গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে সিটিং-এ মানবের এবং মানব সমাজের বিবর্তনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস আলোচনা করেছিলেন। উনি যে সমস্ত কথা বলতেন, যে আঙ্গিক থেকে কথাগুলো বলতেন এবং যে অদ্ভুত কায়দায় ওনার সামনে বসে থাকা আমাদের মতো মানুষগুলোকে সময়ের উজান পথ বেয়ে নিয়ে গিয়ে একেবারে সেই সুদূর অতীতে এনে ফেলতেন সেটা ছিল অনন্যসাধারন ! যেখান থেকে আমরা স্পষ্ট দেখতে পেতাম কতকগুলো কালো কালো উলঙ্গ নর-নারী বন জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে ,অন্য আর একটা গোষ্ঠীর সদস্য দের সঙ্গে অথবা পশুদের সঙ্গে খাদ্যের জন্য – বাসস্থানের জন্য সবসময় লড়াই করছে,কখনও হারছে _কখনও জয়লাভ করছে ! এছাড়াও আমরা মানসচক্ষে স্পষ্ট দেখতে পেতাম তারা তাদের অসহায় অবস্থা থেকে কিভাবে উন্নত অবস্থায় যাওয়া যায় তার আপ্রান প্রচেষ্টা করছে।গুরু মহারাজের এই যে বিশেষ অনন্য আঙ্গিক _ কথার মাধ্যমে সুদূর অতীতে সকলকে নিয়ে চলে যাওয়া বা সেই ঘটনাকে চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করানো_এইটা ছিল ওনার সিটিং-এ বসে থাকা মানুষগুলোর বিশেষ পাওয়া!!
আদিম মানব সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠী ছিল এবং একটা দলের সাথে অন্য একটা দলের দেখা হলেই তাদের মধ্যে মারামারি বা লড়াই শুরু হয়ে যেতো’। এই লড়াই ছিল– এলাকা দখলের লড়াই (বাসস্থান ও খাদ্যের অপ্রতুলতার জন্য) এবং নারীর জন্য লড়াই! নারীর জন্য লড়াই কেন – কারণ কোনো দলে নারী বেশি থাকলে বেশি সংখ্যক সন্তান উৎপাদন হবে এবং তাহলেই সেই দলটি সংখ্যায় বৃদ্ধি প্রাপ্ত হবে এবং দলটি শক্তিশালী হবে! আর এইরকম শক্তিশালী দল তৈরি করতে পারলে– দুর্বল দলের সভ্যদেরকে পরাজিত করে তাদের নিজের দলে আনা সহজ হবে ! এইসব ভাবনাই ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে হতে – আজকের বৃহৎ রাষ্ট্র – ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ,শক্তিশালী রাষ্ট্র _দুর্বল রাষ্ট্রের রূপ পেয়েছে ।
গুরু মহারাজ বলেছিলেন প্রথমে ভ্রাম্যমান(বোহেমিয়ান )জীবন ছিল আদি মানব গোষ্ঠীর । অনেক পরে ঐসব গোষ্ঠীর মানবের মস্তিষ্ক উন্নত হতে শুরু করেছিল [এ ব্যাপারে উনি বলেছিলেন horizental অবস্থা (পশু অবস্থা) থেকে যখনই vertical (হোমো স্যাপিয়েন ব্য মানব) হোল জীব, তখন থেকেই তাদের মস্তিস্ক উন্নত হোতে শুরু করেছিল ।] ফলে অনেক রকম উন্নত ভাবনা চিন্তাও তাদের মনোজগতে দেখা দিতে শুরু করেছিল | এর মধ্যে একটি হল স্থিতিশীল হওয়া! নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে না বেরিয়ে এক জায়গায় স্থিতু হওয়া !
আমরা গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের কাছে শুনেছিলাম যে – এই যে এক জায়গায় স্থিতু হতে তারা চাইল, সেখান থেকেই সমাজব্যবস্থার শুরু! তখন থেকেই বিভিন্ন রকম আবিষ্কার, কৃষিকার্য সহ সমস্ত রকম উন্নতির বা সভ্যতার বিকাশের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল । কারন কেন্দ্রে যেতে হোলে সারফেসে না ঘুরে বেড়িয়ে একবার এক জায়গায় স্থির হোতেই হয়!
