গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ একদিন বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে সকালের দিকে একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন – যার মূল বিষয়বস্তু ছিল – “জগতে হারায় না তো কিছু !” এই প্রসঙ্গে নানা কথা বলতে গিয়ে উনি আরও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিজ্ঞানের কথা বলছিলেন ! উনি সেদিন বলেছিলেন মানুষ যে সকল চিন্তা করে – সেই সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম চিন্তা তরঙ্গও বাতাবরণে রয়ে যায় ! এইভাবে বহু মানুষের ভালো চিন্তা অর্থাৎ জনকল্যাণমূলক চিন্তার একটা Fund তৈরি হয়ে যায় , অপরপক্ষে বহু মানুষের কুচিন্তা বা জগতের পক্ষে ক্ষতিকারক চিন্তার-ও Fund থাকে । ভালো মানুষ , সৎ মানুষ _যারা জগতের জন্য ভালো কিছুই করতে চায়, তারা ঐ ভাল চিন্তার Fund থেকে সাহায্য পায় ৷ আবার সমাজের অনিষ্টচিন্তাকারীরা খারাপ চিন্তার Fund থেকে সাহায্য পায়।
উনি উদাহরণ হিসাবে বলেছিলেন – ” যেমন ধর্ , কোন এক ব্যক্তি অভাবের তাড়নায় একাই ছোটখাটো চুরি চামারি করতে শুরু করল । কিছুদিন পরেই দেখা যাবে ওর সাথে কোন সেয়ানা চোরের সাথে দেখা হয়ে যাবে – যে তাকে চুরিতে সিদ্ধহস্ত করে তুলবে ৷ হয়তো এরপর তাদের সাথে দেখা হয়ে যাবে কোন ডাকাত দলের – তারা এদেরকে দলভুক্ত করে নেবে ৷”
ওনার কথা শুনে আমরা আরও যা বুঝেছিলাম তা হোল – এইভাবে যে কোন Negative Field-এর লোকেদের ক্রমোন্নতি(ক্রম-অবনতি) ঘটতে থাকবে , যদি সে ওই কার্যে নিষ্ঠার সঙ্গে লেগে থাকে । ঠিক উল্টোটাও হয় অর্থাৎ যে সমস্ত ব্যক্তি মানব কল্যাণ এর কাজ করতে চান বা ঐ কাজ হয়তো খুব ছোট আকারে করতে শুরু করেছেন , কিছুদিন পর থেকেই দেখা যাবে – তিনি বিভিন্নভাবে সাহায্য পেতে শুরু করলেন । হয়তো দেখা যাবে, এক বা একাধিক ব্যক্তি অথবা কোন প্রতিষ্ঠান তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে! ধ্যান-জপ , সাধন-ভজন করতে শুরু করা কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে দেখা যাবে – কোন উন্নত ব্যক্তির সাথে তার সাক্ষাৎ হয়ে গেলো অথবা সে কোনো সদ্-গুরুর সন্ধান পেয়ে গেলো এবং ধীরে ধীরে তার আধ্যাত্মিক উন্নতি হতে লাগলো!
সেদিন উনি আরও বলেছিলেন যে__ যদি কেউ ঘরের কোণে , মনে মনে অথবা গভীর জঙ্গলে বা পাহাড়ের গুহায় বসে ধ্যান জপ করে , জগতের কল্যাণের নিমিত্ত চিন্তা করে – তাহলেও তার কার্যকারিতা আছে! জগতের কোন কিছুই বৃথা যায় না – সব কিছুরই কাজ রয়েছে , অন্য কিছু না হলেও কোনো একটি মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহত চিন্তা – প্রকৃতির বাতাবরণে থাকা মহত চিন্তার Fund-কে সমৃদ্ধ তো করবেই! ফলে উপযুক্ত মানুষ(সাধক) সেখান থেকে শক্তিলাভ করে জগতের কল্যাণে কাজ করতে পারবে!
