প্রিয় আত্মন্ ! সমস্যা-জর্জর এই পৃথিবীতে বর্তমান পরিস্থিতি খুবই সঙ্কটজনক । চতুর্দিকে ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে, সংস্কৃতির নামে নানারকম সামাজিক অবক্ষয়ের সম্মুখীন হয়েছে বর্তমান মানবজাতি । চতুর্দিকে সংস্কৃতি ও সমাজ কল্যাণের নামে গোষ্ঠী-চেতনা, শ্রেণী-চেতনা ও সম্প্রদায় চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। স্বার্থপরতা এবং লোভ মানবিক মূল্যবোধকে গ্রাস করতে অগ্রসর আজ । ক্রমান্বয়ে মানবের নৈতিক মূল্যের অবক্ষয় ঘটে চলেছে। মানবের মূল্যবোধ আজ বিপন্ন হতে চলেছে।
মানবজীবনের প্রকৃত লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য স্থির করতে না পারলে মানবজাতি চরম দুর্গতি ও বিপন্ন পরিস্থিতির আবর্তে পড়বে। কেবল বাহ্য সুখ-সম্পদের পিছনে ছুটলে মানব ক্রমান্বয়ে লোভী ও স্বার্থপর হয়ে পড়বে । সমাজে শান্তি বিঘ্নিত হবে। স্বার্থপরতা মানব-চেতনার বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করে দেয়। মানব সতৰ্ক ৰা সচেতন না হলে কালে মানবিক মূল্যবোধ ও জীবনের মহত্ব হারিয়ে ফেলবে । সেইজন্য যা আশ্রয় করলে মানবের বৈশিষ্ট্য ও জীবনের মূল্যবোধ ক্ষুণ্ণ ও বিপন্ন হবে না—তাই মানবজাতিকে আশ্রয় করতে হবে। আর তা হল ধর্ম অর্থাৎ যা মানবের অস্তিত্বকে ধারণ করে থাকে।
প্রিয় আত্মন্—মানব তার মানবিক বৈশিষ্ট্য এবং জীবনের মূল্যবোধ যদি হারিয়ে ফেলে, তাহলে মানবের পরিপূরণ বা পূর্ণতা কখনই সম্ভব নয়। সুতরাং যা মানবের বৈশিষ্ট্যকে বিপন্ন না করে— মানবজীবনের অস্তিত্বকে ধারণ করে—এক কথায় তাই ধর্ম আরযামানবেরবৈশিষ্ট্যকেবিপন্নকরে—তাঅধর্ম।
মানব আপন অস্তিত্বকে বিপন্ন করে বাঁচতেপারে না। সেইজন্য ধর্মের আদর্শকে আশ্রয় করতেই হবে। কারণ এইটাই বেঁচে থাকার কলা । আপন অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকাটাই প্রকৃত বাঁচা, নতুবা আপন অস্তিত্ব সম্বন্ধে চেতনাহীন আত্মবিস্মৃত হয়ে জীবন ধারণ করাটা মৃত্যুতুল্য । সেই কারণে ঋষিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়—’মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।’
সুতরাং লোভ বা স্বার্থ মানবের বাঁচার কলা নয়, ধর্মাদর্শই মানবের বাঁচার কলা ।
নানা বৈচিত্র্যে ভরা এই পৃথিবী—বহু ভাষা, বহু প্রজাতি, আচার- ব্যবহারের বিভিন্নতা ও রুচি-বৈচিত্র্যে ভরা। এদের ঐক্যসূত্রে বাঁধতে পারে এক ধর্মচেতনা। মানবকে ধর্মের আদর্শকে আশ্রয় করতে হবে—যার মধ্য দিয়ে মানব তার জীবনের পূর্ণতা লাভ করবে। আর একে অস্বীকার করারও উপায় নেই, কারণ জীবনের সহজ প্রবণতাই হল পূর্ণতা লাভ করা।
মানবের চিরকালের আকাঙ্ক্ষা—অজানাকে জানার। মানব বুদ্ধি বৃত্তির দ্বারা সমস্ত কিছুকে অস্বীকার করতে পারে, কিন্তু কেবলমাত্র সে পারে না নিজেকে অর্থাৎ আপন অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে। সেইজন্য মানবের সহজ অভিলাষ আপন অস্তিত্বকে অনুসন্ধান করা । আপনাকে জানার তাগিদ প্রতিটি মানব অনুভব করে এবং অনাদিকাল হতে মানব স্ব-স্বরূপকে অনুসন্ধান করছে। ‘আমি কে ?’ এবং ‘কি ?’ –এটাই মানবের অনাদি জিজ্ঞাসা—এটা অস্বীকার করারও উপায় নেই । জীবনধর্মকে অস্বীকার করার অর্থ—আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া আর কি! কেন্দ্রবিহীন যেমন বৃত্ত রচনা করা যায় না, সেইরূপ ধর্মবিহীন জীবন গড়ে উঠে না। ধর্মচ্যুতি মানেই কক্ষচ্যুতি —যার পরিণাম ভয়াবহ। সুতরাং জীবনবোধে উপনীত হতে হলে ধর্মাদর্শকে আশ্রয় করতেই হবে।
