গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা বলতে গিয়ে নরওয়ে প্রসঙ্গ এসে গেল ! তাই এখন একটু ওখানকার কথা হোক ৷ নরওয়ে থেকে গুরু মহারাজের কাছে অনেক ভক্তরাই আসতো – এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন বেয়ন পিটারসন , ক্যারিয়াদা , ক্যারিয়াদার বাবা-মা (বাবার নাম ছিল হ্যান্স পিটার) , ওর বোন মেরী , ট্যুরলাইফ , কুনুথ প্রমুখ আরও অনেকে । বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন শুরু হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন আসা যাওয়া শুরু করেছিল , তাদের মধ্যে নরওয়ের লোকজনেরাও ছিল । কি করে যে অত দূরবর্তী দেশগুলির মানুষজন গুরু মহারাজের কাছে বনগ্রামের মতন একটা প্রত্যন্ত গ্রামে এসে পৌঁছে গেছিল – তা ভাবলে সত্যিই বিষ্ময়াবিষ্ট হতে যেতে হয় ! অবশ্য আমরা বহুদিন থেকে একটা কথা শুনে আসছি যে , ফুল ফুটলে তার সুগন্ধে ভ্রমর কুল কোথা থেকে এসে হাজির হয়ে যায় – তা কেউ বলতে পারে না ; এখানেও সেটাই ঘটেছিল! যাইহোক , ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে ইংল্যান্ড , জার্মানি , ফ্রান্স , সুইডেন , ইতালি এবং নরওয়ের অনেকে আশ্রমে আসতো। এইসব ভক্তদের অনেকের সাথেই সে সময় আমাদের পরিচয়ও হয়েছিল ৷ এরা ছাড়াও গুরু মহারাজ যখন প্রথমবার ইউরোপে যান, উনি বলেছিলেন – গ্রীস , যুগোস্লাভিয়া ইত্যাদি দেশের কিছু কিছু মানুষেরাও ওনার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেছিল । যুগোশ্লোভিয়ার একজন ভক্তের কথা গুরু মহারাজ বলেছিলেন যিনি স্টেশনে পুলিশের নজরদারির মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওনার কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন ৷ ওসব দেশে তখন কমিউনিজম শাসন চলছিল – তাই ধর্মীয় ব্যাপারে খুবই নিষেধাজ্ঞা ছিল – তবু ওই অবস্থায় ওই ভদ্রলোকের সাথে গুরু মহারাজের আধ্যাত্মিক ভাবে যোগাযোগ হয়েছিল । গুরু মহারাজ সেদিন আমাদের বলেছিলেন যে , “ছয়জন দিকপাল মহাশক্তিধর গুরু মহারাজের কাজের নিমিত্ত পৃথিবীতে শরীর নিয়েছিলেন , ওই ভদ্রলোক তাদের মধ্যে একজন!” ওকে দীক্ষাদানের অনেক পরে – আমরা বনগ্রাম আশ্রমে একবার ওনার কথা গুরু মহারাজকে মনে পড়ালে উনি বলেছিলেন – ” স্থূলে ওর সাথে আমার আর যোগাযোগ নেই ঠিকই , কিন্তু সূক্ষ্মে ওর সাথে আমার যোগ রয়েছে ।” জানি না _উনি ভগবানের কি কাজ করছেন__নিশ্চয়ই মানব কল্যাণের নিমিত্তে কাজ করে চলেছেন!! ওই ভদ্রলোক ছাড়াও ইতালির ফ্রান্সিসকো এবং নরওয়ের বেয়র্ন পিটারসন গুরু মহারাজের কাছে সন্ন্যাস (বা ব্রহ্মচর্য) গ্রহণ করেছিল। তখন আমরা শুনেছিলাম যে ইতালির ফ্রান্সিসকো নাকি পূর্ব জন্মে ভারতবর্ষের রাজস্থানের জয়পুর এলাকার কোন রাজা বা এই ধরণের কিছু ছিল , যার জন্য ও বনগ্রামে এলেই কিছুদিনের জন্য জয়পুরে চলে যেতো ! নরওয়ের ক্যারিয়াদা সম্বন্ধেও গুরু মহারাজ বলেছিলেন , ” পূর্ব জন্মে ও ভারতবর্ষের একজন সাধিকা ছিল ! বয়সকালে ওই সাধিকা হিমালয়ের কোন দুর্গম স্থানে বরফের রাজত্বে ধ্যান করা অবশষস্থায় শরীরপাত হয়েছিল ! সেইজন্যে এবার ওর শরীর ধারণ একেবারে তুষারের রাজত্বে – নরওয়েতে ! কিন্তু পূর্বসংস্কার এমন জিনিস যে , ঐরকম উত্তর মেরুর দেশে জন্মগ্রহণ করেও ওই মেয়েটি নিরামিষাশী ,জীবনে কখনও কোন অ্যালকোহল বা ওয়াইন গ্রহণ করে নি , ছোট থেকেই পুরুষের সঙ্গ এড়িয়ে গেছে – এই সবগুলিই ওদের দেশের আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের নিরিখে অত্যাশ্চর্য ব্যাপার ! ওখানকার Society ওর আচরণ দেখে ওকে “Crazy Girl” বলেই ডাকে ! মেয়েটি ওখানে ডাক্তারি করে (ন্যাচারোপ্যাথি , আকুপাংচার , আকুপ্রেশার ইত্যাদি) । ওর নিজের জন্য সামান্য কিছু রেখে , ওর রোজগারের সমস্ত অর্থ ও আশ্রমের জন্য