[আজকে “ন’কাকা প্রসঙ্গে” লেখায় ন’কাকার সাথে আমার নানা বিষয়ে যে সমস্ত আলোচনা হোত__সেই বিষয়ে কিছু কথাবার্তা হবে।]
(আগের দিনের আলোচনার পর)….. সেই অর্থে প্রকৃত সাধকেরা বা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীরা কিছুটা হোলেও সুখী ! তবে তিল মাত্র আত্মসুখের বাসনা তাদের মধ্যে থাকলেই কিন্তু আটকে গেল ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেই দিয়েছেন, ” সুতোয় আঁশ বেড়িয়ে থাকলে আর সূঁচের পিছন দিয়ে ঢোকানো যায় না!” আত্মসুখের ইচ্ছা – সন্ন্যাসীর ক্ষেত্রে সেই সুতোর আঁশ ! এই যে কথাগুলো বলছি এইগুলি গুরু মহারাজ অনেকবারই বলেছেন, কিন্তু ইদানিং (শরীর ছাড়ার কিছুদিন আগে থেকে) ন’কাকা এই দিকগুলো নিয়ে খুবই আলোচনা করতেন । আমি যখনই একা একা ন’কাকার সাথে কথা বলতাম – তখনই উনি বর্তমান সমাজে সাধু-সমাজের অবস্থা এবং তাদের ভূমিকা নিয়ে অনেক কথা বলতেন ।
বিশেষতঃ সেই সময় (২০১৭-১৮) পরপর বেশ কয়েকটি নামকরা সাধু বিভিন্ন রকম অপকর্ম জনক কাজে জড়িয়ে পড়ার কথা, খবরের কাগজ বা ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় খুবই আলোড়ন ফেলেছিল – সেই প্রসঙ্গেই কথা উঠতো! আর সেখান থেকে ন’কাকা আমাদের আশ্রমের সাধু-ব্রহ্মচারীদেরও প্রসঙ্গ তুলতেন । অনেক সময় খেদের সঙ্গে বলতেন – ” দেখলে খুবই কষ্ট হয় বাবা ! কাউকে কিছু বলি না – কিন্তু দুবেলাই আশ্রমে যাচ্ছি তো – সব-ই চোখে পড়ে ! কি উদ্দেশ্য নিয়ে ওরা এখানে এসেছিল – আর এখন কি করছে ! খারাপ লাগে – কিন্তু কাকে আর বলবো – গুরু মহারাজের ঘরে গিয়ে মনে মনে প্রণাম করে পরমানন্দের কাছেই সব নিবেদন করি ! ওর (স্বামী পরমানন্দ)- উপর রাগ-ও হয় – কেন যে নিয়ম চালু করে গেল না – তাহলেও তো আশ্রমে একটা discipline থাকতো ! কেউ স্বেচ্ছাচারী হতে পারতো না ! তবে – হবে ! নিয়ম-কানুন সবই হবে , নিয়ম করতেই হবে ! না হলে কি এত বড় একটা প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখা যায় বাবা ! এত সোজা নয় !”
ন’কাকা এইসব কথা আমাকে বলতেন মানে – নিশ্চয়ই উনি আরো কারো কারো সাথেও এই নিয়ে আলোচনা করতেন, অর্থাৎ বলতে চাইছি__ ন’কাকা বনগ্রাম আশ্রমের ব্যাপারে খুবই চিন্তিত ছিলেন ৷ দেখুন __ গুরুমহারাজ তো একটা বিশেষ কার্য্য সিদ্ধ করার জন্যই শরীর নিয়েছিলেন এবং বনগ্রামকে কেন্দ্র করে সেই কাজটি করার সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন । ভগবানের সেই কাজের সহযোগী হিসাবে যেমন গুরু মহারাজের কাছে ব্রহ্মচারী-সন্ন্যাসীরা (পরবর্তীকালের) একে একে এসে পৌঁছেছিল – তেমনি বনগাঁয়ের (বনগ্রাম) বুড়োশিব ন’কাকাও ভগবানের কাজের সহায়তার জন্যই – স্থান আগলে আগে থেকেই বসেছিলেন ! তাইতো গুরুমহারাজ প্রথমবার (প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয়বার, কারণ ছোটবেলায় উনি একবার সন্ধ্যার দিকে বনগ্রামে এসেছিলেন) যখন বনগ্রামে এসেছিলেন, তখন প্রথম সাক্ষাতেই গুরুমহারাজ ন’কাকাকে বলেছিলেন – ” ওঃ, তুমি এখানে ? আর আমি তোমাকে কত জায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছি !”
