[ন’কাকা এখন বীরভূমের আদিত্যপুর আশ্রমকে কেন্দ্র করেই রয়েছেন! তাই এখন ওখানকার নানা ব্যক্তি এবং নানা ঘটনা _যেগুলি ন’কাকার সাথে যুক্ত, সেগুলি আলোচনা করা হচ্ছে!]
আদিত্যপুর আশ্রমের প্রায় জন্মলগ্ন থেকে আদিত্যপুর গ্রামের যে ছেলেটি এই আশ্রমের সাথে যুক্ত রয়েছে – তার নাম হলো ধনপতি মুখুজ্জে (মুখার্জি) । ধনপতি(ধনা)-র সাথে ন’কাকার সম্পর্কটি ছিল বেশ মজার ! ধনপতি মন থেকে মানতো যে ন’কাকা “বড় ভগবান” না হলেও “মেজো ভগবান” বা “সেজো ভগবান” [আদিত্যপুর আশ্রমের কিছু কিছু মানুষের কাছে এই ব্যাপারটির খুব চল ছিল যে , গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ ভগবান – এটার কোন দ্বিমত নাই , কিন্তু ভগবান শরীর নিলে তাঁর সাথে ভগবৎ শক্তিসম্পন্ন আরো দু-চারজন তো আসেন ! তাহলে তাঁরাও ভগবান – তবে তাঁরা “মেজো ভগবান” , “সেজো ভগবান” ইত্যাদি] ! কিন্তু যখনই ধনা (ধনপতি) ন’কাকার মুখোমুখি হোত – তখনই ও ন’কাকার সাথে ঝগড়াঝাঁটি বা মনোমালিন্যের সৃষ্টি কোরতো ! আমরা অবাক হোতাম, হয়তো মনে মনে একটু বিরক্তও হোতাম – কিন্তু ন’কাকা হাসতেন ! আদিত্যপুর আশ্রমে ন’কাকা গেলে ওখানকার ভক্তরা ঘর-গৃহস্থালির শত শত কাজ ফেলে , ট্রেন-বাস ধরে ন’কাকার সাথে দেখা করতে যেত , ন’কাকার কাছে আশীর্বাদ নিতে যেতো – কিন্তু ধনপতি ছিল তার ব্যাতিক্রম ! ও আদিত্যপুর গ্রামের ছেলে অর্থাৎ আশ্রমের খুব কাছেই ওর বাড়ি – তাছাড়া সে এই আশ্রমের প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই আশ্রমের সাথে যুক্ত! তাই এমনিতে প্রতিদিনই ‘ধনা’ আশ্রমে সকাল-বিকাল হাজিরা দিতো । কিন্তু এক একবার দেখতাম _ন’কাকা এই আশ্রমে এলে ধনা আর আশ্রমমুখো হতে চায় না ! যদিও বা নন্দ মহারাজ এবং অন্যান্য ভক্তরা (ডক্টর চিন্ময়, প্রফেসর কৌশিক বা ওর স্ত্রী চন্দ্রা) ফোন কোরে কোরে ওকে আশ্রমে আসতে বাধ্য কোরতো –কিন্তু ও আর ন’কাকার কাছ দিয়ে যেতে চাইতো না !
শেষমেষ ন’কাকা যেদিন আশ্রম থেকে বনগ্রামে চলে যাবেন – সেই দিনে অথবা তার আগের রাত্রে, নন্দ মহারাজ এবং আমরা সবাই ধরে পাকড়ে ওকে নিয়ে গিয়ে ন’কাকার ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতাম! এইবার যা হবার মুখোমুখি হোক্ ! কিসের যে ‘ধনা’-র এত মান-অভিমান চলতো তা ‘ধনা’-ই জানে আর ন’কাকা জানতেন !
আসলে প্রতিটি মানুষেরই জীবনে কিছু কিছু অপ্রাপ্তি থাকে , সেখান থেকেই মানুষের মনোজগতে জন্ম নেয় ক্ষোভ ! গুরু মহারাজ বলতেন , ” প্রথমে মনোজগতে সৃষ্টি হয় ‘ক্ষোভ’ , ‘ক্ষোভ’ বাড়তে বাড়তে সৃষ্টি হয় ‘বিক্ষোভ’ , এই ‘বিক্ষোভ’ যখন সমাজে অনেক মানুষের মনোজগতে সৃষ্টি হয় – তখন কোন উপযুক্ত নেতৃত্বের Under-এ অনেক মানুষের ‘বিক্ষোভ’ রূপ নেয় ‘বিদ্রোহে’। এই ‘বিদ্রোহ’ যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে এবং সমগ্র দেশব্যাপী তা বিস্তার বা ব্যাপকতা লাভ করে – তখন সেটা পরিণত হয় ‘বিপ্লবে’ ।” এই কথা গুলি অবশ্য গুরু মহারাজের কাছেই শোনা!!
যাইহোক, আবার ধনার কথায় আসি! ‘ধনা’-র মনের ক্ষোভ ন’কাকা সচরাচর মেটাতেও চাইতেন না – আর এটাতেই ধনা, ন’কাকার উপর বেশি বেশি করে ক্ষেপে যেতো এবং এইজন্যেই আরো ওনাকে এড়িয়ে চলতে চাইতো !
আমরা ন’কাকার কাছে এই ব্যাপারটার প্রসঙ্গ তুলে ওর এই ক্ষোভের কারণ জানতে চাইতাম – কিন্তু ন’কাকাও যেন ব্যাপারটাকে enjoy করতেন ! আমাদের কাছ থেকে ‘ধনা’-র প্রসঙ্গ শুনতে উনি খুব একটা ভালো বাসতেন না ৷ নন্দ মহারাজ প্রায়ই আমাকে বলতেন , ” কি যে ওদের বাপ-ছেলের ব্যাপার-স্যাপার , কিছুই বুঝতে পারিনি ” (নন্দ মহারাজ নদিয়ার করিমপুরের লোক , ওনাদের কথার টান এই রকম – ‘পারিনা’-টা ওনারা বলেন ‘পারিনি’ !)! আবার ধনা-কে যখন আমরা জিজ্ঞাসা করতাম – “কি ব্যাপার রে তোদের – ন’কাকার সাথে তোর এই রকম সম্পর্ক কেন রে ? ও উত্তর দিতো – “ন’কাকা সবাইকে দেখছে , সবার ভালো করছে , কিন্তু আমার বেলায় কোনো কাজই করছে না ! আমার উপর যে ভূতদুটো (প্রেতযোনি) অশান্তি সৃষ্টি করছে – ওদেরকে ন’কাকা একবার বললেই চলে যায় – কিন্তু ন’কাকা ওদেরকে কিছু বলছে না (আসলে ধনপতির একটা বদ্ধমূল ধারনা ছিল যে, ওর সমস্ত উন্নতি বা অগ্রগতি ব্যাহত করছে দুজন ভুত অর্থাৎ প্রেতযোনী) ! ন’কাকা আমার কষ্ট দেখে মজা পাচ্ছে !” দিনার কথা শুনে আমরাও ঠিক বুঝতে পারতাম না__এ ব্যাপারটা আবার কি!!
ন’কাকাকে এই কথাগুলো বললে উনি হেসে বলতেন – ” বাবা ! ওর মনের মধ্যে ভূত ঢুকে বসে আছে ! সেই মনের ভূত না ভাগলে – বাইরের ভূত থেকেই যাবে !”(ক্রমশঃ)