তবে সেই আদিম অবস্থাতেই সব জনগোষ্ঠী কিন্তু স্থিতু হবার প্রবণতা দেখায়নি ! একদল বোহেমিয়ান জীবন বা যাযাবর বৃত্তি-ই অবলম্বন করে বসে রইল এবং অন্য দলটি স্থানে স্থানে জনবসতি স্থাপন করলো । যারা স্থিতু হতে চাইলো না –তাদের যুক্তি ছিল যে, কোন এক স্থানে বেশিদিন বসবাস করার অর্থই হলো — সেখানকার প্রাকৃতিক খাদ্য শেষ হয়ে যাওয়া বা অন্ততঃ কমে যাওয়া _তাই তারা চলমান জীবনকেই বেছে নিল। কৃষিজীবী গোষ্ঠীর চিন্তাবিদ সদস্যরা এই সমস্যা দূর করতে শুরু করেছিল বৃক্ষরোপণ (ফলের গাছ) এবং কৃষিকার্য ! যে সমস্ত শষ্য, ফুল, ফল, পাতা __পশু বা পাখিরা খায়, সেগুলোকেই তারা খাদ্য হিসাবে মেনে নিয়েছিল ৷ এদের মধ্যে যেগুলি স্বাদু বা তাদের শরীর ধারণের উপযোগী সেইগুলির বীজ জমা করে রেখে তারা তাদের বসতি-র চারিপাশে পুঁতে দিতে শুরু করল – এই ভাবেই শুরু হয়ে গেল চাষবাস !
এইবার ধীরে ধীরে কোন্‌ গাছ বা কোন্‌ ফসল কেমন মাটিতে জন্মায়, কার কতটা জলের প্রয়োজন – সেইসব দেখে বা বিচার করে ধীরে ধীরে কৃষিকার্যের উন্নতিলাভ হতে থাকলো – যার পরিণতি আজকের আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা ।
গুরু মহারাজ বলেছিলেন, প্রথম কোন নতুন খাদ্য (তা কোনো ফলই হোক বা কোন পশু-পাখির মাংস, মাছ বা কোন জলজ প্রাণীর মাংস ইত্যাদি) কোন গোষ্ঠীর সদস্য যখন পেতো – তখন সে ওই দলের দলপতির কাছে নিয়ে আসতো ! দলপতি সেই খাদ্যটি গোষ্ঠীর সবচাইতে ‘বয়োঃবৃদ্ধ বা বৃদ্ধা’-কে ওই খাবারটি খেতে দিতো । যদি খাবারটি খেয়ে কোনরকম বিষক্রিয়া বা অবগুণ হোত তাহলে সেটি নিষিদ্ধ হোত – অন্যথায় সেই খাদ্যটি গ্রহণ করা হতো ৷ এইভাবে-ই প্রতিটি খাদ্যকে বয়স্কদের দিয়ে টেস্ট করিয়ে নিয়ে – সকল সদস্যদের খাওয়ানো হতো ।
আদিম মানব সমাজে পঙ্গু বা বিকলাঙ্গ সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাদেরকে সাথে সাথেই মেরে ফেলা হতো ৷ কারণ দলের বোঝা বাড়ানো মানেই সামগ্রিকভাবে দলটির বিপদ ডেকে আনা ! সতত সংগ্রামশীল জীবনে তারুণ্যের প্রয়োজন, গতির প্রয়োজন, শক্তির প্রয়োজন – অপরের সাহায্যে বেঁচে থাকা কোন সদস্যকে রেখে কি লাভ ! তাই এই কাজ করা হোত!