গুরু মহারাজের মুখের এই কথা থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ-লীলায় ন’কাকার একটা অন্যতম বড় Roll বা ভূমিকা ছিল ! উনি সেই Roll-টাই একেবারে শেষ পর্যন্ত পালন করে গেলেন । এটাকেই একটু আগে বলা হচ্ছিল মহাপুরুদের ১০০% কাজের কথা ! ন’কাকাও তাঁর জন্য নির্দিষ্ট কাজ শতকরা এক’শ ভাগ ই সম্পন্ন করে গেলেন !
ন’কাকাকে দেখতাম (গুরুমহারাজকে খুব একটা কাজ করতে দেখার সৌভাগ্য আমার বিশেষ একটা হয় নি , কারন আমি যখন থেকে আশ্রমে যাওয়া শুরু করলাম_তার just আগে থাকতেই উনি পাকাপাকি ভাবে “গুরুভাব” অবলম্বন করে চলতেন। তবে কোথাও যাবার সময় উনি যখন ওনার জামা-কাপড় গুলো গুছিয়ে রাখতেন – সেগুলো এতো সুন্দর পরিপাটি করে রাখতেন, যেন মনে হতো ইস্ত্রি করা হয়েছে । আর ওনার খাবার সময় দেখেছিলাম – কি সুন্দর নিখুঁত তার খাওয়া-দাওয়া ! খাবারের থালায় ওনার সুন্দর আঙুলগুলির চালনা দেখে মনে হোত যেন একটা নির্দিষ্ট ছন্দে সবকিছু হচ্ছে !) যখন যে কাজটি করতেন – তা সে যত সামান্যই হোক না কেন – উনি ষোলআনা অর্থাৎ ১০০% মনোযোগ সহকারেই করতেন !
একটা ছোট উদাহরণ দিলেই মনে হয় সকলকে খুব ভালো করে এই ব্যাপারটা বোঝাতে পারবো ! – আমরা অনেকেই ন’কাকাকে ভোরে বা সন্ধ্যায় করুণাময়ী কালী মন্দিরে কালী কীর্তন করতে দেখেছি । বৈষ্ণবদের তারকব্রহ্ম নামের মতোই হয়তো এটাও মায়ের তারকব্রহ্ম নাম –
“জয় জয় শিবদূর্গা শিবদুর্গা দুর্গা দুর্গা শিব শিব ৷
শিবকালী শিবকালী কালী কালী শিব শিব ৷৷”
এই মহামন্ত্র তিন চার রকম সুরে গাওয়া হোত ওখানে ৷ ন’কাকাও প্রতিদিনই সেইরকম ভাবেই গাইতেন – কিন্তু অতি মিহি অথচ জলদগম্ভীর গলায় যখন উনি ওই মহামন্ত্র সঙ্গীতাকারে গাইতেন – তখনও তাঁর নিবিষ্টতা থাকতো ঐ ১০০% ! মাথা নিচু করে তন-মন-প্রাণ এক করে মৃদু অথচ গহীন কন্ঠের সেই সংগীত আমরা অনেকদিন শুনেছি – তাঁর সঙ্গে কখনো কখনো গলাও মিলিয়েছি ! খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম বলেই খেয়াল করেছিলাম – তাঁর ওই নিবিষ্টতার ব্যাপারটি ! … [ক্রমশঃ]