[গুরুমহারাজের মহাপ্রয়াণের পর যে একটা শুন্যস্থান সৃষ্টি হয়েছিল, বহু ভক্তরা ন’কাকার মধ্যে তার অনেকটাই খুঁজে পেয়েছিল বা অন্ততঃ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছিল! আমরা আগের দিন শেষ করেছিলাম _গুরুমহারাজ থাকাকালীন আমাদের প্রায় সকলের মধ্যেই ধ্যানজপ করার একটা প্রচন্ড বেগ এসেছিল! কিন্তু উনি স্থুলশরীর ছেড়ে চলে যাবার পর সেই Flow টা একদম কমে গেছিল! আজকে এই প্রসঙ্গকেই আরো আগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক্!]
পরমানন্দ ভক্তদের মধ্যে _’এই জীবনেই অগ্রগতি সম্পূর্ণ করতে হবে’, এই যে Confidence , এই যে ধ্যানের প্রতি , সাধন-ভজনের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্মেছিল– এটা গুরু মহারাজের মহাপ্রয়াণের পর আমাদের বেশিরভাগ গুরু ভাই-বোনের জীবনে অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছিল! তবে আমাদের মধ্যে যারা অধিকতর শক্তিশালী তারা নিজেরাই নিজেদের অন্তঃর্জগতে ডুবে অন্তঃর্যামী পরমানন্দকে খোঁজার চেষ্টায় নিশ্চয়ই ব্রতী হয়েছিলেন । কিন্তু বেশিরভাগ ভক্তই একটা চরম হতাশাগ্রস্থ , শোকগ্রস্ত , বল-ভরসাহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল! সেই সব ভক্তদের মনে অনেকটাই আশার আলো দেখিয়েছিলেন ন’কাকা !
ন’কাকাকে পেয়ে সেই সব ভক্তরা পুনরায় অনেকটা বল-ভরসা পেয়েছিল, মনে মনে ভেবেছিল– ‘ যাক্ , তাহলে আমাদের সবটা হারিয়ে যায়নি – কেউ অন্ততঃ স্থূলে রয়েছেন, – যাঁকে বিশ্বাস করে সব কথা বলা যায় , যাঁর কাছ থেকে যে কোনো সমস্যায় সমাধান চাওয়া যায়, যাঁকে ‘সাহারা’ করে জীবনটা নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেওয়া যায় !’
“ন’কাকাকে বললেই সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে , ওনাকে ধরলেই সব বিপদ কেটে যাবে , উনি আশীর্বাদ করলেই আমার পরিবারের সকলের মঙ্গল হবে বা কল্যাণ হবে ” – এই ব্যাপারটা ন’কাকার ভক্তদের সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল !
যদিও একথা সত্য যে , ন’কাকাকে সব জানানোর পরেও কোন ভক্ত পরিবারে কি কোন অঘটন ঘটেনি, এমন কিন্তু নয় ! __হ্যাঁ ঘটেছে ! কিন্তু তারপরে যখনই ন’কাকা নিজেই ফোন করে বলেছেন – “তা আর কি করবে মা (বা বাবা) ! শোনো, কর্মফল তো খন্ডাবার নয় ! ওটা হবারই ছিল – তাই হয়েছে ! তবে তোমরা চিন্তা করো না , দেখবে আর কোনো অসুবিধা তোমাদের হবে না !” ভক্তকুল এই আশ্বাসটি পেয়েই – আবার আশায় বুক বাঁধতো , আবার দেহ-মনে জোর সঞ্চয় কোরতো ! আবার সংসারের কাজে বা সাধন-ভজনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত কোরতো !
তবে সাধারণ ভক্ত ছাড়াও, আশ্রমিক-ব্রহ্মচারী-সন্ন্যাসী বা কিছু অন্যান্য ভক্তদেরও তো দেখলাম , এদের সকলকে দেখে আমার মনে হয়েছিল হয়তো – যারা শক্তিশালী সাধক বা ঐ সাধু-সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারী , তাদের জন্য ন’কাকার স্থূল ভূমিকা অতটা ছিল না (কিন্তু নিশ্চিতভাবেই সূক্ষ্ম ভূমিকা ছিল) কারণ তাদের তো প্রয়োজন‌ই ছিল না, তারা তো গুরুমহারাজকে হৃদয়ে স্থাপন করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছেন‌ই_ তাই তাদের আবার আলাদা করে ন’কাকাকে কি প্রয়োজন ! তাই তাদের বেশিরভাগই গুরুমহারাজের মহাপ্রয়াণের পর ন’কাকাকে অতটা পাত্তাও দিতো না!
তবে, আমি অবশ্য বিশ্বাস করি(এটা আমার একান্ত মতামত) – তারাও যদি ন’কাকার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো , তাহলে তাদেরও আধ্যাত্মিক অগ্রগতি আর একটু ত্বরান্বিত হতো ! কিন্তু তারা ভেবে নিয়েছিল __ ‘বাবা মারা যাওয়ার পর যেমন ছেলেরাই বাড়ির Guardian হয়ে যায় , তেমনি তারাও তো এক-একটা Guardian হয়েই গেছে – আবার অন্য একজনকে মান্যতা দেবার প্রয়োজনটাই বা কি !
