প্রশ্ন—আপনি ‘কর্ম রহস্য’ প্রসঙ্গে আলোচনা করাকালীন বলে- ছিলেন—’কোন কর্ম ই কাল-রাজ্যের বাইরে নয়। কালের অধিপতি হলেন ঈশ্বর।’ —এখন আমার মনে এই প্রশ্ন আর এই উঁকি দিচ্ছে— ‘ঈশ্বর কি বাস্তবিক আছেন—না কল্পনা’—আপনি এই সম্বন্ধে অনুগ্রহপূর্বক কিছু বলুন ।

উত্তর— প্রিয় আত্মন্‌, এই জগতে সর্বাপেক্ষা জটিল বিতর্কিত বিষয় হচ্ছে—’ঈশ্বর আছেন কি নেই !’

কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব এমনই বাস্তব যে, বিশ্বের সমস্ত সত্যের সত্য—পরম সত্য তিনি। ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে—বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন একজনও কেউ নেই । যেমন তোমার সম্মুখে সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী, আকাশ, দিন ও রাত মূর্তিমান ও বাস্তবরূপে ঘটে চলেছে এবং এদের তুমি অস্বীকার করতে পার না, এরূপ ঈশ্বরের অস্তিত্ব এদের চেয়েও বাস্তব এবং সত্য। আবার যেমন তোমার প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধৰ, মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন—এরা তোমার কাছে বাস্তব এবং এদের অস্তিত্ব তোমার কাছে সত্যরূপে প্রতীয়- মান ; এরূপ ঈশ্বরের অস্তিত্ব এদের অপেক্ষাও সত্য। ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনায় এরা সমস্তই মিথ্যা

সুতরাং এই বিশ্বজগতে যাবতীয় সৃষ্টি, ক্রিয়াকর্ম, নাম ও রূপ ঈশ্বরের তুলনায় মিথ্যা । বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একমাত্র ঈশ্বরই সত্য। তিনি সকল সত্যের সত্য—পরম সত্য।

প্রশ্ন—আপনি বললেন, ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে—বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন একজনও নেই । তাহলে জগতে নাস্তিকেরা রয়েছে কেন ?

উত্তর—প্রিয় আত্মন, জগতে নাস্তিক বলে কেউ নেই । এদের ভ্রান্ত বলতে পারো, কারণ আপন অস্তিত্ব রয়েছে যার, সে কি করে নাস্তিক হতে পারে ? তারা ভ্রান্ত। ভ্রান্ত এই কারণে বলছি- তারা প্রতিনিয়তই ‘আমি’ ‘আমি’ বলছে অথচ এই আমিত্ব বা আপন অস্তিত্ব সম্পর্কে তারা সচেতন নয়। প্রতিনিয়তই আমিত্ব পারে ? ঘোষণা করেছে, অথচ আমিত্ব সম্পর্কে অজ্ঞাত। সুতরাং তারা ভ্রান্ত বা আহম্মক ছাড়া আর কি হতে

প্রশ্ন—কিন্তু তারা বলে থাকে— ঈশ্বর ধারণার পিছনে কোন যথার্থতা বা সত্যতা নেই, সুতরাং তা কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।— এই সম্পর্কে আপনি কিছু বলুন ।

উত্তর—প্রিয় আত্মন্ । তোমার কথা অনুসারে ঈশ্বর যদি কল্পনাই হন, তাহলে কল্পনারও একটা ভিত্তি থাকবে কল্পনারও একটা কল্পনারও একটা মূল বা উৎস থাকবে । ” সেইটি কি ? কারণ কল্পনার ওপর ভিত্তি করে কল্পনা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না এবং কল্পনার ভিত্তি কল্পনা হতে পারে না । নিছক কল্পনাকে কেন্দ্র করে কোন কল্পনা গড়ে উঠতে পারে না। সুতরাং কল্পনার যে ভিত্তি তা নিছক কল্পনা নয়, তাঁকে সত্য হতে হবে । কারণ ধারণা, কল্পনা, চিন্তা—এদের মূলে একজন থাকেন। সেইজন্যই ঈশ্বরকে ঘিরেই সমস্ত কিছু কল্পনা, কিন্তু ঈশ্বর কোন কল্পনা নন ৷

