গুরুমহারাজ: রামায়ণ হলো মহাকাব্য। পৌরাণিক ঘটনাসমূহ রস-আশ্রিত হয়ে মহাকাব্যের আকারে প্রকাশ পেয়েছে। সুতরাং হাজার হাজার বছর আগের কোনো ঘটনা নিয়ে সাহিত্য রচনা হয়েছে -তার মধ্যে সত্যি খুঁজতে যাওয়াটা বোকামী হবে না কি! কোন যুক্তি প্রমাণ তো তুমি হাজির করতে পারবেনা!
হিন্দি-বলয়ে এখনও রামায়ণ চর্চা অনেকটাই বেশী হয়। সাধু-সন্ত থেকে সাধারণ মানুষ রাম-সীতার ভজনা খুবই করে। তবে দিন দিন মানুষ রাম-সীতা ছেড়ে হনুমানজীর যে ভাবে ভক্ত হয়ে উঠছে-সেটা দেখে মানুষের সঠিক level টা পাওয়া যাচ্ছে!! আমি তোমাদের আগেও বলেছি -যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা যে level_এর, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা সেই অনুযায়ী সব কিছু choice করে থাকে। একদল ছাগল কে যদি নেতা নির্বাচন করতে হয়, তো তারা কি পশুরাজ সিংহ কে নেতা নির্বাচন করবে- তা করবে না। তারা একটা হৃষ্টপুষ্ট পাঁঠা কে নেতা হিসাবে মেনে নেবে! যেটা চেহারায় সবচাইতে বড় বা শক্তিশালী,যার লম্বা দাড়ি,যার বড় বড় বাঁকানো শক্তিশালী সিং রয়েছে-এইসব গুণাবলী ছাগল দলের নেতা হবার জন্য উপযুক্ত। এই ভাবেই মানব সমাজে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা,সামাজিক নেতা,রাজনৈতিক নেতার জন্ম হয়। তুমি হয়তো ভাবতে পারো “কি করে অমুক ব্যক্তি এতো বাজে লোক হওয়া সত্ত্বেও ওই দলের নেতা হলো?” কিন্তু এটা তোমার ভাবনা -ওই দলের সমর্থক দের নয়। তারা ওই নেতার শত দোষের মধ্যেও এমন কোনো গুন খুঁজে নিয়েছে যেটা তাদের প্রকৃতির সঙ্গে মেলে। সেই জন্যই সে ওদের কাছে নেতা।
যাই হোক প্রসঙ্গে ফিরে আসি- দ্যাখো রাম সত্য কিনা সে বিতর্কে যাচ্ছি না কিন্তু রামতত্ব সত্য -চিরন্তন সত্য! তবে জানবে যে রামতত্ব -রামায়ণ পাঠে বা পাঠ শুনে জানা যাবে না। এটি বোধের ব্যাপার! রামতত্ব কে বোধে বোধ করতে হবে। উত্তর ভারতে বিভিন্ন সাধু মহলে খুবই রাম চর্চা হয়, ‘রাম’জী র নামে বিরাট বিরাট আশ্রম,মঠ রয়েছে। শ’য়ে-শ’য়ে রামায়েৎ সাধু সেখানে একসাথে জড়ো হয়, সম্মেলন হয়। “জয় শ্রীরাম” ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে যায়। ওখানে বিভিন্ন সম্মেলনে আমি সাধুদের কেও এই কথাই বলেছি। ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল “তুমি রামজী কে মানো?” আমি উত্তর দিয়েছিলাম “কোন রাম?” বিভিন্ন রামায়ণ -আর তাতে রাম চরিত্র বদলে বদলে গেছে।
শুধু বাল্মীকি রামায়ণ তো সকলে মানে না।দক্ষিণ ভারতে কন্বমুনির রামায়ণ চলে।বাংলায় চলে কৃত্তিবাসী রামায়ণ। ওখানে সীতাকে দিয়ে শ্রাদ্ধ করালো, রামকে দিয়ে অসময়ে দুর্গাপূজা করালো। হিন্দি বলয়ে সাধারণতঃ তুলসীদাসী রামায়ণ চলে – কিন্তু সেখানেও মূল রামায়ণ থেকে অনেক বিচ্যুতি ঘটেছে এবং সেই অনুযায়ী ওদের ধারণা তৈরী হয়েছে। তাই সাধুদেরকে বলেছিলাম “কোন রাম?” তারপর বললাম “আমি কোনো পুস্তকের রাম কে জানিনা, কিন্তু আমি প্রকৃত রাম বা রামতত্ব টি জানি”। রামতত্ব জেনে নিজেই “রাম” হয়ে ওঠা যায়। একথা শুনে ওরা চুপ করে গেছিল।
যাই হোক, তুমি জিজ্ঞাসা করছিলে রামায়ণ পাঠ করা বা রামায়ণ পাঠ শোনায় কোন উপকারিতা আছে কিনা___দ্যাখো, সেক্ষেত্রে আমি বলব উপকারিতা তো আছেই! যে কোন মহান মানব বা মহিয়সী নারীর জীবন পর্যালোচনা করলে কি পাওয়া যায়_ত্যাগ, সংযম, বিবেকপরায়নতা, কর্তব্যপরায়নতা এইসব তো!
