গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ যখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরছিলেন তখনকার কথা বলা হচ্ছিল ! প্রথমটায় সময়ের ‘ক্রম’ বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলাম – পরে সব গোলমাল হয়ে গেছে – যখন যেটা মনে পড়ছে সেটাই আপনাদের সাথে শেয়ার করছি ! আশা করি পাঠকবর্গ কিছু মনে করবেন না !
আগের দিন বলেছিলাম , ইতালির ‘কারারা’ শহরে গুরুমহারাজকে হঠাৎ করে যে একটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছিল – সেই ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হবে ! এখন সেটার চেষ্টা করা যাক্ ৷ গুরু মহারাজ হাসতে হাসতে পুরো ব্যাপারটা বর্ণনা করেছিলেন , কিন্তু ঘটনা শুনতে শুনতে আমাদের হাড় হিম হয়ে যাবার জোগাড় ! ভাগ্যিস উনি স্বামী পরমানন্দ ! ভাগ্যিস জগতের যা কিছু সবই ওনার করতলগত – তাইতো সেদিন উনি ঐ ডাকাবুকো ছেলেটার করা challenge accept করেছিলেন এবং সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন !
ওই ছেলেটির নাম ছিল মার্কো । গুরু মহারাজ ঘটনাটা যখন আমাদেরকে বলেছিলেন – তখন উনি এটাও বলেছিলেন – ” কিছুদিনের মধ্যেই দেখবি ছেলেটি India-য় আসবে , যখন ও বনগ্রাম আশ্রমেও আসবে _দেখবি ওর কেমন সুন্দর সুঠাম ছেহারা ! সত্যিই দেখেছিলাম – ওই ছেলেটি অর্থাৎ মার্কো ওর গার্লফ্রেন্ড ‘এমেনা’-কে নিয়ে বনগ্রামে এসেছিল । সত্যিই মার্কোর শরীরের গড়ন দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় ! স্থূলভাবে পুরুষসিংহ বলতে যা বোঝায় – ঠিক তাই ! সাড়ে ছ-ফুটের কাছাকাছি লম্বা , সরু কোমড় আর বিশাল বক্ষ ! হাত এবং পায়ের muscle একদম ব্যায়ামবিদদের মতো! তবে মজার ব্যাপার হলো – ওর সঙ্গীনী এমেনা ছিল খুবই বেঁটে । বলা যায় একেবারে বেমানান জুটি – অন্ততঃ বাইরের দৃষ্টিতে দেখতে তাই লেগেছিল !
যাইহোক, এবার ওখানকার কথায় আসি ! সেদিন আচমকা মার্কো গুরু .মহারাজকে challange করে বসায় ওখানকার (গুরুমহারাজের) ভক্তরা (ইলারিও , আলেক্স , ক্লাউডিও প্রমুখরা) একেবারে হই হই করে উঠেছিল ! ওরা গুরু মহারাজকে বলেছিল – ছেলেটি ওখানকার একজন মার্শাল আর্টে ব্ল্যাকবেল্ট , ওর সাথে যেন গুরুমহারাজ লড়াই-এর challange টা Accept না করে ! কিন্তু গুরু মহারাজ পরনের গেরুয়া কাপড়টা একটু সামলে নিয়েই _যে অবস্থায় ছিলেন , সেই অবস্থাতেই উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন ! গুরু মহারাজ মার্শাল আর্ট প্রয়োগের সময় ওনার পরনের গেরুয়া কাপড়টা গুটিয়ে নিতেন না শুধু কোমরের কাপড়ের বাঁধনটা একটু শক্ত করে নিতেন – এটা আমরা দেখেছি । উনি একদিন আমাদের আশ্রমের এক ভক্তকে ক্যারাটের প্যাঁচ শেখাচ্ছিলেন – তখন সেই ভক্ত বলেছিল – ” গুরু মহারাজ আপনি আপনার পরনের গেরুয়া কাপড়টা বাগিয়ে পড়ুন না হলে যে আপনার Movement frequent হবে না।”
উনি বলেছিলেন – ” প্রাচীন ভারতবর্ষের সমরবিদ্যার এটাই সঠিক পোশাক । দেখবে বিভিন্ন প্রাচীন মন্দিরের গায়ে যে সমস্ত যোদ্ধার মূর্তি বা রাজন্যবর্গের মূর্তির খোদাই বা স্থাপত্য রয়েছে – সেখানে তারা বিভিন্ন কৌশলে ধুতি-ই পড়ে রয়েছে ! হয়তো ধুতিটা পায়ের সাথে পেঁচিয়ে পড়েছে , অথবা মালকোঁচা মেরে পড়েছে ৷ তবে বৌদ্ধ শ্রমণরা যেভাবে গৈরিক ধুতি খানিকটা লুঙ্গির মতো পড়ত – সেভাবেই। এখনো দশনামী সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ সাধুরাই কাপড় পড়ে – আমিও পড়ে রয়েছি । এটাই সবচাইতে Comfortable পোশাক । এই বস্ত্র তো মাঝখানে লুঙ্গির মতো সেলাই করা নেই – মাঝখানটা কাটা – ফলে পা দুটো যতদূর সম্ভব Stretch করতে পারা যায় । আমি এই অবস্থায় অনায়াসে তোমার মুখে Kick করতে পারবো !”গুরুমহারাজের কথা শুনে ঐ ভক্ত একেবারে চুপ মেরে গিয়েছিল!!!
