতে শুরু করলেন!
যাইহোক , ওনার বাড়ী গিয়ে বাড়ির লোকের প্রাথমিক প্রণাম পর্ব , সবার সাথে পরিচয় পর্ব , অল্প সল্প জলখাবার খাওয়া পর্ব , ইত্যাদি সারা হোল । ভদ্রলোকের দুই মেয়ে ও এক ছেলে । ছেলেটি গ্রাজুয়েশন করছিল ৷ বড় মেয়ের কীর্ণাহারে সনৎকাকুদের পরিবারে অর্থাৎ সনৎকাকুর দাদা বিশিষ্ট ভদ্রলোক হাইস্কুলের শিক্ষক সুশীলবাবুর ছেলে পার্থ-র সাথে বিবাহ হয়েছিল ৷ আর ছোট মেয়েটির বিবাহ হয়েছিল পূর্বে বর্নিত মিলু-র সাথে!
ঐ মেয়েটির -ই জীবনে বিবাহের পরে পরেই ঐ বিপত্তি ঘটে গেছিল ! মেয়েটি একে রোগা-পাতলা – তাতে অত বড় ঘটনায় এমন ভীষণভাবে মুষড়ে পরেছিল যে প্রায় খাওয়া-দাওয়া বন্ধ , ওঠা-হাঁটাও বন্ধ হবার মতো অবস্থা ! সন্ধ্যার সময় ন’কাকার সাথে মেয়েটির একান্তে কথাবার্ত্তা বলার সময় নির্ধারিত হ’ল – সাক্ষী হিসাবে ন’কাকার সাথে থাকার Permission হোল শুধু একা আমার !
কি দেখলাম সেদিন ! – মেয়েটিকে ওর বাবা (সুকুমার বাবু) এবং বড়দিদি (জবা) ধরে ধরে নিয়ে এসে ন’কাকাকে প্রণাম করিয়ে দিল – তারপর ওরা চলে গেল ৷ এইবার ন’কাকা মেয়েটির মাথায় পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন – ” তোর কি হয়েছে , শরীর-কে এত কষ্ট দিচ্ছিস কেনো ? তোর বাবা বলছিল – তুই কিছুই খাওয়া-দাওয়া করছিস না ! এসব করলে তুই বাঁচবি কি করে ? তোর সমস্যাটা কি হচ্ছে — সেইটা আমাকে বল দেখি !” মেয়েটি কাঁদতেই থাকল ! ন’কাকা তাকে যত আদর করছে – মেয়েটি ততই কাঁদছে , মুখে কোনো কথা বলতে পারছে না ! তখন ন’কাকা মেয়েটিকে বললেন – ” তুই কাঁদছিস কেনো – তোর বাচ্চাটা Miscarriage হয়েছে বলে কষ্ট পাচ্ছিস ? আচ্ছা – আচ্ছা – তোর ছেলে হবে ! আমি বলছি – তোর ছেলে হবে ! তুই আর কি চাইছিস বল্ ? তোর অত ভালো শ্বশুর শাশুড়ি(এসব ন’কাকা মুকুজ্জে মশাই-এর কাছে শুনেছিলেন) – তাদের মেয়ে হয়ে থাকবি ! তোর কোনো অসুবিধা হবে না ! আমি বলছি – তোর সব ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে ।”
দুই তিন হাত দূর থেকে এইসব কথা শুনতে শুনতে আমি যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম , এ কোন ন’কাকা-কে দেখছি ! এই ন`কাকাকে তো আগে কখনো দেখিনি ! বর্ধমানের ন’কাকা যেন সমস্ত ছদ্মবেশ খুলে ফেলে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ করে দিয়েছিলেন বীরভূমে গিয়ে ! আমি তখন আমার পরিচিত অনেককেই বলতাম, _’নতুনরূপে ন’কাকাকে যদি দেখতে চাও _তাহলে বোলপুর আশ্রমে(আদিত্যপুর) ন’কাকা থাকাকালীন সময়ে একবার যেও _তাহলেই নিজের চোখে সব দেখতে পাবে!’ এই ন’কাকাকে নিয়েই আমাদের আলোচনা “বীরভূমের ন’কাকা” ৷(ক্রমশঃ)