রামায়নের বিশেষ চরিত্রগুলিতে এইসব মহান গুনাবলীরই প্রকাশ দেখতে পাবে। যেমন সীতার ক্ষেত্রে মহান হয়ে উঠেছে পতিব্রতা ধর্ম, লক্ষ্মণের চরিত্রে অসাধারণ ভ্রাতৃপ্রীতি ও আত্মত্যাগ, ভরতের চরিত্রেও আত্মত্যাগ ও কর্তব্যনিষ্ঠা। আর সবার উপরে রাম__তাঁর চরিত্রে সবই গুন!! সীতার প্রতি সামান্য অবহেলা (তাও তা প্রজানুরঞ্জনতার জন্য) ছাড়া এনার চরিত্রে কোথাও কোন ত্রুটি পাবে না। এইসব চরিত্র গুলিতে প্রকাশিত মহান মানবিক গুনের দু_চারটেও যদি সাধারণ মানুষের জীবনে প্রকাশিত হয়, তাহলে সে মানব থেকে মহামানব না হয়ে উঠলেও_দেবমানবে পরিনত হয়ে যাবে।
গোটা পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস যা পাওয়া যায় (পুরানাদি শাশ্ত্র)_সেখানে আদর্শ নারীচরিত্র কোথায়?? সেভাবে বিশ্বের কোন দেশের সাহিত্যেই কোন মহিয়সী নারী বা আদর্শ নারীচরিত্রের চিত্রায়ন হয় নি তো!! একমাত্র ভারতবর্ষের দুটি প্রাচীন মহাকাব্যে দুটি মুখ্য আদর্শ নারীচরিত্র চিত্রায়িত হয়েছে _ সীতা এবং দ্রৌপদী। এদের মধ্যে আবার ভারতীয় নারীসমাজ সীতাচরিত্র কে একান্ত আপন ভেবে নিয়েছে এবং ঐরকম হয়ে ওঠাকেই জীবনের সার্থকতা হিসাবেও মেনে নিয়েছে। এইভাবেই বহুকাল থেকে ‘সীতা’ ভারতীয় নারীর আদর্শ হিসাবে পরিচিতা বা পূজীতা হয়ে আসছে।
ভারতীয় যে পরিবার প্রথা এতকাল ধরে চলে আসছে (অতি সম্প্রতি এই প্রথা উঠে যাবার মুখে) সেখানে ভরত বা লক্ষনের মতো ভাই সব দাদারাই আশা করে।
পিতামাতারাও ভাবেন যে তাদের পুত্ররা যেন রাম_লক্ষনের মতো সারাজীবন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বজায় রাখে। এইজন্যই এখনও কোন পরিবারে দুটি ভাই হলে রাম_লক্ষন নাম রাখা হয়। যদিও বাস্তবে আর রাম লক্ষন কখনোই হয়তো জন্মায় নি, কিন্তু সেই প্রভাব রয়ে গেছে। কারন রামায়নের চরিত্রগুলি ভারতবর্ষের যে কোন অঞ্চলের যে কোন সমাজব্যাবস্থার মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য। পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষ কিন্তু এই চরিত্রগুলি গ্রহন করতে পারবে না বা বলা ভালো গ্রহন করতে চাইবে ও না।
তবে দ্যাখো_এই যে তোমরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা রামায়ন নিয়ে জিজ্ঞাসা করছ_এটা কিন্তু আমাকে ভাবায়! আধুনিক ছেলেমেয়েরা রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ পড়বে, সেখান থেকে জিজ্ঞাসা করবে_সেটা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক! তা না করে সেই পুরোনো prescription! এ যুগের ছেলে হয়েও মহাকাব্য, পুরানাদি শাশ্ত্র থেকে জিজ্ঞাসা করছ_এগুলো কি??