জগতে কিছু শ্রেণীর মানব—ধর্ম যে জীবনে অপরিহার্য—একথা স্বীকার করেন না। তাঁরা বলে থাকেন—ধর্মচিন্তা জীবনের অগ্রগতিকে রুদ্ধ করে এবং ধর্ম অনুশীলন মানব সমাজের প্রগতির পথকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। সুতরাং ধর্ম-ব্যাপারটা জীবন হতে বাদ দেওয়া উচিত।
প্রিয় আত্মন্—ধর্মাদর্শের মূল বিষয় চারটি, যথা সত্য, ত্যাগ, প্রেম ও শাস্তি। এইগুলি যে মানবগোষ্ঠীর ভিতর অনুশীলন বা অনুসরণ হয় না, সেই মানবগোষ্ঠী অসহজ ও জীবনবিরোধী হয়ে পড়বে। আর সে সমাজে মানবও নিরাপদ নয়।
কারণ সত্যের অভাবে মিথ্যাচার, ত্যাগের অভাবে স্বার্থপরতা, প্রেমের অভাবে পাশবিকতা এবং শান্তির অভাবে জীবন অস্থির ও মূল্যহীন হয়ে পড়বে। সুতরাং এই চারটি বিষয়কে বর্জন করে মানবসমাজকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া যেন সরীসৃপকে দাঁড় করাবার প্রচেষ্টা৷ সেইহেতু সত্য, ত্যাগ, প্রেম ও শান্তি এই চারটি জীবনধর্মের মূল বিষয়। এগুলির যে মানবগোষ্ঠীতে অনুসরণ বা অনুশীলন হয় না, সেখানে জীবনের মূল্যবোধ থাকে না। যে ধর্মগোষ্ঠী ঐ বিষয়গুলির ওপর গুরুত্ব দেয় না, সেই গোষ্ঠী ধর্মের মৌলিক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে এবং অধ্যাত্ম চেতনার ক্ষীণতাবশতঃ তখন কেবলমাত্র একটা সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। আর যেখানে অধ্যাত্মচেতনা নেই, সেখানে গোষ্ঠীচেতনা, শ্ৰেণীচেতনা, স্বার্থচেতনা ও সম্প্রদায়চেতনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তখন শুরু হয় সংঘর্ষ—কলহ—মারামারি-কাটাকাটি। মানবের রক্তে পৃথিবী সিক্ত হয় বারবার। স্বার্থ ও লোভ তাদের প্রতিনিয়ত কলহলিপ্ত করায়—এটা খুবই বেদনাদায়ক !
প্রিয় আত্মন্ ! অধ্যাত্ম চেতনার অভাবই মানবকে এইরূপ পাশবিক করে তোলে। তাই পাশবিক চেতনা হতে ভগবৎ-চেতনায় উত্তরণই হল আধ্যাত্মিক রহস্য আর এইখানেই মানবের পূর্ণতা । পশুচেতনা অর্থাৎ সীমিত ইন্দ্রিয় প্রবণতা—যা কেবল আহার-বিহার-রমণ-নিদ্রা-ভয়ের অনুভূতি সাপেক্ষ! ঐ চেতনা ভগরৎ অনুভূতিতে অপারগ, সেইহেতু অপূর্ণ আর ভগবৎ চেতনা আত্ম-বোধ বা ঈশ্বর বোধে পরিণত হয় —সেইজন্য তা পূর্ণ । এই আত্মতত্ত্ব বা ঈশ্বর বিভিন্ন দেশ—কাল-পাত্রে ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত। স্বরূপতঃ এটা এক–অভিন্ন—অখণ্ড । এই শাশ্বত সত্যকে বোধে বোধ করাই হল জীবনের পূর্ণতা। অখণ্ডেরবোধযতক্ষণনাহচ্ছে, ততক্ষণ মানবজীবন অপূর্ণ । এইজন্য অপূর্ণ সীমিত পশুচেতনা হতে অখণ্ড ভগবৎ চেতনায় উত্তরণ হল আধ্যাত্মিক রহস্য । এখন নিশ্চয় বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না যে, ধর্মের আদর্শ বা মূল বিষয় হল চারটি। আর ঐ অন্তনিহিত আর ঐ অন্তর্নিহিত ভাবগুলির অভাবে মানবজীবনের মূল্যবোধ থাকে না মানবসমাজ নিরাপদও এবং যে ধর্মগোষ্ঠী এইগুলির অনুসরণ তথা অনুশীলন করে না, নয়। তারা আধ্যাত্মিক ভাবচ্যুত একটা সম্প্রদায় মাত্র ।
সত্য, ত্যাগ, প্রেম ও শান্তি—এই চারটি হল মূল বিষয়। যেমন কেবল ‘চিনি চিনি’ বললে বলে মুখ মিষ্ট হয় না, ‘জল জল’ বললে পিপাসা নিবারণ হয় না, সেইরূপ এইগুলি কেবলমাত্র মুখে উচ্চারণ করলে কিংবা কণ্ঠস্থ করে আবৃত্তি করলে জীবনে প্রকট হবে না। এইগুলি অনুশীলন সাপেক্ষ। এইগুলি প্রথমে জেনে নিয়ে তারপর জীবনে যোজনা করতে হবে। তাহলে তা জীবনে প্রকট হবে।
