[ হাওড়া সালকিয়ার দেবকুমার এবং বেলুড়রা রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ইন্দ্রদার কথা হচ্ছিল | ওরা কিভাবে ন’কাকার কাছাকাছি চলে এল ,সেইসব আলোচনা করা যাক | ]
.যাইহোক, দেবকুমারের কাছে শুনেছিলাম ইন্দ্রদা বহুদিন ধরে দেবকুমারদের (দেবকুমার এবং ভূতনাথকে, কারণ ভূতনাথও প্রতি সপ্তাহে দেবকুমারের সাথে বেলুড়মঠে ভলেন্টিয়ার হিসাবে সেবা কাজ করতে যায়।) পীড়াপীড়ি করতেন – ন’কাকার কাছে দীক্ষা নিয়ে নেওয়ার জন্য ! ওদের বাড়ির সমস্যা এবং ব্যবসা সংক্রান্তও নানান ঝামেলা থাকায় ওরা দীক্ষা নেবার ব্যাপারে গরিমসি করছিল দেখে __একদিন ইন্দ্রদা ওদেরকে বলেন – ” তোমরা বুঝতে পারছ না, তোমরা কি Miss করছো ! যত তাড়াতাড়ি পারো – ওই মহাপুরুষের( ন’কাকার) চরণে শরণ নিয়ে নাও ৷ খুব বেশিদিন সময় পাবে না । ওনার মধ্যে যে কি শক্তির ভান্ডার রয়েছে – তার খবর তোমরা এখনও কিছুই জানো না ৷ আমার (ইন্দ্রদার) সাথে রোজ সূক্ষে যোগাযোগ হয় – ফলে আমি কিছুটা ওনাকে বুঝতে পারি ।”
ইন্দ্রদার কাছে এইসব কথা শুনে দেবকুমাররা অবাক হয়ে যেতো – ‘ ন’কাকা প্রতিরাতে সূক্ষ শরীরে ইন্দ্রদার কাছে আসেন!!’__ তা হয়তো হোতেও পারে – ইন্দ্রদা সাধক, দীর্ঘক্ষন আসনে বসে ধ্যান-জপ করতে পারে, গভীর রাতে শ্মশানে উঠে চলে যায়, – তাই তার পক্ষে তো এইসব অনুভূতি হওয়াটাই স্বাভাবিক !’ – এই ধরনের সিদ্ধান্তে আসতো দেবকুমাররা ! কিন্তু এই কথাগুলি-ই দেবকুমারদের মনে ন’কাকার প্রতি শ্রদ্ধা গাঢ় করতে সাহায্য করেছিল । আর এরই ফলস্বরূপ ওদের ন’কাকার কাছে দীক্ষাগ্রহণ ! ওই যে ইন্দ্রদা ওদেরকে বারবার সচেতন করতেন – “বেশি দেরি করো না – উনি(ন’কাকা)কিন্তু খুব বেশিদিন শরীরে থাকবেন না !” এইটার জন্যই ওরা আর বেশি দেরি করেনি ।
ইন্দ্রদার কথা কিন্তু খুব একটা মিথ্যা হয়নি ! কারণ দেবকুমাররা ন’কাকার সাথে প্রথম যোগাযোগের প্রায় ৫/৭ বছর পর ওনার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করলো এবং দীক্ষা গ্রহণের পর মাত্র বছর দুয়েকের মধ্যেই ন’কাকা স্থূল শরীর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন অমৃতলোকে । এর মধ্যে একটা মজার ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল – দেবকুমারদের দীক্ষা গ্রহণের পর যে কোনো কারণেই হোক না কেন – ইন্দ্রদার সাথে ওর একটু দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়, একদম কথাবার্তাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ন’কাকার সাথে উভয়েরই সুন্দর যোগাযোগ ছিল ।
দেবকুমার একটু আবেগপ্রবণ ব্যক্তি – তাই ও প্রায়ই ফোনে ‘ইন্দ্রদা যে ওর সাথে অকারনে দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল’__ সেই ব্যাপারে ন’কাকাকে Complain করতো ! ন’কাকা ওকে বলতেন – “তুমি তোমার নিজের জায়গায় ঠিক থাকো, দেখবে ইন্দ্র আবার তোমার সাথে যোগাযোগ করবে । এই নিয়ে তুমি বেশি চিন্তা করো না ।” ঠিক তাই হয়েছিল ৷ কিছুদিনের মধ্যেই দেবকুমারের সাথে ইন্দ্রদার পুনরায় সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছিল ।