আবার দ্যাখো, এখানেও ত্রুটি_original গ্রন্থ কেউ পড়ছে না, TV Serial দেখে শিখছে! বোঝো কান্ডটা!! Original বই পড়লে তবু তার মধ্যে কিছু সঠিক তথ্য পাওয়া যেতে পারে কিন্তু TV Serial যারা তৈরী করে তারা তো ব্যবসায়িক স্বার্থটাই বড় করে দেখে!
ঘটনার সত্যতা কতটুকু পরিবেশন হল_সেটা কি দেখে?? ফলে এই ধরনের মিডিয়ার শিক্ষার মধ্যে একটা বিরাট ফাঁকি থেকে যাচ্ছে। তাই বলছিলাম তোমরা নতুন প্রজন্ম_তোমাদের উপর সমাজের, দেশের কত আশা! তোমাদের দ্বারাই দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে! তা তোমরা এখনও পুরোনো আদর্শ ধরে বসে থাকবে কেন_নতুনকে গ্রহন করো! পুরাতনকে শ্রদ্ধা করো কিন্তু নবীনকে বরন করে নাও। সাধারণ মানুষ অতীতের চর্বিত-চর্বন করতে ভালোবাসে_তোমরা যারা এখানে আসছ, আমার কথা শুনছ_তারা ঐ দলে পড়বে কেন!! অতীত থেকে শিক্ষা নাও, অতীতের মহান দিক গুলিকে শ্রদ্ধা করো_কিন্তু পূজা করো বর্তমানের! শুধু অতীতকে নিয়ে পড়ে থাকা মানেতো backward movement হচ্ছে, এটা কি প্রগতির লক্ষন? প্রগতির লক্ষন হচ্ছে forward movement!! চরৈবেতি! চরৈবেতি! এগিয়ে চলো! এগিয়ে চলো সামনের দিকে! সর্বদা নজর থাকুক সুদূরের দিকে। তবে তো অগ্রগতি হবে!
অতীতকে নিয়ে পরে থাকা বেশীরভাগ মানুষেরই প্রকৃতি, কিন্তু প্রকৃতিকে জয় করাই তো মানবজীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর এই লক্ষ্য পুরনের জন্য প্রয়োজন সাধনার। জীবনে ত্যাগ, সংযম, নিষ্ঠা, ধৈর্য্য_ইত্যাদি না থাকলে সেই জীবনে সাধনা হয়না। আর যে জীবনে সাধনা নাই সেই জীবনে প্রকৃত অগ্রগতি বা আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়না। হয় সে জড়বৎ হয়ে যায় অথবা তার পশ্চাতগতি হয়।
সুতরাং বর্তমানকে উপেক্ষা কোরো না! বর্তমানকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র অতীত নিয়ে আলোচনা আর গবেষণায় কাজের কাজ কিছুই হয়না। শুধু শুধুই সময় নষ্ট হবে, শরীর জীর্ণ হবে__তখন আর নতুন করে নতুনকে নিয়ে ভাববার বা কিছু করার আর সময় থাকবে না।
সেই জন্য আমি আজকের young generation_কে বলছি__তোমরা স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী পড়, স্বামীজীর ভাবনার সাথে পরিচিত হও, তার আদর্শে নিজেদের জীবনকে গড়ে তোল!
আজকের যুগের মহাপুরুষদের নিয়ে ভাবো__আলোচনা করলে তাঁদের জীবন ও বানী নিয়ে আলোচনা করো, তাঁদের বলা কথা অনুযায়ী জীবন যাপন করতে গিয়ে যদি কোন অসুবিধা দেখা দেয়__তা বুঝতে কোনো সাধু_মহাত্মার সঙ্গ করো, আধ্যাত্মিক জীবনে উন্নীত হবার জন্য সাধনপ্রনালী নিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো।
আর শুধু সদগ্রন্থ পাঠ বা সাধু সঙ্গে আলোচনাই নয়, হৃদয়ে সেই সব মহাবাক্য ধারন করো! এইভাবে তোমরা সমৃদ্ধ হয়ে সমাজের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ো__দেখবে তোমার উন্নতি, তোমার মঙ্গলের সাথে সাথে সমাজের তথা দেশের ও সর্বাঙ্গীন মঙ্গল হবে। এযুগের কর্ণধার, যুগপুরুষ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, বিশ্বেশ্বরী জননী সারদেশ্বরীর নামে জয়ধ্বনি করো। বলো_জয় শ্রী শ্রী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জয়।
__জয় জগজ্জননী সারদা মাতার জয়।
__জয় শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দের জয়।