” শ্রী গৌরাঙ্গের মধুর লীলা , যার কর্ণে প্রবেশিলা
হৃদয় নির্মল ভেল তার ৷”
বৈষ্ণব মহাজনগণ ভক্তিরসের সার কথাগুলো বলেই রেখেছেন ৷ তাই আমাদেরকে সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেই বলতে হয় – ” পরমানন্দের মধুর লীলা – যার কর্ণে প্রবেশিলা – হৃদয় নির্মল হয় তার ৷” কেন্দ্র আগে স্থির না করলে যেমন বৃত্ত আঁকা যায় না – তেমনি কেন্দ্রে ‘ পরমানন্দ’ আছে বলেই বিস্তৃতি ৷”পরমানন্দ মণ্ডল” বলেছিলেন গুরুজী -__ ১ , ৩ , ৬ , …. ৬৪ , ১২৮ ইত্যাদি ক্রম । সেখানেও কেন্দ্রে ১ = পরমানন্দ । আর পরমানন্দ ভক্তমন্ডলী যেন মালার মতো ।
” মালিকা পড়িলে গলে প্রতিফুলে কেবা মনে রাখে” ৷ স্বামী পরমানন্দ , পরমানন্দমন্ডল , পরমানন্দ ভক্তমণ্ডলী এগুলিরই দাম — এখানে individual বা কোন এক ব্যক্তির মূল্য এমন কিছু নয় ৷
ঘটনাগুলি ‘ আমি ‘ উপস্থাপনা করছি , তাই ‘ আমি ‘ , ‘ আমার ‘ , ‘আমাকে ‘ – এই শব্দগুলো বারবার ব্যবহৃত হচ্ছে বা হবেও – কিন্তু ‘ আমি ‘ জানি যে “আমি” নগণ্য – যিনি মহান , যিনি মহৎ , যিনি বৃহৎ বা বৃহৎ অপেক্ষাও বৃহৎ , মহৎ অপেক্ষাও মহত — তিনি স্বামী পরমানন্দ । আর তিনি ‘ কলম ‘ দিয়েছিলেন বলেই লেখার সাহস ! উনি বলেছিলেন ” তবু তোরা লেখ “। আর সত্যিই একবার উনি একটা কলম দিয়েছিলেন । ওনার ব্যবহার করা কলম । পরে ফেরৎ দিতে গেলে উনি বললেন ” ওটা তোর কাছেই রেখে দে ৷”
” সেই লিখি মদন গোপাল ” — ! পরদিন সকাল হ’ল ৷ অনুপদা (পূর্ণানন্দ মহারাজ ) – র খোঁজ করতে গিয়ে শুনলাম মাটির দেড়তলা ঘরে রয়েছে ৷ ওখানে গিয়ে দেখি নীচে দুটো ঘর , একটা ঘরে কিছু মালপত্র আর মদন মহারাজ ( চিৎবিলাসানন্দ ) থাকেন ৷ আর অন্য ঘরটায় ৪/৫ টা অনাথ বালক ছিল ৷ তাদের মধ্যে সিঙ্গুর অঞ্চলের প্রদীপ এবং মনা (একজন সাঁওতাল ছেলে ) – কে মনে আছে ৷ ওরাই পরমানন্দ মিশনের অনাথ আশ্রমের প্রথম ব্যাচ্ ।
দেড়তলার উপরে উঠে দেখি দুটো ঘর – ডানদিকের ঘরে তৃপ্তিমা চা করছেন , একটি ছোট স্টোভ জ্বেলে ৷ আশ্রমে তখন চা হোত’না ৷ সকাল বিকাল তৃপ্তিমা একটু চা করতেন – যারা জানত এবং যারা চা-খোর , তারা ঐখানে গিয়ে হাজির হোত । তৃপ্তিমার সম্বন্ধে শুনলাম উনি দমদম এলাকার মেয়ে , ওখানেই একটা হাইস্কুলে চাকরী করতেন – M. A. পাশ করেছেন ৷ গুরু মহারাজকে দেখে , তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে চাকরী ছেড়ে দিয়ে এখানে ব্রক্ষচারিনীর জীবন-যাপন করছেন । [ এই দেখাগুলো কিন্তু পরমানন্দ সম্বন্ধে আমার ভাবনায় বড় বড় ধাক্কা ! — তাহলে কি পরমানন্দ সম্বন্ধে আমার Assessment ভুল !! ] তৃপ্তি মা(সংহিতাপ্রানা)_কে কিছুদিন পরেই গুরুমহারাজ করিমপুর আশ্রমের রুপদান এবং বিকাশের জন্য ওখানে পাঠিয়ে দেন। আরও পরে উনি গুরুমহারাজের নির্দেশে নরওয়ে(ইউরোপ)_তে peace university তৈরীর কাজে ওখানকার ভক্তদের সাহায্য করতে চলে যান। এখন পর্যন্ত (2018) উনি ওখানেই কাজ করে চলেছেন।
পুর্নানন্দ মহারাজ এমনিতে খুব রসিক লোক ছিলেন। বসে বসেই মজার মজার কথা বলে উপস্থিত সকলকে বেশ আনন্দ দিতে পারতেন। চায়ের আসরে বসে সেদিনও উনি এই কাজটাই করছিলেন। চা হলে তৃপ্তিমা তৃষানদা(বর্তমান স্বামী পরমেশ্বরানন্দ)_কে এক কাপ দিয়ে এলেন এবং বাকিদের ও দিলেন। চা পান শেষ হলে এবার বিদায়ের পালা। অনুপদা আবার সেই একই ক্যাসেট বাজাল_”তাহলে গুরুমহারাজের কাছে বিদায় নিয়ে আয়। ” আমি বললাম__” না, ওখানে যাব না। যদি আবার একই কথা বলে_যদি বলে “যাবেনা” !!! “
