গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন – বিভিন্ন ‘মনু’র কথা ! ভারতীয় শাস্ত্রাদিতে রয়েছে বর্তমান কালটি বৈবস্বত ‘মনু’র কাল । ইনি চতুর্দশ ‘মনু’, তার মানে হচ্ছে এর আগে আগে আরও তেরোটি মনুর ‘কাল’ মহাকালের গর্ভে তলিয়ে গেছে ! এই এক একটি মনুর সময়কালের পর ‘মন্বন্তর’ হয় অর্থাৎ ইতিমধ্যে তেরোটি মন্বন্তর আগেই ঘটে গেছে ! আমরা ওনার কাছে শুনেছিলাম এক একটি মনুর শাসনকাল অর্থে – জীব বিবর্তনের প্রথম সূত্রপাত থেকে একেবারে জড়বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শীর্ষে (একটা নির্দিষ্ট মাত্রা অবধি) উঠে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে বা মহাপ্রকৃতির রোষে পড়ে হয়ে ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত।
আমরা সাধারণ অর্থে ‘মন্বন্তর’ কথাটি যেভাবে ব্যবহার করে থাকি _যেমন ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ ইত্যাদি– সেটা ঠিক নয়, ‘মন্বন্তর’- কথাটির অর্থ অনেক ব্যাপক বা বিস্তৃত ।
এইখানে একটা কথা বলে রাখি, গুরুমহারাজ ইউরোপীয় ভক্তদের কাছে পৃথিবীর সমস্ত জীবের একসাথে মারা যাওয়া বা এই গ্রহটির অবস্থান পরিবর্তন নিয়ে একটা সাংঘাতিক তত্ত্ব বর্ণনা করেছিলেন, যেটা এর আগে পৃথিবী গ্রহের মানুষ কখনোই কোন মহাপুরুষের কাছে শোনে নি ! এখনও কোনো জড়বিজ্ঞানী, মহাকাশবিজ্ঞানী এই তত্ত্বের কোন সন্ধান-ই জানে না !!
ইউরোপীয় ভক্তরা গুরু মহারাজের আলোচনা আমাদেরকে যেভাবে বলেছিল, সেটাই আপনাদেরকে বলছি ! উনি বলেছিলেন – আমরা সবাই জানি_এই সৌরমন্ডলে একমাত্র পৃথিবী গ্রহেই প্রাণের স্পন্দন ‘প্রথম’ দেখা গিয়েছিল এবং পরবর্তীতে এখানেই প্রাণের অভিবিকাশ ঘটেছে বা বিবর্তন ঘটেছে ৷ কিন্তু অন্য কোনো গ্রহে এই কাণ্ডটি কেন ঘটল না ? তার কারণ হলো_ সূর্য থেকে পৃথিবী গ্রহের নির্দিষ্ট দূরত্ব অর্থাৎ এই গ্রহটির সঠিক অবস্থান । এই নির্দিষ্ট অবস্থানটিতে সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত তাপ, আলো এবং অন্যান্য সবকিছু (অতিবেগুনি রশ্মির মতো অন্যান্য মহাজাগতিক শক্তি) – প্রাণের স্পন্দন ঘটাতে এবং অভিবিকাশ ঘটাতে একেবারে যথাযথ ! সেইজন্যেই এখানে অর্থাৎ এই পৃথিবী গ্রহে প্রাণের বিকাশ, জীববিবর্তন বা মানবের বিবর্তন ঘটেছে ৷
এই সৌরমণ্ডলে পৃথিবী ছাড়া অন্যান্য গ্রহে প্রাণের স্পন্দন দেখা গেল না কেন – এর কারণ হচ্ছে, এই সৌরমণ্ডলের ছবিটি যদি দেখা যায় তাহলে আমরা দেখতে পাব যে পৃথিবী অপেক্ষা কতকগুলি গ্রহ সূর্যের নিকটে বা অতি নিকটে রয়েছে , ফলে সেই গ্রহগুলোতে সূর্যের উত্তাপ অনেক বেশি পৌঁছানোয় গ্রহগুলি সবসময় উত্তপ্ত অবস্থাতেই থাকে_যা প্রানধারনের অনুপোযোগী । অপরপক্ষে এই সৌরমণ্ডলের ছবি অনুযায়ী পৃথিবী থেকে দূরবর্তী গ্রহগুলিতে সূর্যালোক এবং সূর্য থেকে আগত তাপ দূরত্ব অনুযায়ী কমতে থাকে, ফলে সেই গ্রহগুলির প্রকৃতি খুবই ঠাণ্ডা এবং হয়তো শেষের দিকের গ্রহগুলি ‘অতি ঠান্ডা’, ফলে অতিরিক্ত ঠাণ্ডয় সেখানকার উপাদানগুলি জমে crystal হয়ে রয়েছে _ফলে সেখানে প্রানধারনের তো কোন কথাই ওঠে না।
গুরুমহারাজ একবার মজা করে বলেছিলেন – ” পৃথিবীর কঠিনতম পদার্থগুলির মধ্যে অন্যতম ধরা হয় হীরা বা হীরককে। তাহলে ভেবে দ্যাখো, নেপচুন বা প্লুটো গ্রহগুলি যে উপাদান দিয়ে তৈরি, সেগুলি কতবেশি কঠিন অবস্থায় আছে, সেখানকার উপাদানের ঘনত্ব আরো কত বেশি ! এখানকার ব্যবসায়ীরা যদি সুবিধা পেত – তাহলে টন টন ওইসব পদার্থ আমদানি করে হীরার থেকেও দামি পদার্থ হিসাবে বিক্রি করতো !”
