ন’কাকার সাথে ১৯৮৩ সাল থেকেই আমার যোগাযোগ হোলেও এটি সম্পর্কে রূপান্তরিত হয় , যখন আমার বড় শ্যালক (স্ত্রীর দাদা) শ্রীরামপুরের(হুগলি) অসীমের সাথে ন’কাকার ছোট শ্যালিকা (ন’কাকীমার বোন)-র বিবাহের সম্পর্ক স্থাপন হ’ল ৷
আমার শাশুড়ীমাতা গুরু মহারাজকে খুব পীড়াপীড়ি করেছিলেন তার বড়ছেলের বিবাহের একটা ব্যবস্থা করার জন্য ! গুরু মহারাজ প্রথমটায় আমার শাশুড়ীমাতাকে খুবই বোঝান – বিবাহ না দেবার জন্য ! কিন্তু বৃদ্ধা , মাতৃসমা ঐ ভদ্রমহিলার (শাশুড়ীমাতা) কথা গুরু মহারাজ অগ্রাহ্য করতে পারেন নি ! উনি তৃষাণ মহারাজকে ডেকে (তৃষাণ মহারাজ ওনার সাথেই ওখানে উপস্থিত ছিলেন) অসীমের বিবাহের জন্য ঐ নির্দিষ্ট মেয়ে (ন’কাকার শ্যালিকা)-টির জন্য বলে দেন ৷ এরপরই ওনারা (তৃষাণ মহারাজ এবং ন’কাকা) আমাকে ডেকে পাঠান এবং ঐ সম্পর্ক দ্রুত স্থাপন হয় ।।
এই সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে দিয়েই ব্যক্তিগতভাবে ন’কাকা ও তৃষাণ মহারাজের সাথে সেইসময় আমার খুবই ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ! এই ঘনিষ্ঠতা ন’কাকার ক্ষেত্রে দিন কে দিন বাড়তে বাড়তে ‘পিতাপুত্র’ বা ‘মাতাপুত্র’-তে এসে পৌঁছেছিল ! এরফলে ন’কাকা হয়ে উঠেছিলেন আমার guardian , আমার friend , philosopher & guide !
শুধু যে স্থূলে-ই এই সম্পর্কগুলি ছিল তাই নয় , সূক্ষেও (কারন জগতের খবর জানি না) ওনার সাথে আমার নিবিড় যোগাযোগ ছিল । রাত্রে ঘুমিয়ে থাকাকালীন (স্বপ্ন – কিন্তু স্বপ্ন নয় !) ন’কাকা আমাকে কতস্থানে নিয়ে গেছেন – কত জিনিস দেখিয়েছেন – কত জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়েছেন – কত প্রশ্নের মীমাংসা করেছেন তার ইয়ত্তা নাই ! তাই তাঁর সম্বন্ধে আমাকে কেউ অন্যকিছু বললে — আমি কি করে মানতে পারবো ? আমি যে Practically তাঁর নানা লীলার / নানা ঘটনার সাক্ষী ! আমার সামনেই যে নানারকম ঘটনা ঘটেছে ! সেইগুলিই একে একে পাঠকের সামনে তুলে ধরবো । ন’কাকার ইচ্ছা থাকলে এই কাজ সম্পন্ন হবে ! এতে যদি পাঠককুলের মনে ভারতীয় প্রাচীন পরম্পরার প্রতি , মহান সাধকদের প্রতি , মহাপুরুষগণের প্রতি একটু হলেও ভক্তি-শ্রদ্ধা উৎপন্ন হয় , তাহলেই এই লেখার সার্থকতা । অন্যথায় খবরের কাগজ পড়ার মতো লোকে হয়ত পড়বে – তারপরে টেবিলের তলায় ছুঁড়ে ফেলে দেবে – মনের মণিকোঠায় সযত্নে রাখবে না !
ন’কাকাকে যারা বনগ্রামে দেখেছে , হয়তো দীর্ঘদিন দেখেছে – তারাও ঠিকমতো জানে না – বীরভূমে (আদিত্যপুর আশ্রমে, কীর্ণাহার, সিউড়ি, আমোদপুর, চাকপাড়া – তারাপীঠ ইত্যাদি স্থানে) ন’কাকা কতটা আলাদারকম হয়ে যেতেন ! বনগ্রামে ন’কাকার মেজদা (রমাপ্রসাদ মুখার্জী , তপিমা-র বাবা) যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন তো ন’কাকা যেন ‘দাদার ভাই’ হিসাবে থাকতেন! দাদা যা বলতেন – তাই উনি শুনতেন । ন’কাকাদের দুটো বাড়ী , যে বাড়ীতে গুরু মহারাজ যেতেন ঐ বাড়ীতেই রান্না-বান্না , খাওয়া-দাওয়া ; সবাই ওখানেই সারা দিনটা কাটাতো । রাত্রে ন’কাকা আর ন’কাকীমা অন্য বাড়ীতে শুতে আসতেন (এখন ওনারা যে বাড়ীতে থাকেন)। পুরোনো বাড়ীতে দেখতাম ন’কাকীমা সারাদিন মুখ বুঁজে সংসারের কাজ করতেন ।
সন্ধ্যার সময় গুরু মহারাজ যখন মুখার্জি বাড়ীতে যেতেন – তখন ন’কাকীমা কাঁচের গ্লাসে চিনি ছাড়া লিকার চা করে নিয়ে এসে গুরু মহারাজকে দিয়ে গলায় আঁচল দিয়ে প্রনাম করতেন ৷ মাঝে মাঝে গুরু মহারাজ গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলতেন – “কাকীমা ! এক গ্লাস জল দেবেন তো” ! কাকীমা কাঁসার গ্লাসে এক গ্লাস জল নিয়ে এসে গুরু মহারাজের হাতে ধরিয়ে দিতেন – আর গুরু মহারাজ প্রায় সাথে সাথেই জলটা সব খেয়ে নিয়ে খালি গ্লাসটা ন’কাকীমার হাতে ধরিয়ে দিতেন । ন’কাকীমা ঐ গ্লাসটি নেবার জন্যই দাঁড়িয়ে থাকতেন ৷
এরপর গুরু মহারাজ চা-টি কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে ধীরে ধীরে সময় নিয়ে নিয়ে খেতেন । এক-একদিন তপিমার মা বলতেন – “বাবা ! যাবার সময় একটা কৌটো দেবো – সঙ্গে করে নিয়ে যাবে” ৷ তার মানে হচ্ছে , হয়তো বাড়ীতে কোন একটু ভালো কিছু খাবার রান্না হয়েছে – সেটি একটি ছোট্ট কৌটোয় ভরে দিয়ে দেওয়া হোত ৷ গুরু মহারাজ চলে যাবার সময় ঐ ছোট কৌটোটি ঝোলাতে ঝোলাতে নিয়ে চলে যেতেন ! ….. [ক্রমশঃ]