[ ন’কাকার সাথে বিভিন্ন মহাপুরুষদের যোগাযোগের কথা বলা হচ্ছিল! আজকে গুরুমহারাজের সাথে ন’কাকার কিছু ঘটনা বা কথা আলোচনা করা যাক্]
(আগের দিনের আলোচনার পর…….)
কিন্তু গুরুমহারাজ-ন’কাকা যেন হরিহর ! দুজন বন্ধুর যদি খুব মিল দেখা যায় তাহলে বাংলা প্রবাদে বলা হয় “হরিহর আত্মা” ! অর্থাৎ তারা দুই-এ এক আবার একে-ই দুই ! গুরুমহারাজ এবং ন’কাকার ব্যাপারটাও ঠিক তেমনটাই ছিল! গুরুমহারাজ নিজের মুখেই এইকথার সাপোর্টে অনেকবার অনেক কথাই বলেছিলেন! একবার সন্ধ্যার সময় মুখার্জি বাড়িতে বসে সিগারেট খেতে খেতে বললেন – “ন’কাকা _এইবার কিছু কিছু দায়িত্ব নাও ! আমি একাই তো এতদিন সবকিছু চালাচ্ছি, এবার তুমি অন্ততঃ দীক্ষার দায়িত্বটা নাও ! তাহলে আমি অন্য দিকগুলোয় আরো বেশি করে মন দিতে পারি !”
ন’কাকা অত্যন্ত বিনয় সহকারে হাতজোড় করে বলেছিলেন – ” সে কি আর হয় ঠাকুর ! তুমি স্বয়ং যজ্ঞেশ্বর নারায়ন যেখানে রয়েছো – সেখানে কি অন্য কাউকে মানায় !” গুরু মহারাজ সেদিন খানিকটা আক্ষেপ নিয়ে বলে উঠেছিলেন – “ঠিক আছে ন’কাকা ! তোমার কাজগুলো আমাকে দিয়ে-ই করিয়ে নাও ! তবে মনে রেখো – একটাই ঢাক , বাজাতে বাজাতে কখন ফুটো হয়ে যাবে ! তখন বুঝবে !”
হ্যাঁ , সত্যি সত্যিই সেই ঢাক-টি ফুটো হয়ে গেল ! গুরু মহারাজ চলে গেলেন ১৯৯৯ সালের ২৭-শে নভেম্বর ! নতুন শতাব্দীর বা নতুন সহস্রাব্দের সূচনাটা হয়তো ইচ্ছা করেই উনি দেখলেন না !
তবে যে কথা হচ্ছিলো – গুরুমহারাজের সাথে ন’কাকার যে একটা অপার্থিব সম্পর্ক ছিল – তা বলাই বাহুল্য ! কারণ আমাদের নিজের চোখে দেখা যে সমস্ত ঘটনার কথা (হয়তো) আগেও কোথাও উল্লেখ হয়েছে , এখনও করা হচ্ছে – সেগুলিই এই কথার প্রমাণ ! যেমন ধরুন – গুরুমহারাজকে যেদিন গভীর রাত্রে চন্দ্রবোড়া সাপে গলার কাছে কামড়ে দিয়েছিল , সেই ঘটনাটা পরের দিন সন্ধ্যায় গুরুমহারাজ ন’কাকাদের বাড়িতে যখন বলেছিলেন , তখন বাড়ির মায়েরা এবং অন্যান্য উপস্থিত সবাই ”হায় – হায় !” করে উঠেছিল ! সবাই ব্যগ্র হয়ে “গুরু মহারাজ এখন কেমন আছেন” , “কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা” – এইসব জিজ্ঞাসায় ব্যস্ত – সেখানে গুরুমহারাজকে সাপে কামড়েছে শুনে ন’কাকা হো হো করে হাসতে হাসতে বলে উঠেছিলেন – “আগে আগে সাপের মাথায় তো অনেক নেচেছো – এবার সাপের কামড় খাও , আর তার বিষের জ্বালা-যন্ত্রণা ভোগ করো !” গুরুমহারাজ বলেছিলেন – “জানো ন’কাকা ! সত্যিই গতকাল রাতে আমাকে সাপের বিষের জ্বালা খুবই সইতে হয়েছিল! আমি জ্বালা-যন্ত্রনা সহ্য করলাম আর তুমি হাসছো !” সত্যি কথা বলতে কি __সেদিন আমরাও ন’কাকার ঐ ভূমিকায় একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! কিন্তু পরে বুঝেছিলাম ওনাদের লীলা ওনারাই ভালো জানেন – আমাদের সে ব্যাপারে মাথা ঘামানোই বৃথা !
