আমরা ন’কাকার তাৎক্ষণিক ছোট ছোট কথা অথচ সেইটুকুর মধ্যেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ থাকার ব্যাপারটা আগে আলোচনা করেছি । সেই কথাগুলিই আরো একটু বিস্তারিত আলোচনা হোক ! ন’কাকাকে আমরা পুরুষেরা বা ছেলেরা যখনই ফোন করতাম – উনি ফোন তুলেই বলতেন – ” হ্যাঁ বাবা – বলো !” আবার কোন মহিলা ভক্ত ফোন করলে উনি ফোন ধরেই বলতেন – ” হ্যাঁ মা – বলো !” কোনো কোনো সময় ফোন করা ব্যক্তিটি (তা সে নারীই হোক অথবা পুরুষ) যে কারণে ওনাকে ফোন করেছে , তাকে অবাক করে দিয়ে– উনি ফোন তুলে সেই নির্দিষ্ট কারণ-টিই জিজ্ঞাসা করতেন ! ফলে সেই ব্যক্তি ওনাকে তার সমস্যার কথা, দুঃখের কথা শোনাবে কি – উনিই নানারকম আরো এই ধরনের ঘটনার কথা উদাহরণ হিসাবে বলে দিতেন ! এতে হোত কি – ওই ব্যক্তিটির সমস্যার সমাধান হয়তো তক্ষুনি হোতো না, কিন্তু তার মনে একটা অদ্ভুত শান্তি আসতো !
এইরকম ফোন কল এবং ন’কাকার উত্তর দান আমার সামনে বহুবার হয়েছে ! ফলে এই ব্যাপারটা আমি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলাম বলেই আপনাদেরকেও বলতে পারছি। যাইহোক,পরে হয়তো কোনদিন আমি সেই ফোনকলের ঘটনাটি উল্লেখ করে ওই ব্যক্তির সেদিনের বলা সমস্যার সমাধান কিছু হয়েছে কিনা তা জানার চেষ্টা করতাম ! উনি কি কি হয়েছে, কিভাবে তার সমাধান হয়েছে – সেই সব কথা অবলীলায় বলে দিতেন ! এর ফলে ন’কাকা শরীরে থাকাকালীন আমার না চেনা অনেকের অনেক কথাই আমি জানতাম । জানতাম অর্থে – ন’কাকা জানাতেন বলেই জানতাম ।
একদিন ন’কাকার সঙ্গে এটা-ওটা কথা বলতে বলতে ‘ভক্ত’ শব্দটি এসে গেল – অমনি ন’কাকা বলে উঠলেন, “বাবা ! ভক্ত হওয়া কিন্তু খুব শক্ত কথা ! কথায় রয়েছ না – ‘ভক্ত বড় শক্ত কথা – গুরু রইল বসে, গাছের ফল গাছে রইল – বোঁটা পড়ল খসে ।’ এখানে ‘বোঁটা’- বলতে মানুষের ‘অহং’ ! যেকোনো ভক্ত বা সাধক ‘অহং’-মুক্ত হলে সে নিজেই গুরু হয়ে উঠতে পারে ৷ মানুষটা সেই একই থাকল কিন্তু সে যেন নতুন মানুষ ৷ একেই বলা হয়েছে ‘ গাছের ফল গাছে থাকা ‘৷ ঠাকুর পরমানন্দ এইসব কথা খুব আমাদেরকে বোঝাতো ! তখন প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় ঠাকুর আমাদের (ন’কাকাদের) বাড়িতে যেতো – আর যাওয়ার পরই শুরু করতো কথা ! মাঝে মাঝে গানও হোত , নিজেই গান করতো – নানারকম গান ! তবে বাউল গান-ই বেশি গাইতো – একবার গান গাইতে শুরু করলে আর থামাথামির নাম নাই। একটার পর একটা গান গেয়েই যাচ্ছে!(এইকথা বলতে বলতেই ন’কাকার সেই মধূর হাসি) আবার মাঝে মাঝে আমাকেও (ন’কাকাকে) বলতো – ‘ন’কাকা ! তুমিও একটা গান করো’৷”
এতটা শোনার পর সেদিন আমি ন’কাকাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম – ” ন’কাকা ! আপনিও কি গান গাইতেন?” উনি বললেন – ” তা – দু-একটা গান করতে হতো বই-কি !” আমি আবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম – ” কি ধরনের গান গাইতেন ন’কাকা ?” ন’কাকা বলেছিলেন – ” আমি আর কি গান করবো বাবা ! ওই মায়ের গান !”