উনি নিজের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন যে , উনি যে সমস্ত চিন্তা করেন বা কথা বলেন সেগুলি এখানে বসে যারা শুনছে তাদের হয়তো আপাতভাবে কোন কাজে লাগছে না (প্রকৃতপক্ষে কাজে লাগবে) । কিন্তু যেহেতু পৃথিবীর বাতাবরণে এই শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে – তাই পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে কোনো উন্নত আধার সেগুলি গ্রহণ করতে পারবে এবং দেখা যাবে যে সেই ব্যক্তির দ্বারাই জগত কল্যাণ হয়ে গেল! এখানে পরমানন্দ মিশনের কোনো ব্যক্তির দ্বারা হতেই হবে কিংবা ভারতবর্ষের কোনো সাধকের দ্বারা হতেই হবে – তার কোনো মানে নাই ! পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে কোনো ব্যক্তির দ্বারা হতে পারে ! ঈশ্বরের রাজ্যে কোনো সাম্প্রদায়িকতা , কোন partiality নাই , যে যোগ্য – সেই কাজ করবে ৷”
এরপরে উনি বলেছিলেন _”স্বামী বিবেকানন্দ একবার তাঁর শিষ্যের কাছে তাঁর কিছু মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন যে, তাঁর খুব ইচ্ছা বেলুড়ে সহস্র সহস্র মানুষের জন্য প্রচুর পরিমাণে ভাত-ডাল-তরকারি রান্না করা হবে, সবাইকে পেট পুরে খাওয়ানো হবে, যারা খাবার পরিবেশন করবে তারাও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দেবে এবং যারা খাবে তারাও খুব আনন্দ করে খাবে! একেবারে ‘দীয়তাং ভুজ্যতাং’ _হবে!! এত ভাত রান্না করা হবে যে ভাতের ফ্যান গঙ্গার জলে পড়ে জলের বেশ খানিকটা অংশ সাদা হয়ে যাবে।
কিন্তু বেলুড়মঠের কর্মকর্তারা ঠিক ঠিক এই কথার রূপদান করতে পারেন নি! ছোটবেলায় আমি ভিখারীদের সঙ্গে নিজে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিতে গিয়ে দেখেছি যে, বড়লোক বা বড় বড় লোকেদের(VIP & VVIP)জন্য আলাদা ব্যবস্থা, ভক্তদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আর গেটের বাইরের ভিখারীদের জন্য বরাদ্দ একহাতা খিচুড়ি!! এইজন্যই পরমানন্দ মিশনে উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে সবার জন্য এক খাবার! আমি যতদিন শরীরে থাকবো_ততদিন এখানে কোনো নিয়ম বা অনুশাসন হবে না _পরে হোতে পারে কিন্তু এখন হবে না!
এখানে আশ্রমের রান্নাঘরে যে খাবার তৈরি হয় _তাই ছোটবড় সকলে খায়! ঐ খাবার দিয়েই ঠাকুরের ভোগ দেওয়া হয়, ঐ খাবার আমাকেও খেতে দেয় _আমি খাই!! আশ্রমের খাবার #প্রসাদ!! প্রসাদ জ্ঞানে ঐ খাবার গ্রহণ করলে শরীর নিরোগ হবে! কিন্তু আশ্রমিকরাই তো আমার কথা মানতে পারে না, তাই কাজ হয় না! কিন্তু বাইরে থেকে যে সমস্ত ভক্তরা আসছে তাদের কাজ হয়! কারন যেহেতু তারা ঐ খাবার ‘আশ্রমের প্রসাদ’ হিসাবে খায়! এতে তাদের শরীর মনও ভালো থাকে_আধ্যাত্নিক উন্নতি ও হয়”!!
এগুলি বলার পর উনি আরও বললেন _”স্বামীজীর(বিবেকানন্দের) আর একটা ইচ্ছা ছিল যে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের এমন একটা মূর্তি হবে যেটিতে ঠাকুর সাদা রাজহংসের উপর অধিষ্ঠিত হবেন। এটাও বেলুড় মঠে হয় নি।
আমি একটু অবাক হয়েছিলাম যখন আমি প্রথম দক্ষিণ ভারতের পেরেন্টাপল্লী গেলাম আমার গুরুদেব স্বামী বাউলানন্দ(গুরুজীর দুজন গুরু ছিলেন, সন্ন্যাসগুরু স্বামী রামানন্দ এবং শিক্ষাগুরু স্বামী বাউলানন্দ)-এর আশ্রমে! পপি হিলসের ঐ দুর্গম এবং গভীর জঙ্গলের মধ্যে গুরুদেবের আশ্রমের মন্দিরের মধ্যে দেখি স্বামীজীর কল্পনার সেই মূর্তির বাস্তব রূপ!! শ্বেতশুভ্র রাজহংসের উপর অধিষ্ঠিত ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ!!! (ক্রমশঃ)