যথা সদাচার দ্বারা জীবনে সত্য প্রকট হবে। যিনি সৎ বা সদাচারী নন, তাঁর জীবনে সত্য মূর্ত হয় না। মিথ্যাচার জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। সুতরাং সত্যকে অনুসরণ করতে হলে সদাচার অনুশীলন করতে হবে। সেইজন্য সত্য—অনুসরণ আর সদাচার—অনুশীলন । দ্বিতীয়তঃ, পরোপকার দ্বারা জীবনে ত্যাগ প্রকট হয়। যিনি বহুজনের হিতে, বহুজনের সুখে আপন স্বার্থমুখ ভুলে পরোপকারে আত্মনিয়োগ করেন, তিনি ত্যাগী । কারণ স্বার্থ ত্যাগই প্রকৃত ত্যাগ ৷ নতুবা ত্যাগ বিড়ম্বনা মাত্র। এই কারণে পরোপকার ব্রত নিয়ে মানব স্বার্থত্যাগ করতে পারে। স্বার্থপর ব্যক্তির জীবনে কখনও ত্যাগ প্রকট হয় না। অতএব ত্যাগ হল অনুসরণ আর পরোপকার হল অনুশীলন । তৃতীয়তঃ, ভালবাসার দ্বারা জীবনে প্রেম প্রকটিত হয়। যিনি সকলের প্রতি দ্বেষ বা ঘৃণার ভাব পোষণ করেন, তাঁর জীবনে প্রেম মূর্ত হয় না। যিনি সকলকে ভালবাসেন, তিনিই প্রকৃত প্রেমিক। এইজন্য প্রেমের কোন ইতর বিশেষ নেই—প্রেম স্বাধীন। পাশবিকতাসম্পন্ন ব্যক্তির জীবনে কখনও প্রেম প্রকট হয় না। এই কারণে প্রেম— অনুসরণ আর ভালবাসা—অনুশীলন। চতুর্থতঃ, সংযম দ্বারা জীবনে শান্তি প্রকট হয় । যিনি অসংযমী তাঁর জীবনে কখনও শান্তি মূর্ত হয় না, কারণ অসংযম তো ইন্দ্ৰিয় আচরণ এবং এটা মন, প্রাণ, মানবের সমস্ত রকম অশান্তির মূলে। সেইজন্যই অসংযমী, বিকারগ্রস্ত মানব কোনদিন শান্তিপ্রাপ্ত হয় না ৷ এইজন্য শান্তি অনুসরণ আর সংযম অনুশীলন । সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম যে, মানব সমাজের ভিতর যদি সদাচার, পরোপকার, ভালবাসা এবং সংযম না থাকে, তাহলে যে কোন প্রান্তে—যে কোন মানবগোষ্ঠীতে দেখতে পাওয়া যাবে মিথ্যাচার, বিড়ম্বনা, নীচ-স্বার্থপরতা, তুলনাহীন পাশবিকতা এবং অসংযম । সমাজে নেমে আসবে নানারকম অসংযত প্রতিক্রিয়া যা মানব জীবন- কে করবে বিষময়। মানব জীবনবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হবে। পৃথিবীতে নেমে আসবে মানব সভ্যতার অপমৃত্যু। সুতরাং ধর্ম—জীবনের কলা বা বাঁচার কলা । ধর্মকে বাদ দিলে জীবনটাই বাদ পড়ে যায়। পৃথিবীতে পুর্ব পূর্ব কালে যে সমস্ত মহামানব আবির্ভূত হয়ে ছিলেন, তাঁরা নিজেদের মহান জীবনের মধ্য দিয়ে মানবজাতিকে এই চারটি মূল বিষয়ের শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং তাঁরা আপন আপন জীবনে এগুলি আচরণ করে গিয়েছেন। পৃথিবীর সর্বকালে—সর্বস্থানে যে সমস্ত আধ্যাত্মিক মহামানবগণ আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁদের জীবনে এগুলি মূর্ত বা প্রকটিত হয়েছিল। তাঁরা প্রত্যেকে ছিলেন সত্যনিষ্ঠ, সদাচারপরায়ণ, আপন স্বার্থ-বুদ্ধিমুক্ত, বিশ্বকল্যাণকারী, নিষ্কলুষ, সহজ প্রেমিক, সংযমশীল এবং শান্তির মূর্ত প্রতীক । তাঁদের জীবনগুলিই ধর্মরূপ—যা মানবজাতির চরম আদর্শ।
প্রিয় আত্মন্ ! ধর্মকে আশ্রয় কর । সৎ হও। পবিত্ৰ হও। স্বার্থমুক্ত পরোপকারী হও। কলুষমুক্ত প্রেমিক হও এবং সংযম, সাম্য ও শান্তির মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠ। অচিরেই বোধ করবে— আনন্দ প্রতিষ্ঠিত—পরমেশ্বরের মহিমা অপার ।
॥ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ॥