ঈশ্বরকে ভিত্তি করেই সমস্ত কল্পনার উদ্ভব, কিন্তু ঈশ্বরকে ঈশ্বরকে কল্পনা করা যায় না । কল্পনা কেবল কল্পনাই—তাছাড়া আর কিছুই নয় ।কল্পনার দ্বারা ঈশ্বরকে লাভ করা যায় না। ঈশ্বর-অনুভব সত্য— ঈশ্বর সাক্ষাৎকার না হলে ঈশ্বরকে জানা যায় না। এখন নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছ—ঈশ্বরকে ভিত্তি করেই যা কিছু কল্পনা, কিন্তু ঈশ্বর কোন কল্পনা নয় ।

প্রশ্ন—এবার আপনি আমাকে এই ‘ঈশ্বর’ সম্পর্কে একটু বিস্তারিতভাবে বলুন ।

উত্তর—প্রিয় আত্মন্ – প্রথমেই তোমাকে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বর অনুভব সত্য—ঈশ্বর সাক্ষাৎকার দ্বারা তাঁকে জানা যায়। ঈশ্বর সাক্ষাৎকার বিনা তুমি তাঁকে জানতে পার না । কল্পনা করে তাঁকে কেমন করে জানবে ? কারণ যাঁর যে বিষয়ে অনুভব নেই, তিনি যদি সেই বিষয়ে ভাবতে চেষ্টা করেন বা ভাবতে থাকেন, তা কল্পনা ছাড়া আর কি হতে পারে ? মানব উপলব্ধিহীন কোন বিষয়কে তার পূর্ব উপলব্ধ কোন বিষয়ের সঙ্গে তুলনামূলক কল্পনা করে থাকে । সুতরাং ঈশ্বর সাক্ষাৎকার বা আত্মার বোধে বোধ সমাধির ভিতর দিয়ে হয় । সমাধি অবস্থা প্রাপ্ত হলেই ঈশ্বর সাক্ষাৎকার হয় ।

প্রশ্ন—এইমাত্র আপনি যে ‘সমাধি’র কথা বললেন,—এই ‘সমাধি’ সম্পর্কে একটু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করবেন কি ?

উত্তর—প্রিয় আত্মন্—তোমার জিজ্ঞাসা শুনে বহু পূর্বে শ্রুত একটি হাস্যকর গল্পের কথা মনে পড়ছে । গল্পটি এরূপ—একদিন এক ব্যক্তি একজন অন্ধের নিকট খুব সুন্দর এবং সালঙ্কারে দুধের বিচিত্রতা ও স্বাদ বর্ণনা করছিলেন। কিন্তু যাকে এই সকল কথা বলা হচ্ছিল, সেই অন্ধ কোনদিন দুধ পান করেনি, সুতরাং দুধ সম্পর্কে তার পুর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না । অনেকক্ষণ ধরে দুধের বর্ণনা শুনবার পর অন্ধলোকটি বর্ণনাকারীকে জিজ্ঞাসাকরল— ‘মহাশয় দুধ কিরূপ ?’

বর্ণনাকারী—‘এতক্ষণ ধরে বললাম, এটা বুঝলি না ?ওরে, দুধহল খুব ধব ধবে সাদা ।’

অন্ধ—‘মহাশয়, ধব্ ধবে সাদা আবার কি ?’

বর্ণনাকারী—’ধব্ ধবে সাদা মানে বকের মতো সাদা ৷’

অন্ধ—’মহাশয়, বকটা আবার কি ?’

বর্ণনাকারী—‘ওরে বোকা! এটাও বুঝিস্ না ? বক জলে থাকে।’

অন্ধ— ‘মহাশয়, জল কেমন দেখতে ?’

বর্ণনাকারী—‘জল হল খুব স্বচ্ছ।’

অন্ধ—’মহাশয়, স্বচ্ছ ব্যাপারটা আবার কি ?’