__” তাহলে যাবিনা। তবে আটকাবে না_তুই যা তো একবার!! “
__” কোথায় যাব__ওনার ঘরে?? “
__” এখন সকালে উনি স্নান পায়খানা করবেন, তবে একটু পরেই উনি বাইরে বসবেন_তখন বলে চলে যাবি। “
আমি আর কি করি! একটু অপেক্ষা করতেই হল। উনি বেশ খানিকটা পর বেড়িয়ে এলেন। অনেকেই প্রনাম করে বিদায় নিয়ে চলে গেল, অনেকে প্রনাম করে সিটিং শুনবে বলে বসে পড়ল (ওনার আগের ঘরের ঠিক সামনে দাওয়ায় উনি বসতে, ভক্তরা নিচে)। আমিও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে যেই না বলেছি “আমি চলে যাচ্ছি”__অমনি উনি উল্টো দিকে তাকিয়ে কার সাথে যেন কথা বলতে শুরু করলেন। আমি বোকা ক্যাবলার মত দাঁড়িয়েই আছি। বিরক্ত লাগছে!! যা দু_চার জন বসে ছিল তারাও আমাকে এবং আমার অসহায় অবস্থা দেখে বোধহয় মজা পাচ্ছিল (আমার অন্তত তাই মনে হচ্ছিল)। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল যে _পালাই!!
কিন্তু ভদ্রতায় বাধছিল আর অনুপদার জন্যেও খানিকটা পারছিলাম না।
বেশ কিছুক্ষন পরে উনি এদিকে মুখ ফেরালেন। তখন আমি আবার ঐকথা গুলো বললাম। উনি আবার যেন কার সাথে কথা বলতে লাগলেন। এতো মহা মুশকিল হলো!! এবার আমি আর ভদ্রতা রাখতে পারলাম না__জোর গলায় বললাম “আমি চলে যাচ্ছি”। উনি যেন কথাটা প্রথম শুনলেন__এমন একটা ভাব নিয়ে বললেন “যাবে! আচ্ছা ঠিক আছে, পরে যাবে।”
আমি বললাম “না না_আমি এখনই যাব। আমার অনেক কাজ রয়েছে।”
___”কাজ কার নেই? এখানে যারা রয়েছে তাদের সকলেরই কাজ আছে। তাহলে তারা আছে কি করে? তুমি ও থাকবে। দেখছ না আমি কথা বলছি। এখন যাও__কেমন!!! “
কি সুন্দর ভাবে কথা গুলো বলে দিল। আমি আরও দু এক মিনিট হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে এলাম। গতকাল থেকে এক জামাকাপড়ে__অসহ্য লাগছে!! অনুপদা এবং উদয়দা(স্বরূপানন্দ) ও__একই কথা বলল যে এটা নাকি মহাভাগ্য!!! গুরুমহারাজ থাকতে বলছেন মানেই_ নিশ্চয়ই কোন ব্যাপার আছে।
গা প্যাচপ্যাচ করছে_স্নান না করলেই নয়!! মাঠের দিকে মায়ানদী তে গিয়ে প্রাতঃকৃত্য এবং স্নান সেরে নিলাম। একটা গামছা বোধ হয় অনুপদা ই যোগাড় করে দিয়েছিলেন।
আশ্রমে ফিরে আসতেই আবার চিনু, নগেন এদের সবার সাথে দেখা। আবার হই হই করে দুপুর অব্দি কাটিয়ে দেওয়া!! [এখানে একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে যে উনি কিন্তু একবারও আমাকে বসে সিটিং শুনতে বলছেন না!!] তবে এর ফাঁকে ফাঁকেই আমি নগেন এবং অন্যান্যদের কাছ থেকে গুরুজী সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিয়ে চলেছি। আশ্চর্যের বিষয় এই যে কেউই ওনার সম্পর্কে কোন negative কথা বলল না। সবাই একই কথা বলে “উনি মহাপুরুষ!! এখানে অনেক কিছু হবে_এখানে দ্বিতীয় বেলুড়মঠ হবে!!” আলাপ হল বনগ্রামের নবুমাষ্টার, স্বপন খুড়ো, রাম মন্ডল__এদের সাথে। দেখলাম ওরা গুরুমহারাজ কে “ঠাকুর”_বলে সম্বোধন করে।
ঘাবড়ে যাচ্ছি! সময় যত কেটে যাচ্ছে ততই উনি বড়ো থেকে বড়োতর হয়ে যাচ্ছেন আর আমার নিজেকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর মনে হচ্ছে। তাহলে কি আমি গুরুমহারাজকে মেনে নিচ্ছি?? __না! বিকালেই চলে যাব। তাহলে বিকাল টাই হোক!!