পাঠিয়ে দেয় ।” গুরু মহারাজ প্রথমবার ভারত থেকে সরাসরি নরওয়েতে গিয়েছিলেন বেয়র্ন পিটারসনের সাথেই ৷ ওনার প্রথমবারের বিদেশযাত্রার ব্যাপারটাও ছিল খুবই মজার ! গুরু মহারাজের পাসপোর্ট-ভিসা তৈরি করার সময় – ওনার জন্মস্থানের(কৃষ্ণদেবপুর) গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান এর কাছ থেকে একটা Residential Certificate নিতে হয়েছিল । ঐ ভদ্রলোক ছিলেন পূর্ববঙ্গীয়, যিনি হয়তো গুরুমহারাজের জন্মের পর এদেশে এসেছিলেন, অথচ যে কোন ভাবে কৃষ্ণদেবপুর অঞ্চলের প্রধান হয়ে বসেছেন! আর উনি গুরুমহারাজকে (যিনি পুরুষানুক্রমে এদেশের বাসিন্দা) residential certificate দিয়েছিলেন!! গুরুমহারাজের জীবনে এই ধরনের মজার ঘটনা অনেকবার ঘটেছিল_যেগুলিকে ভালোভাবে পর্যালোচনা করলে হয়তো ভারতবর্ষের সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি নানান পরিস্থিতির সম্যক পরিচয় পাওয়া যায় । গুরুমহারাজের প্রচলিত শিক্ষাগত কোন certificate ছিল না _তাই প্রথমবার ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করতে যাবার আগে ইউরোপীয় ভক্তরা গুরুমহারাজকে নানারকমভাবে trained করার চেষ্টা করত। ‘এই রকম করতে হয়, ঐরকম করতে নেই’ ইত্যাদি আর কি! কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যা ঘটেছিল তা ছিল সত্যি সত্যিই miraculous!! সেই ঘটনায় আসছি। বেয়র্নের সাথে দিল্লি থেকে নরওয়ের ‘অসলো'(নরওয়ের রাজধানী)-গামী বিমানে গুরুমহারাজ উঠেছিলেন কিন্তু ঐ বিমানটি সরাসরি অসলো না গিয়ে হিথরো(লন্ডন) বিমান বন্দর অবধি ছিল। ওখান থেকে change করে অন্য বিমানে উঠতে হবে(সম্ভবত এটাকে transit বলে)। নির্দিষ্ট বিমানের ঘোষনা হতেই ওনারা গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, গুরুমহারাজ আগে _বেয়র্ন পিছনে। এইভাবে আগাতে আগাতে একটা সময়ে দেখা গেল যে বিমানটা সামনে ছিল _ওটার last passenger গুরুমহারাজ! আর পরের বিমানের first passenger বেয়র্ন! কিন্তু বেয়র্নের বিমান অনেক ঘুরে ঘুরে যাবে _ফলে ও অসলো পৌঁছাবে _গুরুমহারাজের অন্তত ৪/৫-ঘন্টা পর! ঘটনার আকস্মিকতার বিহ্বলতা কাটতে না কাটতে গুরুমহারাজের চলমান সিঁড়ি এগিয়ে চলতে শুরু করেছিল_আর বেয়র্ন অসহায় ভাবে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল। কোন কথাও হোল না _শুধু বেয়র্ন একবার হাত নাড়ল, প্রত্যুত্তরে গুরুমহারাজও যেতে যেতে একবার হাত নেড়েছিলেন! ব্যস! আর কিছু নয়! তবে এটাই শেষ নয়, সমস্যা আরও ছিল _হয়েছিল কি গুরুমহারাজের কাছে ছিল বেয়র্নের হাল্কা ব্যাগ এবং গুরুমহারাজের ভারী ব্যাগটি (গুরুমহারাজ প্রায় এক বছরের জন্য ইউরোপ গিয়েছিলেন, ফলে অনেক মালপত্র ছিল)ছিল বেয়র্নের কাছে, যার মধ্যে ওনার পাসপোর্ট – ভিসা সমেত সমস্ত কাগজপত্রও ছিল! প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে একে তো চেকিং ব্যবস্থা খুবই উন্নত, তাতে গুরুমহারাজ একেবারে বিদেশ যাত্রায় নতুন – আনকোরা! যে দেশে (নরওয়ে) যাচ্ছেন _সে দেশের ভাষাও জানেন না (যদিও নরওয়েজিয়ান ছাড়াও ইংরেজী ভাষাটা ওখানকার শিক্ষিত মানুষেরা বোঝে।) _তাই পুরো ব্যাপারটা বেয়র্নের কাছে ছিল খুবই ভয়ের, খুবই উদ্বিগ্নতার!! তখন মোবাইল ফোন ও ছিল না _তবু বেয়র্ন হয়তো চেষ্টা করেছিল কিন্তু কোন কার্যকরী হয় নি! ও ভীষণ চিন্তা করছিল _বাড়িতে ওর বৃদ্ধ পিতা মাতা, তারাও গুরুমহারাজ আসবেন বলে অপেক্ষা করে আছে, ওখানকার অন্যান্য ভক্তরা অপেক্ষা করে আছে __যদি গুরুমহারাজের কোন অসুবিধা হয়, তাহলে তাদের সবার কাছে এবং গুরুমহারাজের কাছে বেয়র্ন অপরাধী হয়ে যাবে _এই সব সাত-পাঁচ চিন্তা করে বেয়র্নের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল!! (ক্রমশঃ) [আগামী সংখ্যায় গুরুমহারাজের কি হোল!!]