[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের শরীর ছাড়ার পর মা সারদামনি যেমন সকলকেই ধরে রেখেছিলেন __তেমনি ন’কাকা আরও আঠারো বছর শরীরে থেকে, আমাদের মতো বহু পরমানন্দ ভক্তকে এক জায়গায় করে রেখেছিলেন। আগের দিন ন’কাকার শিক্ষাদানের কথা বলা হয়েছিল। এখন তারপর থেকে…. । ]
এইভাবেই ন’কাকা আমাদেরকে জীবনমুখী শিক্ষা দিতেন–যে শিক্ষা ছিল প্রকৃত শিক্ষা, যে শিক্ষা ছিল শ্রদ্ধা-ভক্তি-বিনয়-ভক্তি লাভের শিক্ষা ! গুরু মহারাজের স্থূল শরীর ত্যাগের পর আমরা হাজার হাজার গুরুভাইরা আবার মহামায়ার অধীনে পড়ে গিয়েছিলাম (কারণ গুরুমহারাজ ছিলেন মায়াধীশ, তাই তিনি যতদিন শরীরে ছিলেন – ততদিন মহামায়া ঠিকমতো আমাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারতো না) । প্রচন্ড টানে অনেক জিনিসকে আটকে রাখার পর সেই টানটা হঠাৎ করে ছিন্ন হয়ে গেলে, যেমন কে কোথায় ছিটকে যায় – আমাদেরও সেইরকম কক্ষচ্যুত অবস্থা হয়েছিল (এখনও অনেকটাই সেরকমই আছে। এখনও বেশিরভাগ গুরুভাই-বোনেদেরই পরস্পরের সাথে পরস্পরের কোন যোগাযোগই নাই । অথচ গুরুমহারাজ থাকাকালীন, গুরুভাই-বোনেরাই আমাদের কাছে একান্ত আপন _যেন আত্মার আত্মীয় ছিল! নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে তখন আমাদের প্রায় কোন সম্পর্কই ছিল না! গুরুমহারাজ স্থূল শরীর ছেড়ে চলে যাবার পর – আবার আমরা পূর্বের জায়গায় ফিরে গিয়েছি । আবার আমরা মা মহামায়ার অধীনে থেকে ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান, হিসাব-নিকাশ, সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দের জগতে ফিরে এসেছি ৷) ৷
এইরকম অবস্থায় ন’কাকা ছিলেন আমাদের কাছে মালাকারের ন্যায় ! মালাকার যেমন বিভিন্ন ফুল চয়ন করে নিয়ে এসে তাদেরকে এক জায়গায় গ্রথিত করে সুন্দর একটি মালার রূপ প্রদান করে – গুরু মহারাজের পর ন’কাকাও ঠিক সেই কাজটিই করে যাচ্ছিলেন । বিশেষতঃ বোলপুরের নিকটস্থ আদিত্যপুর আশ্রমকে ঘিরে ন’কাকার এই মালা গাঁথার রূপটি যথেষ্টই প্রকট ছিল। সেই সময় আমি আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব (যারা ন’কাকাকে চিনতেন) – তাদের সকলকেই বলতাম – “একবারের জন্য হলেও ন’কাকা বোলপুর আশ্রমে থাকাকালীন – তোমরা সেখানে যাবে। সেখানে গেলে বুঝতে পারবে যে, তোমাদের এতদিনের দেখা ন’কাকা, আর বোলপুর আশ্রমের ন’কাকার মধ্যে কত তফাৎ ! কেমন করে যেন বীরভূমের মানুষ(ন’কাকার ভক্তরা) _ধীরে ধীরে ন’কাকার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল, ঝাঁপিয়ে পড়ছিল তার চরণ তলে আশ্রয় নেবার জন্য !”
