[ন’কাকার সাথে যখন আমরা দীঘার কাছে তাজপুর আশ্রমে গিয়েছিলাম _সেই প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল ।]
তাজপুরে আমরা বেশ কয়েকদিন ছিলাম ৷ ওখান থেকে মেদিনীপুরে প্রনব সাহানা (প্রনব বাবু গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের ভক্ত, কিন্তু ন’কাকাকেও মহাপুরুষ হিসাবে বিশ্বাস ও মান্য করতো ! প্রকৃতপক্ষে ও বর্ধমানের লোক, কিন্তু কার্যোপলক্ষে এখানে বাড়িঘর ও ব্যবসা পত্র করে Settled হয়েছে ।)-র বাড়ি আসা হয়েছিল ৷ প্রনব বাবু-ও ন’কাকাকে বহুদিন ধরে অনুরোধ করে রেখেছিল – যাতে করে ন’কাকা অন্ততঃ একবার মেদিনীপুরে গিয়ে ওর বাড়িতে পায়ের ধুলো দেয় ! তার একটা কারণও ছিল ! মেদিনীপুর শহরে প্রণববাবু যে বাড়িটা তৈরি করেছিল – সেটাতেও কিছু বাস্তুদোষ ছিল – যার জন্য ওর ব্যবসাপত্রে নানান অশান্তি, ওর একমাত্র মেয়ের শরীর মোটেই ভালো যায় না – ইত্যাদি অনেক সমস্যা হচ্ছিলো ৷ তাহলে কি করা যায় – ন’কাকাকে একবার যো-সো করে বাড়িতে নিয়ে এসো ! আর ন’কাকাও করুণার অবতার ! ভক্ত ডাকলেই সেখানে হাজির !
ওখানে আমাদের সকলকে এক রাত্রি থাকতে হয়েছিল ৷ ন’কাকা ওদের ঠাকুরঘরে একটু পুজো করে দিয়েছিলেন ৷ পরবর্তীতে আমরা শুনেছিলাম – ধীরে ধীরে প্রণব বাবুর মেয়ে সুস্থ হয়ে যায় এবং প্রণববাবুর ন’কাকার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়। ফলে, ওর ভক্তির আতিশায্যে ন’কাকাকে আরো এক-দুবার মেদিনীপুরে যেতে হয়েছিল।
অবশ্য এই দুই জায়গা ছাড়াও অন্য সময়ে মেদিনীপুরের আরও দু-এক জায়গায় ন’কাকা গেছিলেন – তারমধ্যে গুরু মহারাজের ভক্ত শিবশঙ্কর পান্ডার নাম করা যায় ৷ ওনার বাড়িতেও গুরুমহারাজ গিয়েছিলেন ৷
ন’কাকা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মস্থান কামারপুকুরেও বেশ কয়েকবার গেছিলেন। ঠাকুরের সময়কার বিখ্যাত কোবরেজ শ্রীনাথ সেনের বংশধরেদের অনেকেই গুরু মহারাজের দীক্ষিত ! এদের মধ্যে মৃণাল কান্তি সেন, সুবীর সেনরা উল্লেখযোগ্য ! ওদের বাড়িতেও গুরুমহারাজ কয়েকবার গিয়েছিলেন । গুরু মহারাজের শরীর ছাড়ার পর ওরা ওদের বাড়ির কোনো প্রয়োজনে বা যে কোনো অনুষ্ঠানে মুরারি মহারাজ এবং ন’কাকাকে নিয়ে যেতো ! আমি দেখেছিলাম ন’কাকা এবং মুরারী মহারাজ মৃণালকান্তিকে বিশেষ স্নেহ করতেন ! আমি মৃণাল সম্বন্ধে ন’কাকাকে জিজ্ঞাসা করায় উনি বলেছিলেন , ” ছেলেটি সাধু প্রকৃতির ! আমার ওকে খুব ভালো লাগে ।”
এইসব নানা কথার অবতারণা করে আমি এটাই আপনাদের কাছে বোঝাতে চাইছি যে, পরমানন্দ ভক্তদের অনেকেই গুরু মহারাজকে হারিয়ে ন’কাকাকে অনেকটাই ভরসা করেছিল এবং ওনাকে অবলম্বন করে জীবনের দিনগুলো হাসি-কান্নায় কাটিয়ে দিয়ে চেয়েছিল । ‘ওনাকে অবলম্বন’– করা অর্থে সাধারণ মানুষেরা বিপদে-আপদে তো একটা অবলম্বন-কেই চায়, যে বলবে ” আচ্ছা-আচ্ছা ! আমি দেখছি – আমি মা করুণাময়ীর কাছে ‘ওর’- নামে একটা পুজো দিয়ে দেব – দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে ।” এইটাই ছিলো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল !
