একদিন গুরু মহারাজের কাছ থেকে শুনে আমরা ন’কাকার কাছে ‘সহজ’ ও ‘সরল’ হওয়াটাও সাধনার অঙ্গ – এইসব নিয়ে আলোচনা করছিলাম ! ন’কাকা শুনেই হো হো করে হেসে বলে উঠলেন – ” ও (স্বামী পরমানন্দ) এসব কথা বলবে না তো কে আর বলবে বল বাবা ! সবাই পড়াশোনা করে পন্ডিত – আর ও (স্বামী পরমানন্দ) না পড়ে পন্ডিত ! পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞানের কথা সবই ওর মুখে ৷ তবে বাবা ! ওই যে বললে ‘সরল’ হওয়া – তা সরল হওয়া কি মুখের কথা ! দেখো না – অংক কষার সময় ‘সরল’ করতে গিয়ে দেখা যায় তার মধ্যে গুন-ভাগ-যোগ-বিয়োগ সবই রয়েছে ! তাই ‘সহজ’- ‘সরল’ হওয়া সহজ কথা নয় বাবা ! এরজন্য জন্ম-জন্মান্তরের সাধন-ভজন-তপস্যার প্রয়োজন !”
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে সরকারিভাবে নানা প্রকল্পের নামের শেষে – ‘শ্রী’ জুড়ে দেওয়া হচ্ছে ৷ এই প্রসঙ্গে আমরা ওনার সাথে কথা বলতে শুরু করতেই উনি সব কথা না শুনেই বলে উঠলেন – “হ্যাঁ বাবা ! শেষে হবে ‘হতশ্রী’ ! আর যে কোনো জিনিস ‘হতশ্রী’ হওয়া মানেই তখন তার বদলের প্রয়োজন হয় !”
আমরা এই কথাগুলোকে প্রথমটায় হালকা হাসির কথা ভেবেছিলাম, কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখেছিলাম যে উনি চিরন্তন সত্য কথা-ই সেদিন আমাদেরকে বলেছিলেন । সত্যিই তো – সব কিছুরই যেমন সৃষ্টি হয় , তেমনি তারপর তার ধ্বংস বা মৃত্যুও অবশ্যম্ভাবী ! মাঝে শুধু থাকে একটাই বিষয় – সেটা হল স্থায়িত্বকাল । ভারতীয় দর্শন শাস্ত্র এই জন্ম ও মৃত্যু বা ধ্বংসের ক্রমগুলি কত সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন – প্রাগ্উৎপত্তি, উৎপত্তি, প্রবৃদ্ধি, রূপান্তর, ক্ষয় ও লয় ৷ সুতরাং যার সৃষ্টি রয়েছে – তার লয়ও রয়েছে ! তাই ন’কাকার সেদিনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ারও যে কতটা গূঢ় অর্থ, ঐ কথাতেও কতটা দূরদর্শিতার পরিচয় রয়েছে – তা ভেবে আমরা চমৎকৃত হয়েছিলাম !
কোন কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেওয়াটা ন’কাকার একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ৷ এতটাই তাৎক্ষণিক এবং এতটাই যথাযথ সেই উত্তর বা প্রতিক্রিয়া যে ওনার এই ধরনের উত্তর যে-ই শুনেছে – সে-ই অবাক হয়েছে ! আমার মনে হয় ন’কাকার যে কোনো ভক্তের-ই উপরোক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং ওনার এই ধরনের ছোট ছোট কথা অথচ চরম তাৎপর্যপূর্ণ কথার উদাহরণ – তারা প্রত্যেকেই দিতে পারে ৷৷ আমি হয়তো কোনসময় ন’কাকাকে ফোনে বনগ্রাম আশ্রমের ছেলেদের রেজাল্টের কথা জিজ্ঞাসা করতাম (যেহেতু দীর্ঘদিন বনগ্রাম হাইস্কুলে আমি শিক্ষকতা করেছিলাম – তাই ওখানকার রেজাল্ট নিয়ে আমার একটা জানার ইচ্ছা থাকতোই), _” ন’কাকা , এবার আমাদের আশ্রমের ছেলেদের রেজাল্ট কেমন হল ?”– উনি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠতেন – ” এখন তো বাবা সবাই পাশ ! আর তো এপাশ-ওপাশ হবার বালাই নাই ! একেবারে সরকারিভাবে পাকাপাকি ব্যবস্থা ! ‘পাশ’ করলেও পাশ – ‘ফেল’ করলেও পাশ ! কোন মাস্টার (টিচার) যদি কোন ছাত্রকে ফেল করায় – তাহলে তাকে উপরওয়ালার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে । তা – কে আর কৈফিয়ত দিতে চায়_বলো, সেইজন্যই সবাই পাশ !”