অনেকেই আমার কাছে এইসব কথা শুনে ‘বীরভূমে ন’কাকা’-কে দেখতে গিয়েছিল – আবার অনেকেই যায় নি ! যারা যায়নি তারা – সেইজন্য এই লেখাগুলি পড়ে ঠিকমতো মেলাতে পারে না ! তারা ভাবে – ” এই সংকলক কি লিখছে ! আমরা তো দেখেছি ন’কাকা (শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়)-কে মাঠে মাঠে ছাতা-বগলে ঘুরতে, আমরা দেখেছি ন’কাকাকে আশ্রমের বাগানে ফুল তুলতে, আমরা দেখেছি ন’কাকাকে পূজা-অাচ্চা করতে – তাহলে হঠাৎ করে ন’কাকা কি করে মহাপুরুষ হয়ে উঠল !”– কিন্তু তাদের এই ভাবনাটা ভুল!! ‘হঠাৎ করে’ অন্য যা-ই কিছু হওয়া যায় – হঠাৎ করে মহাপুরুষ হওয়া যায় না ! মহাপুরুষগণ ‘হয়েই’ – আসেন ! তাঁদের নতুন করে কিছু ‘হোতে’ – হয় না !!
তাহলে এখানে একটা জিজ্ঞাসা থেকেই যাচ্ছে _তাঁরা যদি ‘হয়েই’ আসেন তবু তাঁদের জীবনে ‘সাধন ভজন’ করা কেন ? তার উত্তর গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ দিয়েছিলেন । উনি বলেছিলেন – “মহাপুরুষদের সাধন-ভজন, যেন একবার ঝালিয়ে নেওয়া, সাধন পদ্ধতিগুলিকে মান্যতা দেওয়া, সেগুলিকে আবার নতুন করে Recharge করে দেওয়া ! আর তাছাড়াও পৃথিবীর মানুষ বা যে স্থানে ওনারা শরীর নেন_সেই সমাজের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভের জন্য-ও তাঁদের এইগুলি করতে হয় ৷ গুরুমহারাজ একটি গল্পের অবতারণা করে এই ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছিলেন।
গল্পটা হোল– একজন সবল-সুস্থ নাবিক জাহাজডুবি হয়ে ভাসতে ভাসতে এক কুষ্ঠরোগীদের দ্বীপে গিয়ে উঠেছিল ৷ সেখানে পৌঁছে সে দেখল দ্বীপের সমস্ত মানুষেরই হাতে-পায়ে ন্যাকড়া জড়ানো – অর্থাৎ ঐ দ্বীপের সবার শরীরে কুষ্ঠ ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। ওই বিপন্ন নাবিকটি একটু পানীয় এবং একটু আহার্যের জন্য সবার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলো। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল – সেই ব্যক্তিরা ওর কাছে আসছে বটে, কিন্তু যেই-না দেখছে নাবিকটির হাতে-পায়ে কুষ্ঠের ঘা নাই, ন্যাকড়া বাঁধা নাই_ অমনি তারা মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে !
কিছুক্ষনের মধ্যেই নাবিকটি ওই দ্বীপের মানুষের মনোজগতের রহস্য বুঝতে পেরে একটি ঝোপের আড়ালে গিয়ে নিজের গায়ের জামা-কাপড়ের খানিকটা অংশ ছিঁড়ে হাতে পায়ে বেঁধে নিল। এবার সে ঝোপের বাইরে বেরিয়ে এসে যাকে প্রথম দেখতে পেলো _তাকে তার প্রয়োজনের কথা জানাতেই ঐ ব্যক্তি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল ৷ তার দেখাদেখি আরও অনেকে সেখানে এসে জড়ো হোল। শুরু হোল গল্প-গুজব, কথাবার্তা। স্থানীয়রা নাবিকের সব কথা শুনে তাকে ঐ দ্বীপে বসবাসের অনুমতিও দিয়ে দিল। ভালোভাবে সবার সাথে পরিচয় হবার পর, সেই নাবিক ধীরে ধীরে ওখানকার কিছু শক্ত-সমর্থ-বলিষ্ঠ যুবকদেরকে নিয়ে একটি দল গঠন করে ফেলল। তারপর তারা সকলে মিলে ওই দ্বীপের সবার কুষ্ঠ হবার কারন কি – তার অনুসন্ধানে নেমে গেল এবং ধীরে ধীরে তার প্রতিকারও করতে শুরু করল !
