গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ মানবের সমাজ বিবর্তনের যে ইতিহাস তখন সিটিংয়ে (বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন-এ) বলতেন – তারই কিছু কিছু অংশ এখানে পরিবেশন করা হচ্ছিল । হুবহু গুরুমহারাজ যেমনটি বলেছিলেন ঠিক সেভাবে এখানে পরিবেশন করা হচ্ছে না । ওনার বলা সরাসরি কিছু কথা তো নিশ্চয়ই থাকছে, তবে বেশিরভাগটাই ওনার কথা শুনে তখন আমরা যেমনটা বুঝেছিলাম – সেইগুলি পরিবেশন করা হচ্ছে ৷ ফলে এই আলোচনায় যদি কিছু অপূর্ণতা বা ক্রটি থেকে থাকে – সেটা নিতান্তই আমাদের বোঝার ভুলে হয়েছে – বলেই বিবেচিত হবে । গুরুমহারাজ ছিলেন পূর্ণ, স্বয়ং পূর্ণব্রহ্ম নারায়ন – তিনি আমাদের মতো বৈখরী থেকে কথা বলতেন না – তিনি পশ্যন্তি, মধ্যমা-র ও পারে__ ‘পরা’ স্থিতি থেকে কথা বলতেন ! তাই তাঁর বলা যে কোন কথা, তা আপাতভাবে হয়তো অনেক সময় মনে হতো – “এটা বোধহয় উনি ঠিক বলছেন না”, কিন্তু পরে দেখা যেতো – ওনার কথাটাই ঠিক, আমাদের শেখাটাই ভুল ছিল ৷
এই কথাগুলো লিখতে লিখতে হটাৎ করে আমার একটা পুরোনো গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে – বহুদিন আগের কথা, আমাদের এক পরিচিত (নাম প্রকাশে অসুবিধা থাকায় তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না) বন্ধু ভদ্রলোক (তখন কম বয়স), তার ছোট থেকেই কি জানি কেন_ বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে ‘disturb’ কথাটার উচ্চারণ “ডিস্টাপ্” ! (ইংরেজির অনেক উচ্চারণ এইরকমভাবে আমরাও এমনকি উচ্চ উচ্চশিক্ষিতেরাও অনেক সময় ভুল বলে থাকি ! অথচ মনে করি ঠিকই বলছি !)। এইবার কোনো একদিন তিনি বারবার ‘ডিস্টাপ্’ – ‘ডিস্টাপ্’ – কথাটি বলায় পাশের অন্য এক বন্ধু তাকে সংশোধন করার চেষ্টা করেন, – বলেন – ” দ্যাখো ! কথাটা ‘ডিস্টার্ব’ হবে ‘ডিস্টাপ্’ নয় ।” তিনি কোন কথা শুনবেন না – গোঁ ধরে বসে রয়েছেন, মুখে বলছেন – ‘ আমি ছোটবেলা থেকে জানি, কথাটা ‘ডিস্টাপ্’ ! তোরা বললেই মেনে নেবো !’ তখন একজন ইংরেজি থেকে বাংলা ডিকশনারী নিয়ে এসে ওনার সামনে মেলে ধরে দেখালো এবং বলল – ” এই দ্যাখো, disturb – ডিস্টার্ব কথাটার অর্থ বিরক্ত করা – ইত্যাদি ! তখন ওই বন্ধু ভদ্রলোক ভালো করে অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করার পর, ডিকশনারি থেকে চোখ তুলে ঘোষণা করল – “আমি ঠিকই বলেছি,ডিকশনারিতেই ভুল রয়েছে !”
আমরা প্রায় প্রত্যেকেই তো _’ওই ভদ্রলোক’ ! আমরা সকলেই ভাবি – আমরা যেটা জানি, আমরা যেটা বুঝি সেটাই ঠিক আর অপরেরটা ভুল ! কিন্তু গুরু মহারাজের কাছে গিয়ে আমাদের এই ভুলের স্বর্গ ভেঙে গিয়েছিল ! আমরা বেশ ভালোমতনই বুঝতে পেরেছিলাম যে, “বাছাধন ! এখানে কোন জারিজুরি খাটবে না ! শক্ত পাল্লায় পড়ে গেছো, এমন প্যাঁচ কষে ধরেছে যে আর নড়াচড়াও করতে পারবে না ! তারচেয়ে ওনার বশ্যতা স্বীকার করে নাও ! ওনার রাতুল চরণে নিজেকে আত্মনিবেদন করো ! ” নান্যং পন্থা বিদ্যতে অয়নায়ঃ ৷”
মানব সমাজের বিবর্তন, মানবের বিবর্তন নিয়ে টুকরো টুকরো কথা বলতে বলতে আমরা অন্য প্রসঙ্গ ধরে এখন অনেকটা দূরে চলে এসেছি ! তাই আবার সেখানেই ফিরে যাই! __মানুষ মন প্রধান হওয়ায় জীবকুলের মধ্যে মানুষেরই মনের বিকাশ অর্থাৎ চিন্তার বিকাশ হতে শুরু করেছিল । ফলে আদিম অবস্থা থেকে মানুষ ধীরে ধীরে সভ্য অবস্থায় পৌঁছাতে সমর্থ হয়েছিল । গুরুমহারাজ একটা কথা খুব বলতেন – Need of life, Necessity of life এবং Purpose of life ! মানব বিবর্তনের একেবারে প্রথম অবস্থায় মানবের জীবনে বা মানব সমাজে শুধু Need of life -এর প্রয়োজনীয়তা ছিল ৷ Need of life হচ্ছে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, food-clothing-shelter ! সুতরাং প্রথম অবস্থায় তারা শুধু এই চাহিদা মেটানোর জন্যই সদাসর্বদাই ব্যস্ত থাকতো, সবসময় সংগ্রাম করতো ! এরপর যখন থেকে তারা একটু একটু কৃষিকার্য করতে শিখলো, পাহাড়ের গুহায় অথবা নিজেদের তৈরি আস্তানায় একটু নিরাপদ আশ্রয় পেল (নিরাপদ এই অর্থে যে, ঝড়-বৃষ্টি-শীত-গ্রীষ্ম থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় এবং হিংস্র পশুদের থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়), তখন থেকেই মানুষ একটু “অবসর” পেল, সময় পেল “চিন্তা” করার, নিজেকে বা নিজেদের অবস্থাকে কিভাবে উন্নত করা যায় – তা নিয়ে ভাবার !
