[বীরভূমে ন’কাকা প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল । এখন আমরা সেই প্রসঙ্গেই আগিয়ে যাই! ]
আমরা বীরভূমে দেখেছিলাম খুব উচ্চ শিক্ষিত লোকেরা ন’কাকাকে প্রথম দিকে তেমন একটা ভালোভাবে নিতো না ! কিন্তু কিছুদিন যাওয়া আসা করতে করতেই ন’কাকার অলৌকিক সারল্য ও সহজতার কাছে তাদের সবার বিদ্যে_বুদ্ধি, জারিজুরি সব কিছুই পরাস্ত হয়ে যেতো !
ফলে, আমরা অবাক হয়ে দেখতাম সেই মানুষগুলোই কিছুদিনের মধ্যে সস্ত্রীক এসে ন’কাকার পদসেবা করছেন অথবা তাঁর পদপ্রান্তে বসে দুটো হরিকথা-গুরুকথা শুনছেন! মহাপুরুষদের যে কত রকম লীলা আর মানুষকে বশে আনার কত ধরনের কৌশল __তার বোধহয় ইয়ত্তা করা যাবে না ! আমরা খুব কাছ থেকে গুরুমহারাজ(স্বামী পরমানন্দ)-কে দেখেছিলাম, আবার ন’কাকাকেও দেখলাম! ন’কাকা মায়ের মতো হওয়ায় _ একেবারে close থেকে তাঁর জীবনযাত্রা , কার্যপ্রণালী দেখেছিলাম – তাই এসব কথা বলা সম্ভব হচ্ছে!
ন’কাকা বীরভূমের প্রায় সব জায়গায় আমাকে সাথে নিতেন বলে ওখানকার বেশিরভাগ ভক্তদের সাথেই আমার খুবই সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ফলে, তাদের সবার সাথেই আমার অল্প-বিস্তর মেলামেশা করার সুযোগও হয়েছিল এবং তাদের সাথে নানা কথার মাঝে ন’কাকার বিষয়েও কথা হয়েছিল । দেখেছিলাম _একটা Common কথা সকলেই বলতো, সেটা হলো_ ” জানেন তো শ্রীধরদা! ন’কাকা আমাদের মনের কথা এবং মনের ব্যথা আগাম বুঝতে পারেন! আমরা হয়তো ভাবছি – ‘ ন’কাকাকে ফোনটা করব ‘– এমন সময় ন’কাকার ফোন বেজে উঠলো ! ফোন ধরতেই যে সমস্যার কথা বলবো ভাবছিলাম – উনি সেটাই আলোচনা করতে লাগলেন !”
এই কথা আমরা একজনের কাছে শুনিনি – বহু জনের কাছে শুনেছি ! এসব ঘটনা একবার বা দু’বার শুনিনি __বহুবার করে শুনেছি ! আমাকে যদি সত্যি কথা বলতে হয় , আমার জীবনেও আমি ন’কাকার ঐশী শক্তির প্রকাশ ঘটতে বারবার দেখেছি ! কিছু কিছু হয়তো আগে আগে লেখা হয়ে গেছে , কিছু কিছু পরে পরে লেখা হবে।
বোলপুরের দেবাশীষ মাস্টারমশাই যখন প্রথম প্রথম আদিত্যপুর আশ্রমে আসা যাওয়া করতে শুরু করলেন – তখন ওনার পাড়ার ছেলেরা অনেকে আশ্রমের ভক্তদেরকে বা মহারাজদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন – ” ওই ভদ্রলোক আমাদের পাড়ার লোকেদের সাথেই ভালোভাবে মেশেন না – উনি কি করে আশ্রমের মানুষজনকে আপন করতে পারছেন ?” অর্থাৎ তারা বলতে চেয়েছিল যে, উনি আদিত্যপুর আশ্রমে আসছেন সেখানে অনেকক্ষণ সময় কাটাচ্ছেন _পুরো family নিয়ে ওখানে কোন কোনদিন খাওয়া-দাওয়া করছেন – এইগুলো ওনার পাড়ার মানুষের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল !
সকল বিস্ময়ের মীমাংসক ছিলেন ন’কাকা ! মাস্টারমশাই সাইন্সের ডক্টরেট করা লোক , পন্ডিত বংশের ছেলে _ পাণ্ডিত্যাভিমান তো থাকবেই ! কিন্তু কেমন করে ন’কাকার সহজতা ও সরলতার কাছে কখন যেন মাস্টারমশাই গলে জল হয়ে গেলেন! গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন_”পন্ডিতের যদি পান্ডিত্যাভিমান না থাকে, তাহলে আর তার রইল টা কি? পন্ডিতেরা তো ঐটাকে অবলম্বন করেই বেঁচে থাকে। তবে যদি সত্যি সত্যিই কোনো পন্ডিত তার পান্ডিত্যাভিমান ত্যাগ করতে পারে_তাহলে জানবে ঐ ব্যক্তি আধ্যাত্মিক। অতি সত্বর তিনি ঈশ্বরের প্রিয় হয়ে উঠবেন”।
ন’কাকা আদিত্যপুরে থাকলে প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে দেবাশীষ মাস্টারমশাই চলে আসতেন! তার অনেক আগে থেকেই ন’কাকা প্রাতঃকৃত্য সেরে একেবারে Ready ! আর আমরা একে সুখী মানুষ_ তায় অধিক রাত অব্দি গাল-গল্প করে ভোরে ওঠায় আলিস্যি ! তবু আদিত্যপুর আশ্রমে ন’কাকার সাথে চা-চক্রে যোগ দেওয়ার আনন্দ – ছাড়াও যায় না ! তাই ঘুম ঘুম চোখে গিয়ে হাজির হোতাম ন’কাকার ঘরে(অর্থাৎ ন’কাকা যখন যে ঘরে থাকতেন)! একে একে সেখানে উপস্থিত হতেন নন্দ মহারাজ , শশাঙ্ক মহারাজ , বীরভূমের মন্ডলেশ্বর বলে যাকে আমরা ডাকতাম সেই বিখ্যাত ‘মানিক বাবা’ , আশ্রমিক তাপস দা , চিন্ময় ডাক্তার , অসিত দা এবং অবশ্যই দেবাশীষ মাস্টারমশাই ! মাস্টারমশাই এসে পৌঁছানো মাত্রই ন’কাকার সে কি আনন্দ , “এই তো মাস্টার চলে এসেছে ! বাবা , এ আফিমের নেশা ! একবার খেয়েছ কি মজেছো !” এরপর চলতো চা-পর্ব ! মধুমিতা (আদিত্যপুর আশ্রমের মধু মা) এক ফ্লাক্স চা এবং একটু দামি মিষ্টি বিস্কুট নিয়ে এসে হাজির হোত ৷ ন’কাকা বিস্কুটের প্যাকেট ছিঁড়ে সবাইকে দুটো দুটো করে বিস্কুট দিতেন – আর সঙ্গে চা ! এইবার শুরু হোত গল্প ! সে কি গল্প – বেশিরভাগ দিনই নানান মজার মজার ঘটনার উপস্থাপনা হোত , আর ঐ আসরে হাসির কলরোল বয়ে যেতো !(ক্রমশঃ)