যাইহোক, আমরা গুরু মহারাজের ইউরোপীয় ভক্তদের কাছে করা আলোচনায় ফিরে যাই – ওরা বলেছিল, গুরুমহারাজ ওদের কাছে বলেছিলেন যে – পৃথিবী, মঙ্গল এবং শুক্র (সৌরমণ্ডলের ছবির পৃথিবীর উপরে শুক্র অর্থাৎ সূর্যের কাছে, আর মঙ্গল নিচে অর্থাৎ সূর্য থেকে আরো দূরে) – এই তিনটি গ্রহে পর্যায়ক্রমে প্রাণের অভিবিকাশ ঘটে । কিন্তু তা কি করে ঘটবে – কারণ তিনটি গ্রহের অবস্থান তো ভিন্ন ভিন্ন ? কিন্তু এটাই ঘটে ! একটা বিরাট মহাজাগতিক ব্যাপার ঘটে এখানে । এখন বর্তমানে পৃথিবী গ্রহে প্রাণের অভিবিকাশ ঘটেছে – এখানে এককোষী প্রাণী থেকে মানুষ পর্যন্ত কোটি কোটি বছরের জীব-বিবর্তন ঘটে চলেছে ৷ এইবার মনুষ্য শরীরে এসে evolution – envolution -এ পরিণত হয়েছে। এর ফলে মানুষ – দেবতা – ঋষি – অবতার – পুরুষোত্তম (ষোলকলায় পূর্ণ প্রকাশিত ব্রহ্ম স্বরূপ), এই ক্রমে জীবের জয়যাত্রা শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায়৷ যত বেশি বেশি মানুষ প্রকৃত অর্থে আধ্যাত্মিক হয়ে উঠবে – ততই এই পৃথিবী গ্রহ Maturity লাভ করতে থাকবে ।
বর্তমানে পৃথিবীর যতরকম ধর্মীয় Sentiment এবং সেগুলি নিয়ে পরস্পরের লড়াই – মোটেই আধ্যাত্মিকতা নয় ! এগুলি নিতান্তই ধর্মজগতের ছেলেমানুষি ছাড়া আর কিছুই নয় ! আসলে আধ্যাত্মিকতা তো হলো ‘বিবেকের জাগরণ’ এবং ‘চেতনার উত্তরণ’ । সেই ধর্মাচরন-ই হলো প্রকৃত ধর্মাচরণ – যা তাকে আত্মবোধ বা ব্রহ্মবোধ এনে দেয় অর্থাৎ যে তত্ত্ব থেকে তার উৎপত্তি হয়েছিল – সে তার জন্ম-মৃত্যুর চক্র সম্পূর্ণ করে সেই পূর্বের তত্ত্বেই ফিরে যায় । এই completion সবাইকেই করতে হবে – তবেই রেহাই ! না হলে মারামারি করে মরো – আবার ফিরে এসো ! অর্থ-সম্পদের পিছনে ছুটে ছুটে মরো – তারপর আবার ফিরে এসো ! ভোগ-লিপ্সার পিছনে ছুটে ছুটে মরো – তারপর আবার ফিরে এসো ! – এইতো হয়ে চলেছে !
জন্ম থেকে জন্মান্তর এটাই হয়ে চলেছে ! এই জন্মে যে ভারতীয় – সে – ই হয়তো পরের জন্মে ইউরোপিয়ান ৷ এই জন্মে যে মুসলমান – পরের জন্মে সে – ই হয়তো হিন্দু অথবা খ্রিষ্টান ! মৃত্যুতে বা মৃত্যুর পরের অবস্থায় তো কারো control নাই – আছে কি ? তাহলে যেটুকু মস্তানি – সে তো ক্ষুদ্র এই জীবনকালের কয়েকটা বৎসর (যে কদিন শরীরে যৌবন থাকে), তারপর তো পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে বাঁচা আর মৃত্যুর পর গভীর অন্ধকারে প্রবেশ ! এইজন্যেই মহাপুরুষরা সাধারণ মানুষদের দিকে করুণার দৃষ্টিতে দেখেন, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন, তাদের শত অপরাধ মার্জনা করে দেন । শুধু তাঁরা একটাই কাজ করে যান , আর তা হোলো – এই অজ্ঞান অন্ধকারে থাকা, ন্যাকা-বোকা-আহাম্মক মানুষগুলোর ‘কিসে মঙ্গল হবে’ – তার ব্যবস্থা করে যাওয়া!!
তিনি জানেন যে, এটা করতে গিয়ে তাঁকে শত-সহস্র বাধার সম্মুখীন হতে হবে, যাদের মঙ্গলের জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন – তারাই তাঁকে রক্তাক্ত করবে, ক্ষতবিক্ষত করবে ! তবু তিনি সকলের মঙ্গল করে যান, তবু তিনি মানবের তথা সমগ্র মানবজাতির কল্যানের জন্য নিজের জীবনকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করে দেন ৷ এই ভাবেই শত কষ্ট-শত লাঞ্ছনা সহ্য করেও ভগবান বুদ্ধ, যীশু, হযরত মুহাম্মদ, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ এই পৃথিবীতে শরীর গ্রহণ করে মানবের কল্যাণ সাধন করে গেছেন । সমসাময়িক যে সমস্ত মানুষেরা তাঁদের শিক্ষাকে গ্রহণ করে নিজেদেরকে আধ্যাত্মিক ভাবে উন্নত (বিবেকের জাগরণ ও চেতনার উত্তরণ ঘটিয়ে) করতে পারেন –একমাত্র তারাই তাদের জন্ম-মৃত্যুর cycle – complete করতে পারেন ৷ যারা পারে না তারা বারবার এই পৃথিবীতে শরীর গ্রহণ করে জন্ম-মৃত্যুর আবর্তে পড়ে হাবুডুবু খায় ! [ক্রমশঃ]