আমি বুঝলাম, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ‘শ্যামাসংগীত’-ই গাইতেন । অবশ্য ন’কাকার শ্রীমুখে কোনদিন শ্যামাসঙ্গীত শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি , ওই যা মা করুনাময়ীর মন্দিরে মায়ের নাম গান শুনেছিলাম! যাইহোক, ন’কাকা সেদিন আরো কি বলেছিলেন –সেই কথায় আসি। উনি বলেছিলেন – ” ঠাকুর(স্বামী পরমানন্দ) বাউল গান গাওয়ার পর – সেই গানগুলির ব্যাখ্যা বেশ সুন্দরভাবে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিতো ! মহাজনদের লেখা দেহতত্ত্ব-বিষয়ক বাউল গানগুলির মর্মার্থ বোঝা সাধারণের কম্মো নয় – পরমানন্দ সেগুলি সহজ-সরলভাবে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করে দিতো !” আমি আবার জিজ্ঞাসা করে জানতে চাইলাম – ” ন’কাকা ! গুরুমহারাজ বাউল গানগুলির যে ব্যাখ্যা করতেন – সেগুলি দু-একটা বলুন ! আমরাও তাহলে শুনতে পাই ।”
উনি তখন বলেছিলেন – ” ওই কথাই তো বলছিলাম ৷ ওই যে কথাটা বলতাম, ও তো ওঁর-ই (স্বামী পরমানন্দ) ব্যাখ্যা ! তাছাড়া লালন সাঁই-এর বিভিন্ন গানেরও ঠাকুর ব্যাখ্যা করে বোঝাতো ! “চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে “- গানটির ব্যাখ্যায় উনি বলেছিলেন – “এটা নির্বিকল্প সমাধি অবস্থার বর্ণনা।” সাধক যখন সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে যান তখন তিনি আর সাধারণ মানুষ থাকেন না – তিনি তখন মানুষ-চন্দ্র হয়ে যান ! যেমন – শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে বলা হয়_নবদ্বীপ-চন্দ্র বা ‘নদীয়ার চাঁদ’, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয় কৃষ্ণচন্দ্র ,বৃন্দাবন-চন্দ্র ইত্যাদি ! সেইসময় অর্থাৎ নির্বিকল্প সমাধির সময় – আত্মা এবং পরমাত্মার মিলন হয়, মানুষতত্বের মধ্যেই তখন ঈশ্বরতত্বের প্রকাশ ঘটে যায় । এটাই “চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগা”– যা সাধারণ মানুষ কখনোই ভেবে কুল-কিনারা করতে পারে না !
ঐ গানে এর পরের যে কলিগুলি রয়েছে – সেগুলির মর্মার্থ রয়েছে_ ওই সাধক কিভাবে ধীরে ধীরে সাধনার ধাপ অতিক্রম করে পূর্ণতা পায় – তার রহস্য ! যেমন _ছয় মাসের এক কন্যা, নয় মাসে তার গর্ভ এবং এগারো মাসে তিনটি সন্তান এবং একটি ফকিরি নেবে – এইগুলি রয়েছে ওই গানটির কলিতে ! এইগুলির অন্তর্নিহিত অর্থ হলো – ঐ সাধক (যিনি নির্বিকল্প স্থিতিতে পৌঁছাতে সমর্থ হয়েছেন) তিনগুণ (স্বত্ত্বঃ,রজঃ,তমঃ)-কে জয় করে ত্রিগুণাতীত হ’ন এবং ঈশ্বরতত্ব অবগত হন। শাস্ত্রে ওঁ-কার কে ঈশ্বরের রূপ বলা হয়েছে ! ওঁ শব্দের মধ্যে অ–উ–ম এই তিনটি শব্দ রয়েছে, যার অন্য অর্থ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন Great Theory of Creation, Sustension and Destruction ! এদের মধ্যে মহেশ্বর শিব-ই হোল সর্বত্যাগী(ফকির) ! আর যত কিছু সাধন-ভজন সেতো এই নবদ্বার বিশিষ্ট শরীরকে কেন্দ্র করেই।”
তখন ঐ মহাসাধক তাঁর ষড়রিপুকে স্ববশে নিয়ে আসতে পারেন এবং তিনি নবদ্বারবিশিষ্ট শরীরের সমস্ত নিম্নগতি রুদ্ধ করে মাতৃস্বরূপা কুলকুন্ডলিনীকে ঊর্ধ্বগতি প্রাপ্ত করিয়ে দশমদ্বার (সহস্রার) খুলতে সমর্থ হ’ন – তখন তিনি ঈশ্বরত্ব লাভ করে নিজেই ঈশ্বরস্বরূপ হয়ে যান । এছাড়াও ঐ গানে রয়েছে “কে তাহারে আহার যোগায় ,কে দেয় গো সন্ধ্যাবাতি”_ নির্বিকল্প সমাধি অবস্থায় সহস্রার থেকে ‘চন্দ্রবারুনী সুধা’ -ক্ষরিত হয় !তখন সাধকের আর অন্য কোন আহারের প্রয়োজন হয় না। আর জ্ঞান রূপ সূর্যের উদয় হওয়ায় ,সেই আলোকেই সাধক নিজে যেমন আলোকিত থাকে_জগতকেও আলোকিত করে ‌।
ন’কাকার কাছে সেদিন গুরু মহারাজের করা এই ব্যাখ্যা শুনে আমার মনে খুবই আনন্দ হয়েছিল। কারণ ছোটবেলা থেকেই এই গানটি শুনে আসছি, কিন্তু ঠিকমতো ব্যাখ্যা কোনদিন জানতে পারিনি – বরং উল্টাপাল্টা সব কথা শুনেছিলাম ৷ তাতে মন তো ভরেই নি–শুধু কৌতূহল আরও বেড়ে গেছিল। সেইদিন ওই বাউল গানটির মর্মার্থ জানতে পেরে মনটায় সত্যিই খুব শান্তি হয়েছিল । … [ক্রমশঃ]