ন’কাকার এই তাৎক্ষণিক উত্তরে আমি হেসে গড়িয়ে পড়তাম । বলতাম – ” ন’কাকা ! আপনি এমনভাবে কথাগুলো বলে দিলেন, যাতে করে মনে হচ্ছে – আপনি এইসব ব্যাপার নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছেন – তারপর মন্তব্য করছেন !” উনি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলেন – ” তা – আর কি বলবো বাবা ! যা দেখছি বা শুনছি, তাই বলছি ! আমি যেখানেই যাই – সেখানেই বিভিন্ন স্কুলের মাস্টারমশাইদের সাথে তো আমার কথা হয়, তাদের মুখ থেকেই এইসব নানান কথা শুনতে পাই ! ন’কাকার কথার রেশ ধরে আমি চিন্তা করে দেখলাম – বনগ্রাম স্কুলের টিচার-রা তো রয়েছেই, তাছাড়া শ্রীরামপুরের সুদর্শন মাস্টারমশাই এবং আশা-মার স্বামীও হাই স্কুলের টিচার ছিলেন ৷ বোলপুরে তো ঝাঁকে ঝাঁকে মাস্টারমশাই , বয়স্ক দুজন মাস্টারমশাই_ কীর্ণাহারের সুশীল (চ্যাটার্জী) বাবু এবং আমোদপুরের মিহির (মুখার্জী) বাবু, (এনাদের দুজনেরই মাথায় ছিল সাদা চুল, সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ওনারা যখন পাশাপাশি আশ্রমে বসে থাকতেন – তখন যে কি ভালো-ই না লাগতো ! ওই দুজন বিদগ্ধ পন্ডিত মানুষ বসে থাকা মানেই – সেই স্থানের শোভাবর্ধন করা) !
আরও ছিলেন একজন পন্ডিত শিক্ষক নিরোদবরণ ব্যানার্জি – উনি তিনটে বিষয়ের M.A. ছিলেন, আমোদপুর হাইস্কুলের হেডটিচার দেবাশীষ (ভট্টাচার্য্য) বাবু ছিলেন– উনিও ডক্টরেট করা লোক – এনারা সকলে ন’কাকা বোলপুরে গেলেই ওনার সাথে দেখা করতে আসতেন ! সর্বোপরি বোলপুর আশ্রমের দুই রত্ন কৌশিক (দত্ত) এবং গৌতম (ঘোষ)- এরা দুজনেই হোলেন কলেজের অধ্যাপক । বোলপুর (আদিত্যপুর) আশ্রমের একজন মহারাজ শশাঙ্ক মহারাজও একজন শিক্ষক, বোলপুরে-র (কীর্ণাহার) আশু (আশুতোষ দত্ত)-ও শিক্ষক । ওখানকার ভক্তদের মধ্যেও অসিতবাবু, ধীরানন্দ বাবু প্রমুখরাও শিক্ষক ছিলেন ৷ সেইজন্যেই বলছিলাম – আদিত্যপুর আশ্রমে তো শিক্ষকদের হাট বসে যেতো ! আর পাঁচজন টিচার এক জায়গায় হলে তো বর্তমান শিক্ষা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার গল্প হবেই ! সেই গাল-গল্প আলোচনায় ন’কাকাও যোগদান করতেন এবং মজার মজার মন্তব্য করে আসর জমিয়ে রাখতেন ! … [ক্রমশঃ]