সুতরাং ইতালির ঐ আসরেও গুরুমহারাজকে পোষাক পরিবর্তন করতে হয়নি! উনি যে অবস্থায় কথা বলছিলেন, সেই অবস্থাতেই ready হয়ে যান! এরপর মার্কো(যেহেতু ছেলেটি তখনও গুরুমহারাজকে চিনতই না _দীক্ষা নেওয়া তো দূর-অস্ত!) গুরুমহারাজকে পায়ের সাহায্যে kick এবং হাতের সাহায্যে hit করতে শুরু করল! গুরুমহারাজ সেগুলিকে বিশেষ কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন! গুরুমহারাজ আমাদের বলেছিলেন যে _ওকে উনি তিনটে hit করার সুযোগ দিয়েছিলেন _ও মার্শাল আর্টে ‘ব্লাক বেল্ট’ হওয়া সত্ত্বেও একটাতেও successfull হয় নি! এরপর গুরুমহারাজ যখন ওকে অদ্ভুত কৌশলে কাবু করে ফেলেন _তখন ও surrender করে নিয়েছিল!
ঐ ঘটনার পর সেদিন ওখানে আবার সিটিং হয়েছিল! সিটিং-এর শেষে মার্কো গুরুমহারাজের সাথে আলাদা করে কথা বলেছিল এবং ও জানতে চেয়েছিল __ও যে দীর্ঘদিন অভ্যাস, অধ্যাবসায় দিয়ে ক্যারাটে শিখেছে এবং তার ফল হিসাবে ‘ব্লাক বেল্ট’ পেয়েছে, কিন্তু তবু, ও ওর থেকে শারীরিকভাবে দূর্বল একজন ইন্ডিয়ান সাধুর কাছে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে পরাস্ত হয়ে গেল কেন? গুরুমহারাজ ওকে বলেছিলেন _যেহেতু তিনি “তাই চি” জানেন, সেইজন্য অন্যান্য মার্শাল আর্ট জানা লোক তাঁকে hit করতে পারে না।
তখন মার্কো ‘তাই-চি’ সম্পর্কে জানতে চাইলে উনি বলেছিলেন _”তাই- চি”_ হোল সমস্ত মার্শাল আর্টের মধ্যে শ্রেষ্ঠ! ‘তাই’_মানে ‘বাউল’, আর ‘চি’_মানে হচ্ছে পথ! সেই অর্থে” তাই-চি” কথায় অর্থ “বাউল পথ”! বহু পূর্বে ভারতবর্ষের সাধু-সন্তরা এই কৌশল সৃষ্টি করেছিলেন। এর মাধ্যমে যোগাভ্যাসও হয়ে যায় আবার আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ কৌশলও বটে।! এই বিদ্যা দীর্ঘদিন ধরে সাধুপরম্পরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল _কারণ এটি শিখতে দীর্ঘ অনুশীলন ছাড়াও শরীরে ব্রহ্মচর্য রক্ষার প্রয়োজন হয়। পরবর্তীতে এটি বৌদ্ধ সাধুদের দ্বারা চীন, জাপান, কোরিয়া ইত্যাদি দেশে যায় এবং সেখান থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
উনি বলেছিলেন _অন্যান্য মার্শাল আর্ট-এ শরীরের পেশীগুলিকে ইস্পাত কঠিন শক্ত করতে হয় _কিন্তু “তাই চি” – তে পেশী গুলোকে তুলোর মতো নরম করতে হয়! একটা তুলোকে টাঙিয়ে তাতে তরোয়াল চালালে যেমন তুলো কাটবে না _বরং তরোয়ালের গতির দিকেই খানিকটা চলে যাবে! এরপর একটা point-এ পৌঁছে ঐ তরোয়ালটি for the time being স্থির হয়ে যাবে। তখনই ঐ তুলোর রাশি পেঁচিয়ে তরোয়ালকে অকেজো করে দেওয়া খুব সহজ হয়ে যাবে! এইটাই `তাই-চি`_র রহস্য! যে কোন আঘাতকে সহজে গ্রহন করে নেওয়া যায় _তাতে সেই আঘাত যত তীক্ষ্ণ বা তীব্র-ই হোক না কেন!!
উদাহরণ হিসেবে গুরুমহারাজ উল্লেখ করেছিলেন _মহাভারতের যুদ্ধের কথা! সেখানে দেখা যায় _মহাবীর ভীষ্ম যুদ্ধ করতে করতে প্রতিপক্ষের ছোঁড়া তীর দাঁতে করে ধরে ফেলছেন! আধুনিককালের একজন বিখ্যাত মার্শাল আর্ট-এর লোক “ব্রুস-লি” বৌদ্ধ গুরুদের কাছে এই বিদ্যা কিছুটা রপ্ত করেছিল! কিন্তু ঐ টা show করতে গিয়ে গুরুকুলের রোষে পরে অকালে মারা গেল!
যাইহোক, মার্কো তার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছিল এবং গুরুমহারাজের কাছে দীক্ষা গ্রহন করেছিল। এরপর ওখানে গুরুমহারাজের কাছে “তাই-চি” শেখার জন্য ভক্তরা সকলে ভীষণ আগ্রহী হয়ে উঠেছিল _গুরুমহারাজ ওদেরকে কিছু কিছু practice শিখিয়েও দিয়েছিলেন।
এই কদিন আগে আদিত্যপুর আশ্রমে(বোলপুর) তৃপ্তি মা এবং স্পেনের Sirgi(উচ্চারণে সারজি) “তাই চি” র কিছু movement আমাদেরকে show করে দিয়েছিলেন! ওনারা দুজনে গুরুমহারাজের কাছেই ‘তাই-চি’ শিখেছিলেন।(ক্রমশঃ)