[ শেষের দিকটায় ন’কাকার শরীর খারাপ নিয়ে কথা হচ্ছিল। কিন্তু আমাদের মতো ভক্তদের ভালবাসার অত্যাচার ন’কাকাকে স্থুলশরীর ছেড়ে চলে যেতে বোধয় বাধ্য করেছিল।]
যাইহোক, যে কথা বলছিলাম শেষের দিকটায় উনি তবুও অপেক্ষাকৃত একটু সাবধানতা অবলম্বন করার চেষ্টা করতেন । কীর্ণাহারের ত্রিলোচন রায় বা তিলক বেশ কিছুদিন ন’কাকার খাওয়া-দাওয়ার টাইম, ঔষধ খাওয়ানোর টাইম এগুলো maintain করার চেষ্টা করেছিল, ওনার বিশ্রামের সময় যাতে কেউ ন’কাকাকে ডিস্টার্ব না করে তার দেখভাল – এগুলিও করতে শুরু করেছিল, কিন্তু সে-ও এটাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেনি ! বোলপুরের মধুমিতাও ন’কাকার সেবা-যত্নের ব্যাপারে খুবই যত্নশীল ছিল এবং অনেকের ভালোবাসার অত্যাচারের হাত থেকে ওনাকে রক্ষা করার চেষ্টা করতো । আর এই কর্ম করতে গিয়ে ওরা দুজনেই বাকি ভক্তদের কাছে যথেষ্ট অপ্রিয় হতো, অনেকেই ওদের মুখের উপর দু’চারটে কথাও বলে দিতো ৷
এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে__গুরুমহারাজকে নিয়েও তখন এই সমস্যা আমাদের মধ্যে অনেককেই ভোগ করতে হয়েছে ৷ গুরু মহারাজ যখন আশ্রমের বাইরে কোথাও থাকতেন, তখন ওনার বিশ্রামের সময় দেখা করতে যাওয়া বা সিটিং চলাকালীন প্রণাম করার ব্যাপারে একটু-আধটু নিষেধাজ্ঞা চাপানো হতো _ ব্যস্! তমোভক্তির জোর তখন দ্যাখে কে ? “তুমি কে হে বাপু – আমাকে আটকাবার ! জানো_ আমি কে ? তোমার ধারণা আছে_ উনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন ?” এই ধরনের কড়া কড়া কথা শুনতে হোত আমাদের! আমরা যারা, গুরু মহারাজের জন্য এই কাজটি করতাম, তখন তারা যে কতটা অসহায় বোধ করতাম _তা ভাবা যাবে না ! এরপর তারা (অত্যাচারী ভক্তরা) আবার জ্ঞানদানও কোরতো, যখন আমরা তাদেরকে কাতরভাবে মিনতি করে বলতাম – ” দেখুন, আসলে উনি এখন একটু বিশ্রাম করছেন তো, তাই বলছিলাম ! “ব্যস্ ! অমনি ছুটতে শুরু করতো জ্ঞানদানের ফোয়ারা – ” আরে – উনি হলেন স্বয়ং ভগবান ! ভগবানের আবার বিশ্রাম কি ! ভগবান যদি বিশ্রাম নেয়, ঘুমিয়ে পড়ে – তাহলে তো জীবজগতের সবাই ঘুমিয়ে যাবে ! সরুন – সরুন ! আমাদেরকে ওনার সাথে দেখা করতে দিন তো !” তখন আমরাও সেইসব তমোভক্তদের জোর করে আটকাতে যেতাম এবং বিরাগভাজন হোতাম !
