গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ নরওয়ে গিয়েছিলেন ১৯৮৯-৯০ সালে । উনি প্রথমেই গিয়ে উঠেছিলেন বেয়র্নের বাড়িতে ৷ ওখান থেকে উনি বেয়র্নের সঙ্গে ‘আলদালে'(একটি শহর) অবস্থিত আনন্দ আচারিয়া-র প্রতিষ্ঠিত আশ্রমে গিয়েছিলেন । আনন্দ আচারিয়ার ওই দেশে তেমন কোনো উত্তরসূরী ছিল না , হয়তো কিছু মানুষ ওনার দীক্ষিত শিষ্য ছিল বা অনুগামীরাও ছিল – কিন্তু ওদের দেশে এইরকম কোন আইন নাই যে গুরুর সম্পত্তিতে শিষ্যরা অধিকার পাবে । ফলে আনন্দ আচারিয়ার প্রতিষ্ঠিত আশ্রমটির মালিকানা নিয়ে ওখানকার সরকারী দপ্তরও খুব Confused ছিল ! এমতাবস্থায় বেয়র্নের সাথে এবং ওখানকার অন্যান্য ভক্তদের সাথে আলোচনা করে গুরু মহারাজ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তাহলে ওই স্থানেই Peace Univereity -র কাজ শুরু করা হবে ৷ এরপর বেয়র্ন চেষ্টা চরিত্র করে Municipality(!)-র কাছে দাবি জানাতেই ওরা ঐ স্থানটির মালিকানা ওদেরকে দিয়ে দেয় ! এই ভাবেই আনন্দ আচারিয়া-র প্রতিষ্ঠিত স্থানে-ই আজকের পরমানন্দ মিশনের শাখা “শান্তিবু আশ্রম” গড়ে উঠেছে ৷ ওখানে আশ্রমে ঢুকতেই আনন্দ আচারিয়ার একটি আবক্ষ পাথরের মূর্তি আজও রয়েছে !
গুরু মহারাজের কাছে আমরা নরওয়ের ভক্তদের মধ্যে ক্যারিয়াদা এবং ওর পরিবারের কথা খুব শুনেছিলাম , তাছাড়া উনি পরমানন্দ ভক্ত টুরলাইফের কথাও খুব বলতেন ৷ খুব সম্ভবত ওনার স্ত্রীর নাম “আন্নাশ্রী” । ওদের তিন চারটি ছেলে মেয়ে ৷ নরওয়ে দেশটিতে জনসংখ্যা খুবই কম – গোটা দেশের জনসংখ্যা সম্ভবত ৭০/৮০ লক্ষ । আমাদের ভারতবর্ষের নিরিখে এই সংখ্যাটা এতই নগণ্য যে এখানকার মানুষ _’একটা সমগ্র দেশের জনসংখ্যা যে এত কম হতে পারে’ – তা ভাবতেই পারবে না ! এখানে যে কোন একটি বড় শহরের জনসংখ্যাই ৭০/৮০ লক্ষ বা তারও অনেক বেশি । কলকাতা শহরেই লোকসংখ্যা এর সমান বা বেশিও হতে পারে ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ইউরোপের এই দেশটি অর্থনৈতিক ভাবে এতোটা উন্নত এইজন্যই অর্থাৎ লোকসংখ্যা এতো কম হওয়ার জন্য ! উনি বলেছিলেন – “ভারতবর্ষকে যদি খনিজ তেল কিনতে না হয় – তাহলেই ভারতবর্ষ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে যাবে! ভারতবর্ষে ১০০ কোটি বা তারও বেশি মানুষ যদি রাত্রে শুধুমাত্র লম্ফ বা হ্যারিকেন জ্বালায় – তাহলে যত গ্যালন তেল পুড়বে , U.S.A.-এর লোকেরা গাড়ি চালালেও তার থেকে বেশি তেল পোড়াতে পারবে না ৷”
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ওদের দেশের লোক সংখ্যা কম বলেই কোনো দম্পতির যদি দুটির বেশি সন্তান হয় , তাহলে তারা সরকারের কাছে পুরস্কার পায় ! সেই জন্য আন্নাশ্রী (যেহেতু ওর ৩/৪ টি ছেলে মেয়ে) সরকারের কাছ থেকে অনেক টাকা পুরস্কার পেয়েছিল । ওখানে(নরওয়েতে) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমিক হিসাবে কিছু মুসলমান তৃতীয় বিশ্ব থেকে গিয়েছিল ।একমাত্র ওদের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে – এটাই এখন ওদের দেশের সমস্যা ৷ কারণ জনসংখ্যা একটা certain limit-এ পৌঁছালে ওরা দেশীয় নাগরিকদের ন্যায় সুযোগ সুবিধা চাইতে পারে _এটা বর্তমানে নর‌ওয়ে গভর্নমেন্টের একটা অন্যতম জ্বলন্ত সমস্যা!