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – সুস্থ সমর্থ পূর্ণ বয়স্ক মানুষের Brain-এর (Brain-cell) ওজন প্রায় ১১০০-১১৫০ গ্রাম ! এর মধ্যে এক’শ গ্রাম বা দেড়’শ গ্রাম ক্রিয়াশীল ! অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মোট Brain-cell -এর মাত্র ১০-১৫ ভাগ Active – বাকিরা dormant বা সুপ্ত ! এই ঘুমিয়ে থাকা Brain-cell গুলিকে জাগিয়ে তোলা বা active করে তোলার একমাত্র উপায় ‘ধ্যান’ । ‘ধ্যান’ – অর্থে Concentration of mind, তার মানে হচ্ছে মনের ক্রিয়াশীলতার মাঝেই তার গভীরে ঢুকে মনকে ধীরে ধীরে বিষয়শূন্য করা ! মন এমনিতে vacant কিন্তু মনে রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শাদি বিষয়গুলির ছাপ পড়ে মন ভারী হয়, ভারাক্রান্ত হয়। সুতরাং ধ্যানের প্রথম অবস্থায় মনে যে সমস্ত বিষয়সমূহ রয়েছে – সেইগুলোই কিলবিল করতে থাকবেই ৷ যতই ধ্যানী ধ্যানের গভীরে ঢুকতে চাইবে – ততই ঐ অজস্র বিষয়গুলি তাকে ভাসিয়ে রাখতে চাইবে – এটাই তো হয় !
সেই আদিম মানবদের হয়তো একটা সুবিধা ছিল যে, তৎকালে তাদের মনের বিষয় বা চিন্তার বিষয় খুবই কম ছিল – তাই চিন্তার গভীরে প্রবেশ করা হয়তো তাদের পক্ষে খুব একটা কষ্টকর হয়ে ওঠেনি । আবার এমনও হোতে পারে_ হয়তো সত্যি সত্যিই সে যুগের মানুষের কাছেও এই ব্যাপারটা আজকের চেয়েও খুব কষ্টের ছিল ! সে যাইহোক, লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ইতিহাস তো দু-চার কথায় বলা সম্ভব নয়, তাই আসুন আমরা ধরে নিই যে – তাদের মধ্যে দু-চার জন চিন্তার গভীরে প্রবেশ করে, জীবন-জগৎ-ঈশ্বর সংক্রান্ত সমস্ত রহস্য তুলে তুলে আনতে শুরু করলেন এবং তাঁদের হাত ধরেই আদিম মানুষ একটু একটু করে সভ্যতার আলোর মুখ দেখতে শুরু করল।
তবে এখানে একটা বিরাট কথা রয়েছে__এই যে সভ্যতার কথা বলা হচ্ছে__আমরা আজকের জগতে যে সব সভ্যতা-সৎস্কৃতি-বৈজ্ঞানিক বা সামাজিক উন্নতি দেখছি_এমন সভ্যতা কিন্তু এই পৃথিবীতে বারবার এসেছে,মানবের অবিমৃষ্যকারিতায় তারা নিজেরাই নিজেদের সঙ্গে মারামারি কোরে,হিংসা কোরে, যুদ্ধ কোরে সেই সভ্যতাগুলিকে নষ্ট করেছে। বারবার মানবের প্রকৃতিবিরুদ্ধ কর্মে মহাপ্রকৃতি রূষ্ট হয়ে ঘটিয়েছে প্লাবন,মহামারি, ভূমিকম্প_আর তাতেই প্রাচীনকাল থেকে বড় বড় সভ্যতা বারবার ধুলিস্যাৎ হয়েছে! আবার কালক্রমে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে মানবসমাজ, মানবের সভ্যতা।।(ক্রমশঃ)