[গল্পের ব্যাখ্যা বলা হবে পরের দিন।] (ক্রমশঃ)
এইভাবেই ন’কাকা আমাদেরকে জীবনমুখী শিক্ষা দিতেন–যে শিক্ষা ছিল প্রকৃত শিক্ষা, যে শিক্ষা ছিল শ্রদ্ধা-ভক্তি-বিনয়-ভক্তি লাভের শিক্ষা ! গুরু মহারাজের স্থূল শরীর ত্যাগের পর আমরা হাজার হাজার গুরুভাইরা আবার মহামায়ার অধীনে পড়ে গিয়েছিলাম (কারণ গুরুমহারাজ ছিলেন মায়াধীশ, তাই তিনি যতদিন শরীরে ছিলেন – ততদিন মহামায়া ঠিকমতো আমাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারতো না) । প্রচন্ড টানে অনেক জিনিসকে আটকে রাখার পর সেই টানটা হঠাৎ করে ছিন্ন হয়ে গেলে, যেমন কে কোথায় ছিটকে যায় – আমাদেরও সেইরকম কক্ষচ্যুত অবস্থা হয়েছিল (এখনও অনেকটাই সেরকমই আছে। এখনও বেশিরভাগ গুরুভাই-বোনেদেরই পরস্পরের সাথে পরস্পরের কোন যোগাযোগই নাই । অথচ গুরুমহারাজ থাকাকালীন, গুরুভাই-বোনেরাই আমাদের কাছে একান্ত আপন _যেন আত্মার আত্মীয় ছিল! নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে তখন আমাদের প্রায় কোন সম্পর্কই ছিল না! গুরুমহারাজ স্থূল শরীর ছেড়ে চলে যাবার পর – আবার আমরা পূর্বের জায়গায় ফিরে গিয়েছি । আবার আমরা মা মহামায়ার অধীনে থেকে ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান, হিসাব-নিকাশ, সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দের জগতে ফিরে এসেছি ৷) ৷
এইরকম অবস্থায় ন’কাকা ছিলেন আমাদের কাছে মালাকারের ন্যায় ! মালাকার যেমন বিভিন্ন ফুল চয়ন করে নিয়ে এসে তাদেরকে এক জায়গায় গ্রথিত করে সুন্দর একটি মালার রূপ প্রদান করে – গুরু মহারাজের পর ন’কাকাও ঠিক সেই কাজটিই করে যাচ্ছিলেন । বিশেষতঃ বোলপুরের নিকটস্থ আদিত্যপুর আশ্রমকে ঘিরে ন’কাকার এই মালা গাঁথার রূপটি যথেষ্টই প্রকট ছিল। সেই সময় আমি আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব (যারা ন’কাকাকে চিনতেন) – তাদের সকলকেই বলতাম – “একবারের জন্য হলেও ন’কাকা বোলপুর আশ্রমে থাকাকালীন – তোমরা সেখানে যাবে। সেখানে গেলে বুঝতে পারবে যে, তোমাদের এতদিনের দেখা ন’কাকা, আর বোলপুর আশ্রমের ন’কাকার মধ্যে কত তফাৎ ! কেমন করে যেন বীরভূমের মানুষ(ন’কাকার ভক্তরা) _ধীরে ধীরে ন’কাকার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল, ঝাঁপিয়ে পড়ছিল তার চরণ তলে আশ্রয় নেবার জন্য !”