গুরু মহারাজ আরও বলেছিলেন – আদিম মানব গোষ্ঠীর সদস্যরা পরবর্তীকালে যখন তীর-ধনুক, বল্লম-বর্শা ইত্যাদি অস্ত্রের প্রয়োগ শিখেছিল, তখন তীর বা বল্লমের ডগায় তীব্র বিষ মাখিয়ে রাখা হোত – যাতে হাতি, বাঘ, ভাল্লুক, সিংহের মত শক্তিশালী হিংস্র প্রাণীদের সহজেই কাবু করা যায় । এই তীব্র বিষ তৈরি করা হতো সাপ, কাঁকড়াবিছা ইত্যাদি বিষধর সরীসৃপ বা অন্যান্য প্রাণী থেকে এবং হেমলক জাতীয় বিষাক্ত লতাগুল্ম ,ফুল বা ফলের রস এবং বিভিন্ন বিষাক্ত খনিজ পদার্থ (আর্সেনিক জাতীয়) -এর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ৷ এতকিছু সাংঘাতিক সাংঘাতিক– সমস্ত ধরনের বিষ-কে একত্রিত করে ফুটিয়ে ঘন করে রাখা হতো ! এই মিশ্রণটি এত বেশি মারাত্মক বিষাক্ত পদার্থ ছিল যে, যদি কোনো বড় জন্তু-র শরীরে ওই বিষমাখা তীরের ফলা সম্পূর্ণ না ঢুকে শুধুমাত্র একটু আঁচড়ও কাটত,তাহলেও ঐ জন্তুটি মারা পড়তো ! এই ধরনের তীব্র বিষ তৈরির ভার দেওয়া হতো ওই দলের বয়স্ক বা বয়স্কা সদস্যদেরকেই ৷ একেবারে ওই ধরনের বিষ অনেকটা পরিমাণে তৈরি করা হতো, যাতে ঐ বিষে তাদের ১/২ বছর চলে যায় ৷ কিন্তু দুঃখের ব্যাপার ছিল এটাই যে, বিষ তৈরি শেষ হওয়ার পরেই ওই বয়স্ক বা বয়স্কা সদস্যটি মারা যেত !
যাইহোক, আমরা একটা আলোচনা করতে করতে সেটা থেকে বেরিয়ে চলে আসছি – তাই আবার সেখানেই ফিরে যাই । আমরা আলোচনা করন্থিলাম দুটি পৃথক পৃথক মানসিকতা বিশিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষের কথা ! একদল পছন্দসই কোনো স্থান দেখে সেখানে থিতু হতে চাইল এবং অপরদল কোন নির্দিষ্ট স্থানে নিজেদেরকে আটকে না রেখে সারা বছর ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগলো ৷ যারা ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করত – তারা সঙ্গে করেই বিভিন্ন গৃহপালিত পশু গরু, ছাগল. ভেড়া ইত্যাদি সঙ্গে করে নিয়ে বেড়াতো| এগুলিকে সঙ্গে রাখা বা পালন করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সুরক্ষা(কুকুরেরা সুরক্ষা দিতো) যানবাহনের প্রয়োজনীয়তা(গরু,ঘোড়া,গাধা) এবং খাদ্যের যোগান(ছাগল, ভেড়া, গরুর দুধ এবং মাংস) । এইভাবে সেই আদিম যুগ থেকেই মানুষ দুটি পৃথক জনগোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে গিয়েছিল – একটি পশুপালক গোষ্ঠী এবং অপরটি কৃষিজীবী গোষ্ঠী ৷
কৃষিজীবী গোষ্ঠীরা যেহেতু একটা স্থানে থেকে গেল – তাই তারা কৃষিকার্যের সাথে সাথে বিভিন্ন জিনিসের আবিষ্কার, নিজেদেরকে সবদিক থেকে সুরক্ষা দানের ব্যবস্থা ইত্যাদি করতে পারলো (কারন স্থির, শান্ত, অবিচল না হলে মানুষ ধ্যান করতে পারে না; আর মনকে concentrate না করতে পারলে মস্তিস্ক কোষের উন্নতি ঘটে না)এই দলেরই কিছু কিছু সদস্য মহাপ্রকৃতির নানান রহস্য নিয়ে অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয় কেন হয় , সেগুলির ফল কি, সেগুলি থেকে পরিত্রাণের উপায় কি – এইগুলি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে শুরু করলো ৷ অবসর সময়ে তারা অবাক হয়ে চেয়ে রইতো বিশাল আকাশের দিকে ৷ তারা দেখতো সমুদ্রের বিশালতা, বিরাট বিরাট পর্বতের গাম্ভীর্য আর দেখতো দিগন্ত বিস্তৃত উদার আকাশ ! যে আকাশে ক্ষনে ক্ষনে রং বদলায় ,যে আকাশে মাঝে মাঝে মেঘের এবং বিদ্যুতের সঞ্চার হয় , অঝোরে বৃষ্টি নামে_ব্জ্রপাতের ফলে বনে দাবানল সৃষ্টি হয়.. !![ক্রমশঃ]
(এই আলোচনাটি এখন চলতে থাকবে ।)