সুতরাং ন’কাকার ক্ষেত্রেও ত্রিলোচন-মধুমিতা ছাড়াও যারাই একটু আঁটোয়ারী করতে গেছে – তারাই অন্যান্য ভক্তদের চোখে ‘ছোট’ হয়ে যেতো – অনেক সময়-ই তাদের কপালে কিছু গঞ্জনাও সহ্য করতে হতো ৷
এই প্রসঙ্গে একটু ত্রিলোচনের কথা বলা যাক । আমরা যখন প্রথম প্রথম ন’কাকাকে নিয়ে বোলপুর আশ্রমে (আদিত্যপুর) যেতাম, তখন প্রায় প্রতিবারেই আমাদেরকে অন্তত একবার কীর্ণাহার যেতেই হতো ! কারণ আগেই বলা হয়েছিল যে, কীর্ণাহারের সনৎ কাকু ন’কাকার অন্যতম প্রিয় ভক্ত ছিল ! উনি ন’কাকাকে বাবার মতো বা বলা চলে গুরুর মতো (যদিও ওনার দীক্ষাগুরু হলেন বনগ্রাম আশ্রমের সেক্রেটারী মুরারি মহারাজ)-ই ভক্তি করতেন ! তাছাড়া ওনার দাদা সুশীল বাবু (রিটায়ার্ড হাইস্কুল টিচার এবং বিশিষ্ট ভদ্রলোক)-র পরিবার গুরুমহারাজের দীক্ষিত অর্থাৎ পুরোনো ভক্ত ! এছাড়াও কীর্ণাহারের মনোজিৎ ডাক্তার এবং অসিত দা – প্রমুখরাও পুরোনো ভক্ত ! এনাদেরও একটা আমন্ত্রণ থাকতো – তাই ন’কাকাকে কীর্ণাহারে একদিনের জন্য হলেও যেতেই হতো ! ত্রিলোচনের বাড়ি ছিল ডক্টর মনোজিতের বাড়ির কাছাকাছি ! মনোজিৎ ডাক্তারের (হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার) কীর্ণাহারে যথেষ্ট সুনাম ও পরিচিতি ছিল, তাছাড়া ওনারা কয়েকজন মিলে শনিবার বা রবিবারে একটা ‘পাঠচক্রের’ আয়োজন করতেন । যেখানে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ বা যে কোন মহাপুরুষ সম্বন্ধে আলোচনা এবং তাদের রচনাবলী বা যে কোন ধর্মগ্রন্থ পাঠ ইত্যাদি হোত । সেই আসরে কীর্ণাহারের কিছু ইয়ং ছেলেরাও যাওয়া-আসা করতো এবং মনোজিৎ ডাক্তারের বাড়ি গিয়েও তারা ধর্মালোচনা করতে যেতো ! সেই দলে ছিল আশুতোষ (আশু) দত্ত, রাজর্ষি, ত্রিলোচন (তিলক) রায় প্রমুখরা ! এর ফলে ন’কাকা যখন থেকে বীরভূমের কীর্ণাহারে যাওয়া শুরু করলেন, তখন এই ছেলেগুলির সাথেও ওনার যোগাযোগ হয়েছিল।
এরপর ওই কমবয়েসী ছেলের দল কর্মজীবনে প্রবেশের নিমিত্ত সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো, ফলে পরবর্তীতে সবাই যে ন’কাকার সাথে খুব যোগাযোগ রাখতো – তা হয়তো নয়, কিন্তু আশু এবং তিলক যোগাযোগ রেখে চলছিল !
তিলকের বাড়ি ছিল মনোজিৎ ডাক্তারের বাড়ির ঠিক পাশেই, তাই ওর সাথে বা ওর পুরো পরিবারের সাথে ন’কাকার যোগাযোগ বজায় থাকতো – যেহেতু ন’কাকা কীর্ণাহার গেলেই মনোজিৎ ডাক্তারের বাড়ি যেতেন । এরপরে তিলক ন’কাকার কাছে দীক্ষাগ্রহণ করে এবং বাড়ির ছেলের মত বনগ্রামে থেকে গিয়ে ন’কাকা ও ন’কাকিমার সেবা করতে থাকে ! তিলক তখন প্রায়ই ন’কাকার বাড়িতে অর্থাৎ বনগ্রামে গিয়ে পাঁচ দিন, দশ দিন, পনেরো দিন বা হয়তো আরো বেশি সময় ধরে থেকে যেতো ! ও বাড়ির ছেলের মতো হয়ে যাওয়ায় – (নিজে একজন ভালো শিল্পীও ছিল) বাড়ির ভিতরের বা বাইরের যাবতীয় কাজকর্ম ও একাই করে দিতো ! তখন ন’কাকার গোয়ালে গরু ছিল, এই গো-সেবার কাজে ন’কাকা এবং ন’কাকীমাকে অনেক সময় ব্যয় করতে হতো _তিলক বনগ্রামে থাকলে ওই কাজগুলিও সে-ই করে দিতো, ফলে ন’কাকা ও কাকীমার খুবই সুবিধা হোত৷ [ক্রমশঃ]