বর্ণনাকারী—‘ওরে মূর্খ ! স্বচ্ছতাও বুঝিস্ না ? কাঁচের মতো স্বচ্ছ।’

অন্ধ—’আচ্ছা আচ্ছা ! এবার বুঝেছি ।’

এবার বুঝে দেখ, অন্ধের দুধের সম্পর্কে ধারণা হল— দুধটা ঠিক কাঁচের মতো, আর দুধের কেমন স্বাদ তা বুঝবার জন্য একটু কাঁচের টুকরো মুখে দিয়ে পরীক্ষা করতে গেল । আর যায় কোথায় ? —মুখটা কেটে-ছিঁড়ে রক্তপাত ঘটে একাকার কাণ্ড ! তখন অন্ধ চিৎকার করে বলতে লাগল— ‘ওরে বাপ্-রে, দুধ খেতে এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা— আমি আর কোনদিন দুধ খাবো না !’

এক্ষণে তাহলে তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছো, – দুধের অনুভব কাঁচ দিয়ে হবে না——উল্টে বিপদ ঘটবে। দুধ পান করলেই কেবল দুধের স্বাদ অনুভব হয়। এইজন্য ঈশ্বরের বোধে বোধ না হলেঈশ্বরকে জানা যায় না। তথাপি ঈশ্বরকে ধারণা করবার জন্য কিছু সংজ্ঞা আছে—যার দ্বারা তাঁর আভাস দেওয়া যায়।

প্রশ্ন—ঐ সম্পর্কে কিছু বলুন। আপনি সংজ্ঞার দ্বারা কিছুআভাস দিন।

উত্তর— প্রিয় আত্মন্ ! যেমন মনে কর—তিনি সর্বশক্তিমান, অর্থাৎ সমস্ত শক্তিতে তিনি পূর্ণ—সমস্ত রকম শক্তি তাঁর মধ্যে আছে । ঈশ্বর ছাড়া এমন একজনও নেই, যিনি এই সমস্ত শক্তির অধিকারী। তিনিই একমাত্র সর্বশক্তিমান । এই পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, মন এবং ইন্দ্রিয়াদি— সমস্তই জড় পদার্থ। এদের নিজস্ব কোন শক্তি নেই। এরা ক্রিয়াশীল । এই জড়পদার্থসকল কেবল আপন আপন কর্ম করে থাকে । ঈশ্বরের শক্তিতে সমস্ত কিছুই ক্রিয়াশীল । সর্বশক্তিসম্পন্ন একমাত্র তিনিই। আর এই শক্তি বা সামর্থ্য ঈশ্বর ছাড়া মহাবিশ্বে আর কারও নেই ৷

প্রশ্ন—আরও সংজ্ঞা আছে নাকি ?

উত্তর—নিশ্চয়। যেমন মনে কর— তিনি চৈতন্যময়। এই সমগ্র জড়ৰিশ্বে একমাত্র তিনিই চৈতন্যময়। জড়বিশ্বের সকল বস্তু তাঁর চৈতন্যাভাসে ক্রিয়াশীল।

প্রশ্ন—আচ্ছা এই যে জড় এবং চৈতন্য বললেন— এদের সম্পর্কে অনুগ্রহপূর্বক একটু বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলুন।

উত্তর—প্রিয় আত্মন্—এটা অতি সহজভাবে বিচার করলেই বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না। যেমন ধরো চিন্তাশক্তি ; জড় চিন্তা করতে পারে না, চৈতন্যই চিন্তা করে । যেমন বোধশক্তি, চৈতন্যই একমাত্র বোধ করতে পারে, যেখানে জড় নিজেকে বোধ করতে পারে না ।আবার বাক্শক্তি জড়ের নেই, চৈতন্যের আছে । এরূপ দৃষ্টিশক্তি জড়ের নেই, শ্রবণশক্তি জড়ের নেই। জানবার শক্তি, আহার করবার শক্তি—ইত্যাদি অনন্ত শক্তির অধিকারী চৈতন্যময় ঈশ্বর ।

প্রিয় আত্মন্‌—আশাকরি তুমি বুঝতে পারলে যে, সমস্ত কিছু শক্তির মালিক একমাত্র ঈশ্বর—তিনিই সর্বশক্তিমান । তিনি এই শক্তির অধিকারী আর কাউকেও করেননি। পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, দেহ, নাম, মন, ইন্দ্রিয়—এক কথায় সমগ্র বিশ্ব অচেতন—জড়, কেবল ঈশ্বরের শক্তিতেই সমস্ত কিছু শক্তিমান।