আমার মনে হয়, গুরু মহারাজের কাছে অনেক কিছু শোনা সত্বেও, ঐ ভাবনা থেকেই বেশির ভাগ সাধু-সন্ত-ব্রহ্মচারীরা ন’কাকার সান্নিধ্য এড়িয়ে চলতে ভালবেসেছিল !
কিন্তু গৃহী ভক্তরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল , অতটা মানসিকভাবে উন্নত নয় – তাই তারা গুরুমহারাজের অবর্তমানে ন’কাকাকে ভীষণভাবে গ্রহণ করেছিল ! আর ভগবানের অবতরণ তো হয় দুর্বলদের জন্য-ই !
অনাথ-আতুর-দুর্বল-পতিতদের জন্যে-ই তো পতিতপাবন-এর অবতরণ ! ইতিহাস সাক্ষী দেবে – যখন যখন-ই পৃথিবী গ্রহের কোনো না কোনো স্থানে ঈশ্বরের অবতরণ হয়েছে (বা তিনি দূত , রসুল , সাথীদের পাঠিয়েছেন) – তখন তখনই তাঁরা সাধারণ-অধমাধম মানুষের কাছে , তাদের মাঝেই ছুটে ছুটে এসেছেন ! শুধু এসেছেন বললে ভুল বলা হয় – যেন প্রেমে বিগলিত হয়ে একেবারে লাফিয়ে পড়েছেন ! সাধু-সন্তরা তো হিমালয়ে অথবা অন্য কোন দুর্গম স্থানে বা সমাজে __জগতরহস্য-জীবনরহস্য জানার চেষ্টায়, ঈশ্বরত্ত্ব লাভের জন্য বা আত্মতত্ত্ব বোঝার জন্য সচেষ্ট হয়েই গেছে – তাদের তো আর ঈশ্বরের অবতারকে প্রয়োজন নাই ! করুণাময় অবতারপুরুষকে প্রয়োজন আমাদের মতো সাধারন অতিসাধারণ মানুষদের !
তাই তাঁরাও অজ্ঞান অন্ধকারে থাকা , মোহাচ্ছন্ন , আত্মবিস্মৃত সাধারণ মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়ান , আচণ্ডালে কোল দেন – তাদের সকলকে কৃপা করে আলোর পথ দেখান , হাত ধরে বিপদসংকুল পথ পার করে দেন !
হে করুণাময় ভগবান পরমানন্দ ! হে দয়াময় ন’কাকা ! তোমরা আমাদের জন্য বারবার এসো – বারবার আমাদেরকে ভালোবেসে ধুলো-কাদা ঝেড়ে কোলে তুলে নিও ! তোমাদেরকে কি দিয়ে পুজো করতে হয় – তা আমরা জানিনা !! তোমাদেরকে কিভাবে শ্রদ্ধা করতে হয় – কিভাবে ভক্তি করতে হয় – তাও আমরা জানি না !! তোমরা নিজগুনে বারবার এসে আমাদেরকে কৃপা করো , আমাদেরকে ধন্য করো প্রভু !
আমরা ঐ ধ্যানের জগতে , জ্ঞানের জগতে অন্তর্লীন অবস্থা প্রাপ্ত হোতেও চাই না – শুধু তোমাদের ভালোবাসা চাই , তোমাদের অপার্থিব প্রেমপূর্ণ সান্নিধ্য চাই – তোমরা তো কাঙালের ঠাকুর ! আমাদের মতো যাদের আধ্যাত্মিক সম্পদ বা পারের কড়ি নাই – তাদের জন্য-ই তো তোমরা !
তোমরাই অগতির গতি ! অ-বলের বল ! অজ্ঞানের জ্ঞান , অন্ধকারের আলো , মৃত্যুপথযাত্রীর অমৃত ! – তাহলে আলাদা করে আর কি চাইবার আছে ? করুণা-পারাবার হে কল্পতরু ! তুমি তো সব কিছু দেবার জন্য আসো – তাই চেয়ে কেন ছোট হই ! অন্য কোন কিছু চাওয়ার নাই – আমরা শুধু তোমাদেরকে চাই – তোমরা যখন যখন আসবে – তখন তখন যেন আমরা তোমাদের আশে পাশে থাকি , তোমাদের সান্নিধ্য পাই , তোমাদেরকে স্পর্শ করতে পারি – তোমাদেরকে আপন ভাবতে পারি ! প্রাণের প্রাণ , বড় আদরের ধন ভাবতে পারি – এইটুকু প্রার্থনা মঞ্জুর করো প্রভু !
গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ এবং ন’কাকা শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে আমাদের মতো নিতান্ত সাধারণ সকল ভক্তের এটাই একান্ত প্রার্থনা।।(ক্রমশঃ)