[ হাওড়ার দেবকুমারের কথা হচ্ছিল | রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হওয়া সত্ত্বেও সে কেন ন’কাকার কাছে দীক্ষাগ্রহন করেছিল সেইসব কথা আগের দিন আলোচনা হয়েছে। আজ তারপর থেকে……..] যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে.সেই সময় দেবকুমারের ছেলে দেবমাল্য হয় ক্লাশ টেনে পড়ত অথবা সবে স্কুল ফাইনাল পাস করে ইলেভেনে ভর্তি হয়েছিল ৷ ছেলেটি লম্বায়-চওড়ায় দেখতে অনেকটা বড় লাগলেও – ওর মনটা ছিল একদম শিশুর মতো ৷ মনের দিক থেকে বেচারা একটুও বড় হয়নি, তখনও বাচ্চাদের কমিকস্ পড়তো – বাচ্চাদের চ্যানেলের প্রোগ্রাম দেখতো, আর বাচ্ছা ছেলে পেলেই তার সাথে খেলা জুড়ে দিতো! এই কথাগুলি এখানে উল্লেখ করলাম এই জন্য যে, দেবকুমার সালকিয়ার মানুষ হওয়ার সুবাদে সে ছোটবেলা থেকেই বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে দারুণভাবে যুক্ত ছিল । একটা জায়গায় জীবনের প্রায় ত্রিশ-টা বছর প্রতি সপ্তাহে একদিন বা দুদিন করে যাওয়ার সুবাদে এবং ঐ মিশনের ভেতরে ঢোকার ফলে যে কোনো মানুষ – সেখানকার অনেক কিছুই নিজের চোখে দেখতে পায়, অনেক কিছুই অনুভব বা উপলব্ধি করতে পারে । যেটা বাইরে থেকে একবার-দুবার গিয়ে সেসবের বিন্দু-বিসর্গও বোঝা যায় না । বিশেষতঃ ঐ মিশনে দেবুর একজন সিনিয়র দাদা – ইন্দ্রনাথ দা (যিনি স্বামী ভূতেশানন্দের শিষ্য, এবং ঠাকুর-মা-স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন । গৃহে রয়েছেন কিন্তু বিয়ে-থা করেন নি, সাধন-ভজন করেই জীবন কাটাচ্ছেন ! উনি একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী !)-ও দেবুকে ন’কাকার কাছে দীক্ষা নেওয়ার জন্য বারবার চাপ দিচ্ছিলেন ! ইন্দ্রদা-র ব্যাপারটা আগে সামান্য বলা হয়েছে, তবু আর একবার একটু-আধটু বলি ! যৌবনের প্রথমভাগেই ইন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন ৷ তখন রামকৃষ্ণ মিশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন স্বামী ভূতেশানন্দ মহারাজ ৷ ইন্দ্রদা ওনার কাছেই দীক্ষা নিয়েছিলেন । সুঠাম দেহী, ত্যাগব্রতে উদ্বুদ্ধ তরুণ ইন্দ্র-কে স্বামী ভূতেশানন্দজী খুবই ভালবাসতেন, এমনকি তাকে তাঁর একটু-আধটু সেবা করার অধিকারও দিয়েছিলেন ৷ একদিন ইন্দ্রনাথের মন-মেজাজ খারাপ দেখে – স্বামী ভূতেশানন্দজী ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন – ” কিরে ! আজ তোর মনটা এত খারাপ কেন ? আজ ধ্যান-জপ ভালো হয়নি নাকি রে ! তুই যে আজ মুখ নিচু করে বসে আছিস ?” ইন্দ্রদা ভূতেশানন্দজী মহারাজকে বলেছিলেন – ” ধ্যান-জপ করেই বা কি হবে, আর এই মঠে এসেই বা কি হবে ? কোনদিন কি স্বয়ং ঠাকুর (শ্রী রামকৃষ্ণ)-কে খালি চোখে প্রত্যক্ষ করতে পারবো ? তাঁর কাছটিতে দু-দণ্ড বসতে পারবো