প্রশ্ন—ঈশ্বর সম্পর্কে আরও কিছু সংজ্ঞা আছে ? যদি থাকে,তাহলে তা শুনবার আমার খুবই আগ্রহ হচ্ছে ।

উত্তর—হ্যাঁ, আরো অনেক সংজ্ঞার দ্বারা তাঁর আভাস দেওয়া যায়। যেমন মনে কর—তিনি অখণ্ড অর্থাৎ আদি অন্তহীন, সর্বত্র বিরাজমান । এমন কোন স্থান নেই যে, যেখানে তিনি অবর্তমান। যেমন ধরো—যেখানেই বাক্য, সেখানেই ঈশ্বর বক্তা। যেখানে চিন্তা— সেখানে ঈশ্বর চিন্তাকারী। যেখানে কল্পনা— সেখানে ঈশ্বর কল্পনাকারী। যেখানে পরিকল্পনা—সেখানে ঈশ্বর পরিকল্পনাকারী। যেখানে কর্ম—সেখানে ঈশ্বর কর্মকর্তা। যেখানে সৃষ্টি—সেখানে ঈশ্বর সৃষ্টিকর্তা । যেখানে দৃশ্য — সেখানে ঈশ্বর দ্রষ্টা। যেখানে দেহ— সেখানে ঈশ্বর দেহের আত্মা। সর্বোপরি ঈশ্বর সর্বত্র অখণ্ডরূপে বিরাজমান ।

প্রশ্ন—উপরোক্ত সংজ্ঞা ছাড়াও ঈশ্বর সম্পর্কে যদি আরও সংজ্ঞা থাকে, তাহলে সেগুলিও বলুন ।

উত্তর—হ্যাঁ, আরও সংজ্ঞা আছে। যেমন ধরো, তিনি সর্বজ্ঞ। এই মহাবিশ্বে একমাত্র ঈশ্বরই বিজ্ঞাতা। ঈশ্বর যা জানেন না, জগৎ, তা জানে না এবং জানা তা অসম্ভব। অন্তর্জগৎ, বহির্জগৎ—সমগ্র সৃষ্টি এই জানার শক্তি হতে বঞ্চিত। কারণ ঈশ্বরের অনন্ত শক্তির একটা শক্তি হল—এই জানার শক্তি। সুতরাং ঐ শক্তিরও শক্তি নেই যে তাঁকে জানে এবং কল্পনা করে। . তাই ঈশ্বরই একমাত্র চৈতন্যময়—বিজ্ঞাতা এবং সর্বজ্ঞ।

প্রিয় আত্মন্—এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ জগতে নাস্তিক বলে কেউ নেই, প্রকারান্তরে যারা নিজেকে নাস্তিক বলে তারা ভ্রান্ত এবং ভ্রান্তরা এরূপ মনে করে থাকে—ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস বর্জন করলেই বুঝি সমস্ত রকম কষ্ট দূর হয়ে যাবে ।

জিজ্ঞাসু—আপনার অনুগ্রহে এবার আমি রহস্যগুলি অবগত হয়েছি। আপনি আমায় আশীর্বাদ করুন ৷ উত্তর—প্রিয় আত্মন্‌, নিজের ওপর ভরসা রাখ । ঈশ্বরবিশ্বাসী হও। তাঁর শক্তিতে শক্তিমান হয়ে উঠ। বুদ্ধি, হৃদয় এবং শরীরে বলবান হয়ে উঠ, কারণ বলহীন, কাপুরুষ, অজ্ঞ ও আহাম্মক কখনই সত্যকে বা ঈশ্বরকে জানতে পারে না । বৈদান্তিক সুপ্রখর মেধাযুক্ত হও । পরম বৈষ্ণবের ন্যায় হৃদয়প্রাপ্ত হও এবং বীর শাক্তের ন্যায় শরীরে মজবুত হয়ে উঠ। বেদান্তের মস্তিষ্ক, বৈষ্ণবের হৃদয় এবং শাক্তের শরীর—এই তিনটিকে আধার করে গড়ে উঠুক তোমার জীবন ।