এটা ঠিকই যে, মানুষ নিজে নিজেই বিপদের মোকাবিলা করে থাকে , হয়তো কোনো বাড়ির কারো কোনো রোগ-ব্যাধি হয়েছে – তারাই উপযুক্ত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় – চিকিৎসা করাতে ! কিন্তু গুরুমহারাজ, ন’কাকা বা যে কোন মহাপুরুষের সান্নিধ্যে থাকলে সেই ভক্তেরা এই বিশ্বাস করতো যে, ন’কাকা(বা যে কোন মহাপুরুষ) যখন বলেছে – তখন Patient টি ভালো হয়ে যাবে ! এই ভরসার কথাই বলা হচ্ছিলো !
ন’কাকা যখন শ্রীরামপুরে যেতেন তখন শ্রীরামপুর থেকে আরো অনেক জায়গায় যাওয়া হতো ! শ্রীরামপুরের মধ্যেই ‘সিমলা’ বলে একটা স্থান রয়েছে – সেখানে মানিক মুখার্জীর (শ্রীরামপুরের সুদর্শন মাস্টার মশাইয়ের কথা আগে অনেক বলা হয়েছে, তাকে কেন্দ্র করে যে ভক্ত মন্ডলী গড়ে উঠেছিল _মানিকবাবু সেই দলের লোক) বাড়ি ন’কাকা আমাদেরকে নিয়ে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলেন ৷ মানিক বাবুর দুটি মেয়ে –তাই ওনার চিন্তা ছিল যেন মেয়েদের ভালো জায়গায় বিয়ে হয় ৷ ন’কাকাকে মানিকবাবু খুবই ভক্তি করতেন, তার বিশ্বাস ছিল ন’কাকার আশীর্বাদে তার মনোবাঞ্ছা পূর্ন হবে! ন’কাকা আশীর্বাদ করেছিলেন – এমনকি মানিকবাবুর বড় মেয়ের বিয়েতে উনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন । বিয়েবাড়িতে সামান্য কারণে কিছু গোলযোগ লেগে গিয়েছিল – কিন্তু তা মিটে গিয়ে বিবাহকার্য ভালোভাবেই সমাধা হয়েছিল ।
মানিকবাবু ওই অশান্তির ঘটনায় খুবই উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, বারবার বিয়ের আসর থেকে ন’কাকার কাছে ছুটে ছুটে আসছিলেন – যাতে বিয়েবাড়িতে লাগা অশান্তি ভালোয় ভালোয় মিটে যায় । কিছুক্ষণের মধ্যেই গোলমাল থেমেও গিয়েছিল এবং বিবাহ-ও ভালোভাবে মিটে গিয়েছিল ৷ পরে পরে আমরা খবর পেতাম যে মেয়েটি খুবই সুখী হয়েছে !
ওই ঘটনাটার কথা তুলে ন’কাকাকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম – “বিয়েবাড়িতে গণ্ডগোলটা হলো-ই বা কেন ?” ন’কাকা বলেছিলেন – ” ঈশ্বরের ইচ্ছায় হয়েছে !ওইটা না হোলে হয়তো কোন বড়সড় অঘটন হোত – সেইটা অল্পের মধ্যে দিয়ে কেটে গেল !” [ক্রমশঃ]