[ন’কাকার সাথে বীরভূমের হেতমপুরের জয়শংকর বাবার সাথে সুক্ষে যোগাযোগের কথা বলতে গিয়ে একটু উপক্রমনিকাটা বড় হয়ে গেল। তা হোক! ভারতীয় প্রাচীন পরম্পরা রক্ষাকারী একজন মহান মানুষের কথা একটু হোক না! জয়শংকর বাবার স্নেহধন্য চিন্ময় ডাক্তারের সাথে আমি এবং আদিত্যপুর আশ্রমের নন্দ মহারাজ, জয়শংকর বাবার কাছে গিয়ে যে এক অনির্বচনীয় প্রেমের স্পর্শ পেয়েছিলাম _সেই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল! ) সেদিন হেতমপুরের ঐ আশ্রমে সাধুবাবার অপার্থিব প্রেমের touch পেয়ে সাময়িকভাবে কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম! তারপর মনটা কেমন যেন অন্তর্মুখী হয়ে গেল! গভীর চিন্তার মধ্যে ঢুকে গেছিলাম সেদিন! অনেকক্ষণ পরে ভিতর থেকেই সিদ্ধান্ত এল— “ও – আচ্ছা ! এটাই ভারতবর্ষ ! এটাকেই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন – ‘ হে ভারত ভুলিও , না সর্বত্যাগী শংকরই তোমার আদর্শ !’ ও – তাহলে এনারাই সেই আদর্শের পরম্পরাগত অনুসারী ! এনারাই সেই ব্যক্তি, যাঁরা সারাজীবনের সাধনায় (চরমভাবে কষ্টার্জিত) আধ্যাত্মিক সম্পদ এই পৃথিবী থেকেই আহরণ করেছেন –আর এবার পৃথিবী থেকে চলে যাবার আগে সেগুলি অকাতরে মানুষকে বিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন ! এটাই তো ত্যাগ – এটাই আসল ত্যাগ – প্রকৃত ত্যাগ ! অন্য ত্যাগ আবার কি ত্যাগ!! সেগুলি যেন তুচ্ছাতিতুচ্ছ ত্যাগ! এইরূপ ত্যাগীরাই বলতে পারেন _’আমি বীর – আমি পেরেছি , সাধারণেরা দুর্বল – ওরা পারে না , তাই আমি ওদের জন্য জীবন-যৌবন ঈশ্বরের পাদপদ্মে উৎসর্গ করে,সাধনারূপ চরম কষ্টের পথ অতিক্রম করে পরম পুরুষার্থ আহরণ করেছিলাম –এখন যাবার আগে সকলকে বিলিয়ে দিয়ে চলে যাব ! উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন, জ্ঞানী-অজ্ঞানী বাছাবাছি করব না _যে আসবে সে-ই এই অমৃতফল লাভ করবে!!” সেদিন আমার আরও মনে হয়েছিল যে, তাহলে এই একই theory কি শিক্ষিতদের ক্ষেত্রে, ধনীদের ক্ষেত্রে, সমাজের উচ্চস্তরের যে কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই কার্যকরী??? উদাহরণ হিসেবে শিক্ষিতদের ক্ষেত্রে বলা যায় – ‘আমি বুদ্ধিমান কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছি – যারা সে আলোক থেকে বঞ্চিত – তাদের কাছে নিঃশর্তে আমার বিদ্যা, আমার শিক্ষা-র আলো পৌঁছে দেওয়াটাই আমার শিক্ষার প্রকৃত সার্থকতা!!’ ধনীর ক্ষেত্রেও কি এই একই নিয়ম – ‘আমি সুযোগ সুবিধা পেয়ে কষ্ট করে – শ্রম দিয়ে অনেক ধন আহরণ করেছি – যারা দুর্বল , গরীব অসহায় হয়ে রয়ে গেছে, তারা পারেনি _আমি তো পেরেছি_তাদের কাছে আমার এই উপার্জিত ধন প্রয়োজন মতো পৌঁছে দেওয়াটাই আমার ধন উপার্জনের সার্থকতা ! – এটাই কি মহাপুরুষগণের শিক্ষা ! এটাই ভারতীয় ঋষি পরম্পরা আর তাঁদের সাধনার ফসল!!! চেতনার গভীরের স্তর থেকে সেদিন আমার অন্তর্জগতে এই কথাগুলোই বারবার অনুরণিত হয়ে যাচ্ছিল! সেদিনের ওই Experience -এর কথা আমি ন’কাকাকে বলেছিলাম । ন’কাকা জয়শংকর বাবার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন , বললেন – ” ডাক্তার (চিন্ময়)-কে দেখে বুঝতে পারছো না – তার গুরু কেমন ! উপযুক্ত গুরু না হলে অমন চেলা হয় !” এই ঘটনার কিছুদিন পরই জয়শংকর বাবা শরীর ছেড়েছিলেন – ফলে ন’কাকার সাথে স্থূলে তাঁর আর দেখা হলো না ! এর বেশ কিছুদিন পরে আমরা ন’কাকার সাথে বোলপুর থেকে আসানসোল যাচ্ছিলাম গাড়ি চেপে ! আমরা বলতে সনৎ কাকু , নন্দ মহারাজ , কৌশিক (প্রফেসর কৌশিক দত্ত) , ন’কাকা এবং আমি। কৌশিকের বন্ধু দীপকের আসানসোলের বাড়ির গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে ! যাবার রাস্তায় হেতমপুর মোড় পড়লো – নন্দ মহারাজ আঙ্গুল উঁচিয়ে ন’কাকাকে দেখিয়ে দিলেন – ” ন’কাকা , ওই দিকটায় জয়শংকর বাবার আশ্রম !” ন’কাকা একবার হাত জোড় করে প্রণাম করে নিলেন – মুখে কিছুই বললেন না ! পরের দিন সকালে ন’কাকা আমাদের কে বললেন – ” একবার হেতমপুর আশ্রমে যেতেই হবে – কালরাত্রে জয়শংকর বাবা এসে দেখা করে গেল আর বলল – ‘ হেতমপুর আশ্রমের পাশ দিয়ে চলে এলে একবার দেখা করলে না ?’ ” আমরা সবাই সে কথা শুনে অবাক ! পরে ন’কাকা অবশ্য হেতমপুরে জয়শংকর বাবার আশ্রমে গিয়েছিলেন – যখন উনি চিন্ময় ডাক্তারের দিদি জামাইবাবুর বাড়ি দুবরাজপুরে , ওনাদের বাড়ির কালীপুজোর সময় গেছিলেন ৷(ক্রমশঃ)