যাইহোক, গুরু মহারাজ নরওয়ে সম্বন্ধে আরও বলেছিলেন – ” এই দেশটিতে মাছ এবং তেল-ই অর্থনীতির মূল উৎস! দেশটিতে চাষ-আবাদ তেমন খুব একটা বেশি হয় না – ২/৩ মাস বাদে সমস্ত বছর ধরেই তো বরফাচ্ছন্ন , শীতকালের তাপমাত্রা মাইনাস ৩০/৪০ ডিগ্রী পর্যন্ত হয়ে যায় ৷ তাছাড়া ওখানে ছয় মাস দিন , ছয় মাস রাত , ছয় মাস রাত চলাকালীন আকাশে একটা আলোর আভা থাকে – আমাদের এখানকার পূর্ণিমার আলোর থেকে একটু বেশি । এইজন্যেই এই দেশটিকে ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’- বলা হয় । এই আলোয় মানুষজন রাস্তায় বেরোয় , লোকে কাজকর্ম করতে পারে – কোন অসুবিধা হয় না । ওখানে ছমাস দিন চলাকালীন কোন সময়েই আলো বন্ধ হয় না ! সুতরাং তখন দিন-রাত্রির হিসাব হয় ঘড়ি দেখে ! গুরু মহারাজ যেদিন প্রথম নরওয়েতে(উনি প্রথমবার গিয়েছিলেন ছমাস দিন চলাকালীন সময়ে) বেয়র্নের বাড়ি গিয়েছিলেন , তখন ছিল দুপুরবেলা । বেয়নের বাবা-মা গুরু মহারাজের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটিতে ওনার থাকার সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়ে – ওনাকে জামা কাপড় ছেড়ে fresh হয়ে নিতে বলেছিলেন । গুরু মহারাজ যখন fresh হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন – তখন ওনারা Tea-Table -এ গুরু মহারাজের জন্য কফি এবং অল্প স্নাক্স-এর ব্যবস্থা রেখেছিলেন ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লাঞ্চ! লাঞ্চটেবিলে বেয়র্নের বাবা-মার সাথে গুরুজীর ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। এরপর ওনারা গুরুমহারাজকে দুপুরের বিশ্রাম নেবার জন্য ‘বাই’ _জানিয়ে নিজেরাও বিশ্রামের জন্য ঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন। এদিকে বেয়র্ন বিমানবন্দরের সমস্ত ফর্মালিটি চুকিয়ে চিন্তায় ভাবনায় ক্লান্তিতে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত হয়ে ৪/৫-ঘন্টা পর যখন এসে পৌঁছাল তখন গুরুমহারাজের ২/৩-ঘন্টা বিশ্রাম নেওয়া হয়ে গেছে! বেয়র্ন গুরুমহারাজকে ওর বাড়িতে দেখে নিশ্চিন্ত এবং আশ্বস্ত তো হয়েছিলই, খুব আশ্চর্যান্বিতও হয়েছিল! ও গুরুমহারাজকে পরে বলেছিল _”আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল যে _তুমি আর কেউ নও, তুমি স্বয়ং স্বামী পরমানন্দ! আমার এতটা উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত হয় নি!”
যাইহোক, এরপর বেয়র্নের বাবা মা-ও বাইরে এসে ওঁদের উভয়কেই” good evening “_জানালেন! এইটাতে গুরুমহারাজ যথেষ্ট ঘাবড়ে গেছিলেন _কারন বাইরে তখন তো ফটফটে আলো! বেয়র্ন গুরুমহারাজের একটু অবাক চোখের চাউনি দেখেই ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিল এবং গুরুমহারাজকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে _ছমাস দিন চলাকালীন নরওয়ের মানুষজন ঘড়ি দেখে দুপুর বা রাত্রি নির্ধারন করে নেয়! (ক্রমশঃ)