অনেকেই আমার কাছে এইসব কথা শুনে ‘বীরভূমে ন’কাকা’-কে দেখতে গিয়েছিল – আবার অনেকেই যায় নি ! যারা যায়নি তারা – সেইজন্য এই লেখাগুলি পড়ে ঠিকমতো মেলাতে পারে না ! তারা ভাবে – ” এই সংকলক কি লিখছে ! আমরা তো দেখেছি ন’কাকা (শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়)-কে মাঠে মাঠে ছাতা-বগলে ঘুরতে, আমরা দেখেছি ন’কাকাকে আশ্রমের বাগানে ফুল তুলতে, আমরা দেখেছি ন’কাকাকে পূজা-অাচ্চা করতে – তাহলে হঠাৎ করে ন’কাকা কি করে মহাপুরুষ হয়ে উঠল !”– কিন্তু তাদের এই ভাবনাটা ভুল!! ‘হঠাৎ করে’ অন্য যা-ই কিছু হওয়া যায় – হঠাৎ করে মহাপুরুষ হওয়া যায় না ! মহাপুরুষগণ ‘হয়েই’ – আসেন ! তাঁদের নতুন করে কিছু ‘হোতে’ – হয় না !!
তাহলে এখানে একটা জিজ্ঞাসা থেকেই যাচ্ছে _তাঁরা যদি ‘হয়েই’ আসেন তবু তাঁদের জীবনে ‘সাধন ভজন’ করা কেন ? তার উত্তর গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ দিয়েছিলেন । উনি বলেছিলেন – “মহাপুরুষদের সাধন-ভজন, যেন একবার ঝালিয়ে নেওয়া, সাধন পদ্ধতিগুলিকে মান্যতা দেওয়া, সেগুলিকে আবার নতুন করে Recharge করে দেওয়া ! আর তাছাড়াও পৃথিবীর মানুষ বা যে স্থানে ওনারা শরীর নেন_সেই সমাজের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভের জন্য-ও তাঁদের এইগুলি করতে হয় ৷ গুরুমহারাজ একটি গল্পের অবতারণা করে এই ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছিলেন।
গল্পটা হোল– একজন সবল-সুস্থ নাবিক জাহাজডুবি হয়ে ভাসতে ভাসতে এক কুষ্ঠরোগীদের দ্বীপে গিয়ে উঠেছিল ৷ সেখানে পৌঁছে সে দেখল দ্বীপের সমস্ত মানুষেরই হাতে-পায়ে ন্যাকড়া জড়ানো – অর্থাৎ ঐ দ্বীপের সবার শরীরে কুষ্ঠ ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। ওই বিপন্ন নাবিকটি একটু পানীয় এবং একটু আহার্যের জন্য সবার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলো। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল – সেই ব্যক্তিরা ওর কাছে আসছে বটে, কিন্তু যেই-না দেখছে নাবিকটির হাতে-পায়ে কুষ্ঠের ঘা নাই, ন্যাকড়া বাঁধা নাই_ অমনি তারা মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে !
কিছুক্ষনের মধ্যেই নাবিকটি ওই দ্বীপের মানুষের মনোজগতের রহস্য বুঝতে পেরে একটি ঝোপের আড়ালে গিয়ে নিজের গায়ের জামা-কাপড়ের খানিকটা অংশ ছিঁড়ে হাতে পায়ে বেঁধে নিল। এবার সে ঝোপের বাইরে বেরিয়ে এসে যাকে প্রথম দেখতে পেলো _তাকে তার প্রয়োজনের কথা জানাতেই ঐ ব্যক্তি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল ৷ তার দেখাদেখি আরও অনেকে সেখানে এসে জড়ো হোল। শুরু হোল গল্প-গুজব, কথাবার্তা। স্থানীয়রা নাবিকের সব কথা শুনে তাকে ঐ দ্বীপে বসবাসের অনুমতিও দিয়ে দিল। ভালোভাবে সবার সাথে পরিচয় হবার পর, সেই নাবিক ধীরে ধীরে ওখানকার কিছু শক্ত-সমর্থ-বলিষ্ঠ যুবকদেরকে নিয়ে একটি দল গঠন করে ফেলল। তারপর তারা সকলে মিলে ওই দ্বীপের সবার কুষ্ঠ হবার কারন কি – তার অনুসন্ধানে নেমে গেল এবং ধীরে ধীরে তার প্রতিকারও করতে শুরু করল !
[গল্পের ব্যাখ্যা বলা হবে পরের দিন।] (ক্রমশঃ)