ন’কাকার বিবাহ নিয়েও একবার গুরুমহারাজ আর ন’কাকার মধ্যে খুব মজাদার কথাবার্তা হয়েছিল ৷ গুরুমহারাজ ন’কাকাকে মজা করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন – ” আচ্ছা ন’কাকা ! তুমি মাথায় টোপর পড়ে , কপালে চন্দনের ফোঁটা লাগিয়ে , পালকি চেপে তোমাদের গ্রাম থেকে প্রায় ৭/৮ কিমি দূরবর্তী গ্রামে বিবাহ করতে গিয়েছিলে – এটা ভাবতেই তো আমার কেমন লাগছে !” গুরুমহারাজের কথা শেষ হোতে না হোতেই ন’কাকার prompt উত্তর, অর্থাৎ উত্তর যেন ready হয়েই ছিল!! হালকা হেসে ন’কাকা এর উত্তর দিয়েছিলেন – ” তা আর কি করা যাবে , তখন তো পালকি ছাড়া অন্য কিছু ছিল না , বর যেতো পালকিতে আর বরযাত্রীরা হয় হেঁটে অথবা গরুর গাড়িতে !” গুরুমহারাজ আবার রগড় করে বললেন – “তা ঠিক ! কিন্তু তাই বলে __’ ন’কাকা তুমি’ ! ‘তুমি’ _বরবেশে ওইভাবে যাচ্ছো _ এই দৃশ্যটা ভেবে বেশ মজা লাগছে !” ন’কাকা তখন একটু যেন জোরালো বা ঝাঁঝালো কন্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন – ” তাতে কি হয়েছে ! সে তো গদাই (ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ)-ও পালকি চড়ে গিয়েছিল ! আর কামারপুকুর থেকে জয়রামবাটির দূরত্বও কিছু কম ছিল না ! সে-ও তো টোপর মাথায় , মুখমন্ডলে চন্দনের ফোঁটা নিয়ে – বগল বাজাতে বাজাতে পালকিতে উঠেছিল ! তার বেলা ?”
কি আশ্চর্য !! জানেন_সেদিন ন’কাকা যেইমাত্র এই কথাগুলি বললেন আর সঙ্গে সঙ্গে গুরুমহারাজ চুপ! চুপ মানে __একেবারে চুপ হয়ে গেলেন ! সেই রাত্রির অন্ধকারে (যেহেতু সেই গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি) , চরম নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু গুরুমহারাজের জ্যোতির্ময় অবয়বটা হালকা আভা-র মতো বোঝা যাচ্ছিল এবং মাঝে মাঝে হাতের আঙ্গুলে ধরে থাকা জলন্ত সিগারেটটি ধীরে ধীরে উপরে উঠছিল বা নামছিল– এই টুকুই দেখা যাচ্ছিল! আর ওই অবস্থায় নিশ্চুপ – জ্যোতির্ময় আভাযুক্ত ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিল __উনি যেন শান্ত সমাহিত হয়ে গেছেন! সিগারেট সহ হাতের ওঠানামাটাও _ এক অদ্ভুত আর্ট ! সে এক আশ্চর্য অখন্ড নীরবতা ! আমরা সবাই জানতাম গুরুমহারাজ এখন এই অবস্থায় এখানে বসে রয়েছেন ঠিকই , কিন্তু ওনার চেতনা এখন কোথায় চলে গেছে – তার হদিস উনি স্বয়ং ছাড়া আর কেউই জানে না ! হয়তো কোন নক্ষত্রমন্ডলের পথে পথে ওনার চেতনা ঘুরে বেড়াচ্ছে – কোন অজানা রহস্যের সমাধান করার জন্য !(ক্রমশঃ)