বা তাঁর শ্রীমুখের কিছু কথা শুনতে পাবো ?” ইন্দ্রদাকে অবাক করে দিয়ে স্বামী ভূতেশানন্দজী বলে ওঠেন – ” তুই স্থূলচোখে ঠাকুরকে দেখতে চাস ? তাহলে যা_ বর্ধমান জেলার মেমারির কাছে বনগ্রামে যা ! সেখানে দেখতে পাবি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নব কলেবরে লীলা করছেন – তাঁকে দেখে আয় ! আর ফিরে এসে আমাকে বলবি – ওখানে কি দেখে এলি !” ইন্দ্রদা এসেছিলেন বনগ্রামে । তখন আশ্রমের প্রথম দিক, তবুও ইন্দ্রদা গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ মহারাজের সাথে দেখা করেছিলেন এবং কথা বলেছিলেন ‌। তারপর ওনার গুরুদেব স্বামী ভূতেশানন্দ মহারাজকে গিয়ে সব কথা বলেও ছিলেন । গুরু মহারাজ শরীরে থাকাকালীন ইন্দ্রদা আরো দু-এক বার বনগ্রাম আশ্রমে এসেছিলেন এবং তখনই হয়তো ন’কাকা সম্বন্ধেও কিছু শুনেছিলেন, কিন্তু তখন উনি সরাসরি ওনার সাথে আলাপ করেন নি । গুরু মহারাজের স্থূল শরীর চলে যাওয়ার পর (1999 সালের 27 শে নভেম্বর)– যখন ন’কাকা শ্রীরামপুর (হুগলি) যাওয়া শুরু করলেন, তখন সুদর্শন মাস্টারমশাই-এর বাড়িতে হাওড়ার সালকিয়ার দেবকুমার ন’কাকার সংস্পর্শে প্রথম এসেছিল । বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে প্রতি রবিবার বা অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনে – দেবু এবং ইন্দ্রদা উভয়েই ‘এক জায়গায়’ হতেন । ওখানেই দেবু, তার ন’কাকাকে প্রথম দর্শনের কথা বিস্তারিত বলতে শুরু করতেই – ইন্দ্রদা তখন গরগর করে বনগ্রাম আশ্রম ও ন’কাকার কথা বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন ! ইন্দ্রদার এই কান্ড দেখে তো দেবকুমার অবাক ! পরে সব কথা জানতে পেরে দেবু ও ইন্দ্রদার মধ্যে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা তৈরী হয় ৷ এর পরেই ইন্দ্রদা দেবকুমারের সাথে ন’কাকার বাড়ি (বনগ্রামে) এসেছিলেন এবং বাড়ি ঢুকতেই ন’কাকার সেই বিখ্যাত কথা – ” এতদিন বাড়ির বাইরে ঘুরঘুর করছিলে, আজ যে সরাসরি একবারে বাড়ির ভিতরেই ঢুকে পড়লে !” এই ঘটনাটির কথা আমি দেবকুমারের কাছে বহুবার শুনেছি ! ন’কাকার সাথে প্রথম যোগাযোগের পর থেকে ইন্দ্রদা প্রায় প্রতিদিনই ন’কাকাকে ফোন করতেন – তার নিজের সাধন-ভজনের বিষয়ে নানা পরামর্শ নিতেন । ওই সময় ইন্দ্রদার মাথায় ঝোঁক চেপেছিল গভীর রাত্রে শ্মশানে গিয়ে সাধনা করার – এবং সেই মতো কাজও করতেন । কিন্তু এইভাবে সাধনা করতে গিয়ে ওনাকে নানান বিঘ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছিল, বাড়িতেও নানা অপদেবতার উৎপাত শুরু হয়েছিল! এইসব বিভিন্ন কারণের জন্যই ইন্দ্রদা ন’কাকাকে একবার তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাতেই কাজ হয়েছিল | উনি ঝামেলামুক্ত হয়েছিলেন । …. [ক্রমশঃ]