ন’কাকা শরীর ছাড়ার পর ওনার ভান্ডারার দিন __ইন্দ্রদা বনগ্রাম আশ্রমে এসেছিলেন, সেই দিন ইন্দ্রদার সাথে আমার অনেক কথাবার্তা হয়েছিল৷ কিন্তু তারপর থেকে আমার সাথে ইন্দ্রদার আর সরাসরি কোন যোগাযোগ নাই – তবে হাওড়ার দেবকুমার বা ভূতনাথের মাধ্যমে ওনার সব খবর পাই ! ইন্দ্রদার সাথে আমার শেষ যখন কথা হয়েছিল তখন উনি বলেছিলেন যে উনি প্রায়ই রাত্রিতে ওনার বাড়ির কাছাকাছি কোন শ্মশানে চলে যান বিশেষ সাধনার জন্য ! কিন্তু সেই শ্মশান সাধনা নিয়েই ওনার কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল – এই নিয়ে উনি ন’কাকার পরামর্শ মতো চলতেন । খুব সম্ভবত ন’কাকা ইন্দ্রদা-কে শ্মশানে-মশানে সাধনা করতে নিষেধ করেছিলেন, আর ন’কাকার কথামতো চলে ইন্দ্রদা অনেকটা সমস্যামুক্তও হয়েছিলেন । আর এতেই ওনার ন’কাকার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা দিন দিন খুবই বেড়ে গিয়েছিল । দেবকুমারের মুখে শুনেছিলাম – ইন্দ্রদা বেলুড়মঠে সন্ন্যাসীদের সামনেই অন্যান্য ভক্তদের উদ্দেশ্য করে গলা উঁচিয়ে জোরে জোরে বলতেন – ” এই যে দেবু রয়েছে, ওর গুরুদেব একজন গৃহস্থ সংসারী মানুষ, কিন্তু তিনি এতটাই আধ্যাত্মিক উন্নত ছিলেন যে বর্তমানে ততটা উন্নত সাধু এই মিশনে(বেলুড় মঠ) কেউ নেই !”
দেবকুমারের কাছ থেকে এইসব কথা শুনে আমাদেরও মনটা যেন কেমন হয়ে যেতো ! আমার মনে পড়ে গেল একদিনের কথা_ যেদিন বনগ্রামে গুরুমহারাজ একদিন অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে আশ্রম থেকে মুখার্জি বাড়িতে আসছিলেন (তখন সবটাই কাঁচা রাস্তা ছিল এবং রাস্তার দু’ধারে ফসলের ক্ষেত ছিল), পিছন পিছন ছিলেন তপেশ্বরানন্দ মহারাজ । হঠাৎ গুরুমহারাজ দাঁড়িয়ে পড়লেন দেখে তপেশ্বরানন্দ ওনার নিজের হাতে টর্চ জ্বেলে দেখেন – মাঠ থেকে একটা বিষধর সাপ উঠে এসে গুরু মহারাজের পায়ে প্রণাম করে আবার মাঠে নেমে গেল ! এই ঘটনা নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখে – তপেশ্বরানন্দ মহারাজ তৎক্ষণাৎ গুরুমহারাজের সামনে নতজানু হয়ে বসে (তখন তপেশ্বরানন্দ মহারাজ হয়তো ৬৫/৭০ বছর বয়স, আর গুরুমহারাজের বড়জোর ৩০/৩২ বছর বয়স!) বলেছিলেন – ” গুরুমহারাজ! বনের পশু-পাখি, এমনকি একটা সাধারণ সরীসৃপ তোমাকে চিনতে পারলো, আর আমরা মানুষ হয়েও তোমাকে চিনতে পারলাম না ! এর থেকে বড় লজ্জার আর কি হতে পারে !”
ন’কাকার ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য ! ওই যে ছেলেটি – বেলুড় মঠের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে ন’কাকা সম্বন্ধে ওই কথাগুলি বলতে পারলো – আর আমরা যারা দীর্ঘদিন ন’কাকার সঙ্গ করেছি,তারা এতো দিন কি করলাম ?? তাঁকে কি বুঝলাম??
এই কথাগুলো ভাবলে মনের কি অবস্থা হয় – তা কি বলে বোঝানো যায় ? এ তো অন্তর্দহন – যা ভিতরে ভিতরে করিয়া হয়– ভিতরটাকে পোড়ায় ! … [ক্রমশঃ]